২.
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকবে বলে জানি। দুই বছর দীর্ঘ সময়−দুই বছরে অনেক কিছু করা যায়। যেহেতু পুরো সময়টাতেই জরুরি অবস্থা, তাই অনেক কিছু তারা জোর করেও করে ফেলতে পারে। এই দুই বছর সময়টা তারা ঠিক করে ব্যবহার করেছে কি না ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবে। আমি শুধু তাদের একটি বিষয় নিয়ে কথা বলব।
বিষয়টি হচ্ছে এ দেশের শিক্ষা। এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। জোট সরকারের আমলে অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতিতে একেবারে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত কমিটিকে পাঠানো হলো−তাঁরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও এসেছিলেন। তাঁরা ছিলেন জোট সরকারের নিয়োগ পাওয়া সদস্য, তাই তাঁরা সেই তদন্তে এসে নিজের দলের মানুষদের রক্ষা করে বিশাল প্রতিবেদন দাখিল করলেন! আমার খুব শখ ছিল সেই প্রতিবেদনটি দেখার, কিন্তু সেটা কোনো দিন প্রকাশ করা হয়নি। কেন প্রকাশ করা হবে না? আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী দুর্নীতি হয়, আর তাদের অন্য দুর্নীতিবাজেরা কীভাবে রক্ষা করে সেটা দেশের মানুষ কেন জানতে পারবে না?
দেশের অন্য সব প্রতিষ্ঠানে কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তন হয়নি। জোট সরকারের আমলের প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে গেছে, তাদের দলীয় প্রভোস্ট, তাদের দলীয় প্রক্টর, হলে হলে তাদের দলীয় ছাত্র। শিক্ষক নিয়োগের বেলায় তাদের দলীয় শিক্ষক। দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সময় দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় মানুষেরা কীভাবে অবলীলায় মিথ্যা কথা লেখেন সে রকম কিছু কাগজপত্র আমার কাছে আছে, আমি সেগুলো মাঝেমধ্যে দেখি, কী করব বুঝতে পারি না। দলীয় বিবেচনায় প্রভোস্টরা কীভাবে ছাত্রদের হলে সিট দেন তার প্রমাণও আছে, কিন্তু সেই অভিযোগগুলো করার কোনো জায়গা নেই। জোট সরকার দেশকে শাসন করেছে পাঁচ বছর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শাসন করেছে সাত বছর−এ জন্য ইতিহাস এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমা করলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের কখনো ক্ষমা করব না।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার শিক্ষার ব্যাপারটা কখনোই বুঝতে পারেনি। ১০ জন উপদেষ্টার ভেতরে কোনো শিক্ষক নেই। কেন নেই আমরা সেটা অনুমান করতে পারি, এই উপদেষ্টা ‘সেনা সমর্থিত’ (যার অর্থ কাউকে পরিষ্ককার করে বুঝিয়ে দিতে হবে না!) তাঁদের শিক্ষকদের জন্য কোনো সম্মানবাধ নেই; যদি থাকত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গত বছর জেলে ঢুকিয়ে হেনস্তা করার সাহস পেতেন না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে শিক্ষার ব্যাপারটা বোঝেনি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল এবং সেখানে জিপিএ ফাইভের প্লাবন! সত্যি সত্যি যদি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এভাবে জিপিএ ফাইভ পেয়ে যেত, তাহলে আমার থেকে বেশি খুুশি কেউ হতো না। কিন্তু আমি খুব ভালোভাবে জানি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন কিছু ঘটেনি, যার জন্য এভাবে জিপিএ ফাইভের প্লাবন শুরু হয়ে যাবে। তাই সেই ফলাফল দেখে আমি খুশি না হয়ে খুব দুশ্চিন্তিত হয়েছিলাম। কারণ, এটা ঘটেছে সম্পুর্ণ অন্য কারণে, প্রশ্নপত্র সোজা করে করা হয়েছে, পরীক্ষকদের বলা হয়েছে উদারভাবে মার্কস দিতে। দুশ্চিন্তার কারণ সেটি নয়, কারণ হচ্ছে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেটাকে শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের সাফল্য হিসেবে বড় গলায় প্রচার করেছে। এটি সাফল্য নয়, এটি হচ্ছে শিক্ষার মান এক ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া−এই সত্য কথাটি তো দেশের সব মানুষ জানে, তাহলে কেন এই প্রচারণা?
এসএসসির রেজাল্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বলেছিলাম, এটি মাত্র শুরু, এইচএসসির রেজাল্ট হওয়ার পর আমরা আসল মজা দেখতে পাব। আমি তার মাঝে খবর পেয়েছি, এইচএসসি পরীক্ষায় বেশি বেশি মার্কস দেওয়ার জন্য পরীক্ষকদের ওপর প্রবল চাপ দেওয়া শুরু হয়েছে। সত্যি সত্যি তাই হলো, এইচএসসি পরীক্ষাতে আবার সেই জিপিএ ফাইভের প্লাবন। এবার ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল। কারণ, দেখা গেল এই পরীক্ষায় ছেলেমেয়েরা বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে বেশি ভালো করেছে! পরীক্ষার ফলাফল যদি সত্যি হয়, তাহলে এ দেশের ছেলেমেয়েরা যতটুকু বাংলা জানে, তার থেকে বেশি ইংরেজি জানে! কে এই কথা বিশ্বাস করবে? এ দেশের ছেলেমেয়েরা ১২ বছর ইংরেজি পড়ে, তার পরও শুদ্ধ ইংরেজিতে একটা এসএমএস পাঠাতে পারে একেবারে হাতে গোনা কয়েকজন। তাই তারা ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখার একটা বিচিত্র পদ্ধতি আবিষ্ককার করে বসে আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসব কোনো কিছু বিশ্লেষণ করল না, বুক ফুলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের সাফল্যের কৃতিত্বটুকু নিয়ে নিল?
যখন শিক্ষার মান কমিয়ে এনে সেটাকে ইতিবাচক একটা বিষয় বলে কৃতিত্ব দাবি করা হয়, তখন আমি খুব দুশ্চিন্তিত হয়ে যাই। শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আর মাধ্যমিক স্কুল নিয়ে সমস্যা, তা নয়। প্রাইমারি স্কুলেও সমস্যা−হঠাৎ জানতে পেরেছি, পরীক্ষামূলকভাবে কয়েক হাজার স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব ব্র্যাকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকেরা আন্দোলন শুরু করলেন। তারপর কী হলো আমরা কিছুই জানতে পারলাম না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অথচ দেশের সব মানুষকে এ ব্যাপারে অন্ধকারে রাখা হলে কেমন করে হবে?
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে কোনো শর্টকাট নেই, এটা করতে হলে শুরু করতে হবে শিক্ষকদের দিয়ে। মানসম্মত শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন আর সম্মান দিয়ে এর শুরু করা যায়, এটি না করে অন্য যে পরিকল্পনাই করা হোক তার কোনোটি কাজ করবে না। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে পরীক্ষিত এই সত্যটি গ্রহণ করতে এত ভয় কেন? এত সংকোচ কেন? এত অনাগ্রহ কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেষ হয়ে আসছে, তাদের প্রগ্রেস রিপোর্টের অনেক বিষয়ে তারা হয়তো জিপিএ ফাইভ পাবে, অনেক ক্ষেত্রে পাবে না। আমি শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের অবদানের জন্য পাস মার্ক দিতে পারলাম না। তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয় না−দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবশ্যই দিতে হয় এবং খুব কম করে হলেও পাস করতে হয়।