১৬. নিজের লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
* আমাদের বাচ্চাদের বিজ্ঞান এবং গণিতের পাঠ্যবইগুলোর ভাষা খুবই কটমটে বিজ্ঞানের সহজ বিষয়গুলোও জটিল করে লেখা হয়। আমার দুটি ইচ্ছা এবং পরিকল্পনার একটি হচ্ছে তাদের জন্য সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের বইগুলো লিখে দেওয়া। [কাজ শুরু করেছি!]
১৭. আপনি যতই বলুন না কেন, আপনি শুধু কিশোরদের জন্য লিখে থাকেন; তারপরও বড়দের জন্য লেখা ‘একজন দুর্বল মানুষ’ কিংবা ‘রঙিন চশমা’ ইত্যাদি গ্রন্থে আমরা পরিণত বয়স্ক পাঠকের রচয়িতাকেই পাই। পরিণত পাঠকদের জন্য লিখতে আপনার দ্বিধা কেন?
* আমার কোনো দ্বিধা নেই, ভয় আছে। ছোট বাচ্চারা তাহলে আমাকে খুন করে ফেলবে। তারা যদি আমাকে অনুমতি দেয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার একটা বড় উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে। এটি হচ্ছে আমার জীবনের দ্বিতীয় ইচ্ছা। এটা যদি শেষ করতে পারি তাহলে আমি মনে করব আমার দায়িত্বের একটা ধাপ শেষ হলো। তখন পরের ধাপ নিয়ে কাজ শুরু করব।
১৮. আপনার প্রিয় লেখক কারা?
* এই প্রশ্নেরও মনে হয় উত্তর নেই। লেখকদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। কোনো কোনো লেখক হয়তো শৈশবে বা কৈশোরে খুব প্রিয় ছিলেন, এখন বড় হয় গেছি বলে তার লেখা পড়ি না, কিন্তু আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় অবশ্যই তার নাম থাকতে হবে। আবার এই মুহূর্তে যে লেখকের লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি তার নামটিও থাকতে হবে, কাজেই তালিকাটি শেষ করতে পারব না।
তবে প্রিয় কবির বেলায় কাজটি খুব সহজ। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। আগে সবসময় আমার ব্যাকপেকে তার একটা বই থাকত, এখন আমি আমার Kindle ই-বুক রিডারে তার বই রাখি! [যারা Kindle ই-বুক রিডার বলতে কী বোঝায় জানেন না তাদের জন্য বলছি : পৃথিবীতে বই প্রকাশনার যুগে একটা বিপ্লব ঘটেছে, মানুষ আজকাল কাগজের বই না পড়ে ই-বুক রিডারে বই পড়া শুরু করেছে। এর মাঝে সেটা প্রায় বইয়ের মতো হয়ে গেছে, একটু অভ্যাস হয়ে গেলে কোনো সমস্যাই হয় না। শরহফষব একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড, তাদের ই-বুক রিডার থেকে যে কোনো সময় যে কোনো বই কিনে এক মিনিটের মাঝে পড়তে শুরু করা যায়। আগে বই কিনে রাখতাম পরে পড়ব বলে, পড়া হতো না। এখন বই কিনি আর পড়ি। কী মজা!]
১৯. কোন কোন লেখকের লেখায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
* যার লেখাই পড়ে আনন্দ পেয়েছি তার লেখাতেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। একটি বই যদি আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় তাহলে সেটা মার্ক টোয়েনের লেখা টম সয়ার। কৈশোরে সেই বই পড়ে আমার মাথা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল_ সেই থেকে আমি তার মতো করে লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
২০. সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে ৫৯তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
* দিলেন তো মনে করিয়ে। মনে ছিল না ভালোই ছিলাম! এই বয়সে কে জন্মদিনের কথা মনে করতে চায়?
সাদাসিধে কথা
আজকাল নিজেকে কেমন জানি গাধা-গাধা মনে হয়। প্রতিদিন খুব মনোযোগ দিয়ে কয়েকটা পত্রিকা পড়ি, কিন্তু তবু কিছু বুঝি না। একে-ওকে জিজ্ঞেস করি দেখি, তারাও কিছু বোঝেন না, মাথা চুলকান। দু-একজন মাঝেমধ্যে নিচু গলায় ভেতরের খবর দেওয়ার চেষ্টা করেন, সেগুলো আসলেই ভেতরের খবর নাকি উর্বর মস্তিষ্কেকর তৈরি করা গুজব সেটাও বুঝি না। পত্রিকায় দেখি, হইচই করে বড় বড় রাঘব বোয়াল দুর্বৃত্ত ধরা হয়। কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়, কারও বিরুদ্ধে হয় না। কারও কারও বেলায় চার্জশিট হয়, কারও কারও হয় না। কারও আবার জামিন হয় না, আবার কারও বেলায় একসঙ্গে এক ডজন-হাফ ডজন মামলার জামিন হয়ে যায়। বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছে, কিন্তু দেখি সরকার যখন যা চায় বিচার বিভাগ ঠিক তখন তা করে দেয়। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধার পিঠে লাথি মারলেও কিছু হয় না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাসের পর মাস জেলে আটকে রাখা হয়। বামঘেঁষা চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের ঝটপট ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হয়, কিন্তু জঙ্গি মৌলবাদী চরমপন্থীদের কখনো ক্রসফায়ারে ফেলা হয় না। দেশের সব প্রতিষ্ঠানের কিছু না কিছু দুর্বৃত্তদের ধরা হয়েছে, কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জোট সরকারের দুর্বৃত্তরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক যখন মাত্র তিন মাস বাকি তখন শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য উপদেষ্টারা সবাইকে ডাকাডাকি করছেন। অথচ গত দুটো বছর আমরা মাথা কুটেছি, কাগজে একটা স্বাক্ষর দিয়েই কত কিছু করে ফেলা যেত, কেউ আমাদের কথা শোনেনি!
সবকিছু মিলিয়ে আমি কী হতাশ হব না আশান্বিত হব, দুঃখ পাব না রাগ হব তাও বুঝতে পারছি না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সব সময়ই আশাবাদী মানুষ−আমার সব সময়ই কৌতুকের সেই বাচ্চা ছেলেটির কথা মনে হয়! এই ছেলেটি সব সময়ই সবকিছু নিয়ে এত খুশি হয়ে যেত যে তার বাবা-মা খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ছেলেটি যখন বড় হবে, দেখবে জীবন বড় কঠিন, সেখানে পদে পদে বাধা, তখন আশাভঙ্গের কারণে হতাশায় ডুবে যাবে। বাবা-মা তাই ঠিক করল শৈশবেই ছেলেটিকে জীবনের রূঢ় বাস্তবতার কিছু শিক্ষা দিতে হবে। শুরু করল তার ঘরটিতে ঘোড়ার গোবর ফেলে রেখে। এই গোবর পরিষ্ককার করতে করতে ছেলেটির জীবনে নিশ্চয়ই কঠিন জীবনের খানিকটা অভিজ্ঞতা হবে। বাবা-মা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে ঘরের ভেতর গোবর দেখে ছেলেটা কী করে সেটা দেখার জন্য। স্কুল থেকে এসে নিজের ঘরে ঢুকে ঘোড়ার গোবর দেখেই ছেলেটার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে যায়। সে আনন্দে চিৎকার করতে করতে সারা বাসায় ছোটাছুটি করতে থাকে। হতভম্ব বাবা-মা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’ ছেলেটা বলল, ‘আমার ঘরের ভেতর ঘোড়ার গোবর। তার মানে চমৎকার একটা টাট্টু ঘোড়া এই বাসার ভেতরে কোথাও লুকিয়ে আছে।’
কাজেই আমিও দেশের এখানে-সেখানে ঘোড়ার গোবর দেখেও হতাশ হই না, চোখ খুলে ঘোড়াটাকে খুঁজতে থাকি। মাঝেমধ্যে যখন খুব বিভ্রান্ত হয়ে যাই তখন আমি ১/১১-এর রাতের কথাটি মনে করি, তখন সঙ্গে সঙ্গে আমার মন ভালো হয়ে যায়।
সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা কি মনে আছে? জামায়াত-বিএনপির দুঃশাসনের পাঁচ বছর মাত্র পার হয়েছে, লুন্ঠন কত প্রকার ও কী কী এ দেশের মানুষ স্বচক্ষে সেটি মাত্র দেখে শেষ করেছে। একই সঙ্গে দেখছে হাওয়া ভবনকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান আর তাঁর বিশাল দুর্বৃত্ত বাহিনীর উত্থান। পাশাপাশি ধর্মকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন। স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্কালন মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপর অত্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি। ধর্মোন্নত্ত মৌলবাদীদের হাতে ধরে গড়ে তোলা হচ্ছে, অস্ত্রের চালান, জঙ্গিদের বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শেষ করে দেওয়া, প্রশাসনের নির্বিচার দলীয়করণ। জিনিসপত্রের দাম−জামায়াত-বিএনপি সরকারের কিছুতেই কিছু আসে যায় না। কারণ, পরের নির্বাচনে জিতে আসার নীলনকশা তৈরি হয়ে আছে।
একটা নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা যখন সেই ভয়ঙ্কর দুঃশাসন থেকে মুক্তি চাইছি, তখন আমরা সবিস্নয়ে আবিষ্ককার করেছি নির্বাচন কমিশনে কিছু ভাঁড় বসে আছে। শুধু কি নির্বাচন কমিশনে, অফিসের দারোয়ান থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি সবই দলীয় মানুষ। সংবিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি নিজেই প্রধান উপদেষ্টা হয়ে গেলেন। সেই ভয়ঙ্কর সময়ের কথা মনে আছে? আমার মনে আছে, ছোট বাচ্চারা আমার কাছে ফোন করে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করেছিল, তাদের একটাই প্রশ্ন, এখন কী হবে?
পর্দার আড়ালে কী হয়েছে আমরা সেগুলো ভাসা-ভাসা জানি। স্পষ্টভাবে যেটা জানি সেটা হচ্ছে, সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব পালন করল, হঠাৎ রাষ্ট্রপতি টেলিভিশনে স্বীকার করে নিলেন, নির্বাচন নিয়ে ভয়ঙ্কর একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছিল, সেটা বন্ধ করা হয়েছে।
আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যখনই আমার মনমেজাজ একটু খারাপ থাকে, তখন আমি সেই সময়টার কথা চিন্তা করি। ২২ জানুয়ারির সেই প্রহসনের নির্বাচনটি যদি জামায়াত-বিএনপি সরকার করে ফেলতে পারত, তাহলে কী অবস্থা হতো কেউ কল্পনা করতে পারে? এখন আর যাই হোক তারা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারবে না, রীতিমতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলে গোল দিতে হবে। আমরা সেই খেলা দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি।