সদ্য বিদেশ থেকে এসেছেন স্যার। অত্যন্ত আধুনিক মানুষ। এখনো বিয়ে থা করেননি কিন্তু খুব দায়িত্বশীল। আমরা মহা খুশি। একদিন মহা উত্সাহে কক্সবাজার বেড়াতে বের হলাম। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই কমলাপুর স্টেশনে হাজির হয়েছি, ফাস্র্ট ক্লাসের টিকিট কেনা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে একজন মেয়ে বাদ পড়েছে, অন্য তিনজনের বাবা-মা তাদের তুলে দিতে এসেছেন। বাবা-মায়েরা স্যারকে বললেন, ‘আপনি একটু এদের দেখে রাখবেন।’
স্যার বললেন, ‘অবশ্যই দেখে রাখব।’
বাবা-মায়েরা বললেন, ‘আজকালকার ছেলেদের কোনো বিশ্বাস নেই, সঙ্গে আপনি যাচ্ছেন বলে এদের যেতে দিচ্ছি।’
স্যার বললেন, ‘আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আছি।’
আমরা ট্রেনে ওঠলাম, গার্ড হুইসেল দিল এবং আমাদের আনন্দভ্রমণ শুরু হলো। শুরুতেই একটা ছোট সমস্যা দেখা দিল, স্যার সদ্য বিদেশ থেকে এসেছেন, কিছুতেই যেখানে খুশি সেখানে কিছু ফেলতে দেবেন না! কলা খাওয়ার পর কলার ছিলকে, ডাব খাওয়ার পর ডাবের খোসা, বিস্কুট খাওয়ার পর বিস্কুটের প্যাকেট ময়লার ঝুড়িতে ফেলতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, কোথাও ময়লার ঝুড়ি নেই। তাই স্যার নিয়মমাফিক আমাদের হাতে বর্জ্য পদার্থ তুলে দিতে লাগলেন এবং ময়লার ঝুড়িতে ফেলে আসার ভান করে আমরা এদিক-সেদিক ছুড়ে ফেলতে লাগলাম।
প্রথম চট্টগ্রাম শহর, সেখান থেকে রাঙামাটি, আমরা মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি। স্যারের বাবা খুব বড় সরকারি কর্মকর্তা। আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে রাখছেন। কাজেই যেখানেই যাই সেখানে গাড়ি, ট্রলার, গেস্টহাউস, খাবার-দাবার সব রেডি থাকে। আমরা রাজার হালে থাকি। রাঙামাটিতে বিশাল হ্রদের টলটলে নীল পানি, সেখানে সাঁতার কেটে বালুবেলায় শুয়ে থাকি। স্যার ট্রলারের গলুইয়ে বসে কবিতা লিখেন, সব মিলিয়ে চমত্কার সময় কাটছে।
শিক্ষা সফরের বড় অংশটি রেখেছি কক্সবাজারের জন্য। তাই যেদিন রাতে কক্সবাজার পৌঁছেছি আমাদের আনন্দ আর ধরে না। হোটেলে জিনিসপত্র রেখে তখনই বের হয়ে গেলাম, ঝাউবনের এক ধরনের উদাসী বাতাসের শব্দ, সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে, নির্জন বালুবেলা, জ্যোত্স্নার আলোতে রহস্যময় পরিবেশ – এক কথায় আমরা ব্যাকুল হয়ে গেলাম। আমাদের ভেতর একজন এর মাঝে গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস করেছে, সে গাঁজা টেনে আরও ব্যাকুল হয়ে গেল। এই চমত্কার সমুদ্রতটে আমরা পাঁচ-ছয় দিন কাটাবচিন্তা করেই আমাদের মন পুলকিত হতে থাকে।
আমাদের স্ফূর্তি দেখে খোদা মুচকি হাসলেন। পরদিন সকালে দেখলাম, স্যার ব্যস্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন, খুব গম্ভীর হয়ে কিছু টেলিফোন করে আমাদের সবাইকে ডাকলেন। আমরা চিন্তিতভাবে স্যারকে ঘিরে দাঁড়ালাম, স্যার বললেন, ‘একটা বড় সমস্যা হয়ে গেছে।’
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী সমস্যা?’
‘বলতে পারো একধরনের ইমার্জেন্সি।’
আমরা শুকনো গলায় বললাম, ‘কী ইমার্জেন্সি!’
স্যার বললেন, ‘সেটা তোমাদের বলতে পারব না, কিন্তু আমাকে এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে।’
আমরা মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ‘সর্বনাশ! তাহলে আমাদের শিক্ষা সফরের কী হবে?’
স্যার বললেন, ‘আমি খুব দুঃখিত। আমাকে যেতেই হবে।’
‘আপনি চলে গেলে আমরা থাকি কেমন করে? সঙ্গে মেয়েরা আছে।’
একজন বলল, ‘গার্জিয়ানরা আপনি আছেন বলে মেয়েদের আসতে দিয়েছে।’
স্যার বললেন, ‘আমাকে ছাড়া তোমরা থাকতে চাইলে থাকো। কিন্তু আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।’
স্যার নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন। আমরা বিশাল লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেরা কথা বলতে থাকি। মেয়েদের একজন বলল, ‘আমরা বড় হয়েছি না? স্যার ছাড়া থাকি, সমস্যা কোথায়?’
আমরা হাতে কিল দিয়ে বললাম, ‘সমস্যা কোথায়?’ একজন একটু ইতস্তত করছিল, তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলাম।
স্যার একটু পরেই প্লেন ধরে ঢাকা রওনা হয়ে গেলেন। এখন শিক্ষকবিহীন আমরা নয়জন ছেলেমেয়ে। স্যার থাকার সময় আনন্দ-স্ফূর্তি একটু রয়েসয়ে করতে হতো, এখন আমাদের লাগাম ছাড়া স্ফূর্তি করতে শুরু করলাম। বালুর মাঝে গর্ত করে সারা শরীর পুঁতে রেখে শুধু মাথাটা বের করে রেখেছি। জিবে কামড় দিয়ে পড়ে থাকি, লোকজন চমকে ওঠে। বালুবেলায় একটা মুণ্ডু পড়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠে। সমুদ্রের পানিতে লাফাঝাঁপি করার আনন্দ অন্য রকম, একজন চ্যাংদোলা শব্দটার অর্থ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় সবাই মিলে তাকে ধরে চ্যাংদোলা করে সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিলাম। গভীর রাতে আমরা কাঁধে লাকড়ি আর খাবার নিয়ে বালুবেলায় চলে যেতাম, আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করে বেসুরো গলায় গান গাইতাম। কম বয়সে আনন্দ করার জন্য যা করার কথা, তার কিছুই বাকি থাকল না।
শেষ পর্যন্ত কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই শিক্ষা সফর শেষ করে আমরা ফিরে আসতে শুরু করেছি। প্রথমে বাসে করে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে ঢাকায়। যতই ঢাকার কাছে আসছি, আমাদের ভেতর ততই এক ধরনের দুশ্চিন্তা চেপে বসছে। কমলাপুর স্টেশনে মেয়েদের বাবা-মায়েরা তাদের নিতে আসবেন, যখন দেখবেন স্যার নেই, তাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা কোনো অভিভাবক ছাড়া কক্সবাজারে ঘুরে বেড়িয়েছে, বাবা-মায়েরা সেটাকে মোটেও ভালো চোখে দেখবেন না। মেয়ে তিনজনকে বিশেষ দুশ্চিন্তিত দেখা গেল। বাবা-মায়েরা তাদের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবেন।