একাত্তর সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এত দক্ষতার সাথে সাধারণ মানুষদের হত্যা করতে পেরেছিল কারণ তারা তাদের পাশে পেয়েছিল এই দেশের কিছু পদলেহী বিশ্বাসঘাতক। রাজাকার-আলবদর নামে তাদের পরিচয় আর এই শব্দগুলোর চাইতে ঘৃণিত কোন শব্দ এই দেশে আর কখনো জন্ম নেবে বলে মনে হয় না। সেই কুখ্যাত বদর বাহিনীর প্রধানের নাম ছিল মতিউর রহমান নিজামী_ সেদিন হঠাৎ করে খবরের কাগজে তার একটা বক্তব্য চোখে পড়ল। বক্তব্যটি এরকম : যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে এই সরকার আসলে দেশকে ইসলামহীন করার পাঁয়তারা করছে!
মতিউর রহমান নিজামী না হয়ে অন্য যে কোন মানুষ হলে এই কথাটি পড়ে আমি তার জন্য এক ধরনের মায়া অনুভব করতাম_ কারণ দেশ পৃথিবী সমাজ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোন ধারণা না থাকলেই শুধু একজন মানুষ এরকম মন্তব্য করতে পারে। ডুবে যাওয়া মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো একটি ঘটনা প্রাক্তন বদর বাহিনীর প্রধান এখনও বিশ্বাস করে ‘ইসলাম গেলো’ ‘ইসলাম গেলো’ রব তুললেই সব মানুষ বুঝি হাতে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে তার পিছনে এসে দাঁড়াবে_ বিষয়টি আর সেরকম নেই। উনিশ শ’ একাত্তর সালের পর প্রায় চার দশক পার হয়ে গেছে তার মাঝে সম্ভাব্য সবরকম সরকার আমরা দেখেছি। “মিলিটারি+তত্ত্বাবধায়ক” এই হাইব্রিড সরকারটি আমাদের দেখা বাকি ছিল। ২০০৭-২০০৮ এ আমরা সেটাও দেখে ফেলেছি। এই নানা ধরনের সরকারের আমলে নানা ধরনের শাসন হয়েছে যার বৈচিত্র্যের কোন শেষ নেই, দেশের মানুষ তার খুটিনাটি সবকিছু ভাল করে বুঝেছে কী না জানি না, কিন্তু অন্তত একটা জিনিস বুঝেছে যে এই দেশের মাটিতে তাদের ধর্ম কর্ম করতে কোন সরকার কখনও বাধা দেয়নি। মুসলমান না হয়ে অন্য ধর্মের হলে তাদের ভোগান্তি হয়নি সেটি সত্যি নয়_ কিন্তু কোন মুসলমান ধর্ম পালন করতে পারেনি সেই কথাটি কেউ বলবে না। এই দেশে ইসলাম কখনও ধ্বংস হয়নি।
কাজেই বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মুখ থেকে যখন উচ্চারিত হয় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ছলে দেশকে ইসলামহীন করে দেয়া হচ্ছে তখন সবাই কথাটি ভাল করে বুঝতে চায়। যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে ইসলামকে ধ্বংস করা না বলে যদি বলা হতো যে জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটিকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে তাহলে অনেক মানুষই হয়তো কথাটিকে গুরুত্ব দিত। সম্ভবত তাদের দাবি যে এই দেশে তারা ইসলাম ধর্মের এজেন্সি নিয়েছে এবং এই দলটি ধ্বংস হলে ইসলামও ধ্বংস হয়ে যাবে! কারণ উনিশ শ’ একাত্তর সালের যুদ্ধাপরাধের সবচেয়ে বড় অপরাধীদের মধ্যে রয়েছে এই দলটির প্রবীণ নেতারা। বিচার কাজ শুরু হওয়া মাত্রই তাদের অতীত ইতিহাস একটি একটি করে বের হয়ে আসবে। আমাদের দেশে এখন রয়েছে অত্যন্ত ক্ষমতাশীল চৌকস একটি সংবাদ মাধ্যম, কাজেই অতীতের সেই নৃশংস ঘটনাগুলো চোখের পলকে এই দেশের মানুষ, পৃথিবীর মানুষ নতুন করে জানতে পারবে। কাজেই এটি সত্যি কথা_ জামায়াতে ইসলামী নামক দলটি মহাবিপদের মধ্যে আছে, সত্যি সত্যি তাদের ধ্বংস হবার সম্ভাবনা আছে।
বিচারের রায় কী হবে আমরা কেউ জানি না, কিন্তু অন্তত একটি জিনিস জানি, এই বিচার প্রক্রিয়া চলার সময় এই যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের রাজনৈতিক দলের জন্যে মানুষের ভেতর নূতন করে যে ঘৃণার জন্ম হবে সেটি হবে বিচারের রায় থেকেও অনেক শক্তিশালী একটি ব্যাপার।
একটা রাজনৈতিক দল চালাতে হলে সেখানে নতুন প্রজন্মকে যোগ দিতে হয়। পুরাতন নেতারা অবসর নেয়ার পর নতুন নেতারা তাদের স্থান দখল করে নিতে থাকে।
প্রাক্তন বদর বাহিনীর দল জামায়াতে ইসলামীতে সেটি কেমন করে ঘটে দেখার জন্যে আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। যে দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বাংলাদেশকে টুঁটি চেপে হত্যা করতে চেয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, সেই দলটিতে এই দেশের নতুন প্রজন্ম আর যোগ দেবে আমার সেই বিশ্বাস নেই। এই দেশের তরুণ সমাজ এত বড় বেইমান নয়।
এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে আমি চিনি। অতীতে তাদের ধোঁকা দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দলে টেনে নেয়া গেছে ভবিষ্যতে আর নেয়া যাবে না।
আধুনিক পৃথিবীতে সব ধরনের দল টিকে থাকতে পারে কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর দল টিকে থাকতে পারে না। পৃথিবীর কোথাও টিকে নেই।
যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে
যুদ্ধাপরাধের বিচার সরকার শুধু একা করছে না, আমরাও করছি। তাই এ ব্যাপারে সরকারকে সাহায্য করতে হবে। প্রতিমুহূর্তে এই একটি ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে। অন্য জায়গায় বিরোধিতা করতে পারি। সরকার যখন দুর্নীতি করবে, ভুল করবে; আমরা সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করব। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে সরকারকে ক্রমাগত সাহায্য করতে হবে।’
নিজের ৬০তম জন্মদিনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে এভাবেই নিজের মত জানালেন। একই সঙ্গে জানলেন, এই বিচারকাজের ফলাফলের জন্য তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে রাজি আছেন।
জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে আজ সকাল ১০টার দিকে প্রথম আলোর সাংবাদিক গিয়েছিলেন। সেই আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য—