গণিত অলিম্পিয়াড প্রথম যখন শুরু করেছিলাম তখন এর নাম কী হবে, সেটা নিয়ে আমাদের একটু মাথা ঘামাতে হয়েছিল। সেই ছোটবেলা থেকে আমরা বিষয়টাকে ‘অঙ্ক’ বলে আসছি—অঙ্ক বই, অঙ্ক ক্লাস, অঙ্ক স্যার, অঙ্ক পরীক্ষা—গণিত তো কখনো বলিনি। কিন্তু শুদ্ধ করে বললে তো এটাকে গণিত বলতে হবে—অঙ্ক বললে তো হবে না। তাই যা থাকে কপালে বলে আমরা ‘গণিত’ শব্দটাই বেছে নিয়েছিলাম। এত দিন পর দেখা যাচ্ছে, গণিত শব্দটা কী সুন্দর আমাদের মনে গেঁথে গেছে! বরং অঙ্ক বললেই জানি কেমন কেমন লাগে।
যখন এটা লিখছি, তখন শাহবাগে তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিস্ময়কর একটা আন্দোলন শুরু করেছে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সেই চত্বর স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল। কী বিচিত্র মনোমুগ্ধকর প্রাণবন্ত আর তেজি সেই সব স্লোগান। সেটা দেখে আমার মাথায় নতুন একটা আইডিয়া এসেছে, এ দেশে গণিত অলিম্পিয়াডের মতো ‘স্লোগান অলিম্পিয়াড’ শুরু করে দিলে কেমন হয়!
সহসভাপতি: বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৩
একটি পুরোন লেখার নতুন পাঠ : কত দীর্ঘ এই লংমার্চ
১
তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি যখন ঠিক করেছিলো যে তারা বিবিয়ানা লংমার্চ করবে তখনই আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো যে সেটাতে যোগ দিই, কিন্তু আজকাল এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছি যে দৈনন্দিন রুটিন থেকে আট আটটি দিন বের করে ফেলা খু্ব সহজ ব্যাপার নয়। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম লংমার্চ করে সবাই যখন বিবিয়ানা এলাকায় পৌঁছুবে তখন অন্তত সেখানে গিয়ে আমার কৃতজ্ঞতাটুকু প্রকাশ করে আসবো।
লংমার্চ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি খবরের কাগজে তাদের অগ্রগতি লক্ষ করতে শুরু করেছিলাম এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনি আবিষ্কার করলাম। সেগুলো হচ্ছে- ক) এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কোনো মাথাব্যথা নেই, খ) সমর্থন দিয়েছে শুধু বামদলগুলো, গ) সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমগুলো পুরো লংমার্চটিকে একটা গুরুত্বহীন ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করেছে।
আমাদের দেশের এধরনের একমাত্র সম্পদ রক্ষা করার যে প্রচেষ্টা তা আমাদের কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন নয়। তাই তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি যখন তেরোই মার্চ বিবিয়ানা এলাকায় পৌঁছেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক মিলে তাদের সঙ্গে আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়েছিলাম। সিলেট শহর থেকে ঘন্টা খানেক বাসে গিয়ে শেরপুরে পৌঁছে দেখি পথের পাশে একটা ছোট মঞ্চ করা হয়েছে। মঞ্চে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বসে আছেন। ওপরে একটা সামিয়ানা টানা আছে। আমার দেখে খুব ভালো লাগল যে যারা বসে আছে তাদের বিশেরভাগই তরুণ তরুণী। এরকম একটি ব্যাপারে আমাদের নতুন প্রজন্ম উৎসাহ দেখাচ্ছে সেটি খুব আশার কথা বলে মনে হলো।
আমরা পৌঁছা মাত্রই কিছু বোঝার আগে আমাকে এবং আমাদের প্রাক্তন উপাচার্য মোঃ হাবীবুর রহমানকে মঞ্চে তুলে দেয়া হলো। সবাই কাঠফাটা রৌদ্রে বসে আছে তার মাঝে আমরা ছায়াতে বসে আছি ভেবে একটু অপরাধবোধে ভুগছিলাম। আশেপাশে যারা এসেছেন, যাদের অনেক নাম শূনেছি, কখনো চোখে দেখিনি তাদের সঙ্গে পরিচয় করছি ঠিক তখন শুনতে পেলাম একজন আমার নাম ঘোষণা করে বলে দিয়েছেন যে, আমি এখন বক্তৃতা দেব। আমরা যে কোনো বিষয়ে পঞ্চাশ মিনিট কথা বলতে পারি (আমাদের ক্লাসগুলো পঞ্চাশ মিনিটের মাঝে মাঝে কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ক্লাস নিয়ে ফেলতে হয়)। কিন্তু আজকের এটি অন্য একটি ব্যাপার। এটি একটি জনসভা, যারা বসে আছে তারা মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছে আমি কিছু বলতে চাইলে সেটি স্লোগানের উত্তেজনা ছাপিয়ে বলতে হবে। আমার আগে আরে দু চারজন বক্তৃতা দিয়ে ফেললে তাদের কথা শুনে কিছু একটা বলা যেত। আমার সে সুযোগও নেই। কাজেই বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে আমি অন্য কিছু চেষ্টা না করে মনের কথাগুলোই বললাম, দেশের প্রতি গভীল মমতায় যারা সুদূর ঢাকা থেকে ৩০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এখানে এসেছেন তাদের প্রতি আমার পক্ষ থেকে এবং দেশের মানুষের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। লংমার্চ শুরু হবার পর জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী লংমার্চের উদ্যোগক্তাদের আবেগ দিয়ে তাড়িত বলে উপহাস করেছিলেন। আমি শ্রোতাদের বললাম দেশের জন্য ভালোবাসার যে আবেগ সেটিকে নিয়ে উপহাস করা যায় না- বাঙালীর বুকের ভেতর এই গভীর আবেগ আছে বলে উনিশর শ একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো। জ্বালানী প্রতিম্ত্রীর যে বক্তব্যটি আমার সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল সেটি হচ্ছে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির সদস্যরা নাকি গ্যাস সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমি তার প্রতিবাদ করে বললাম জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী সত্যিই যদি তাদের এতটা তাচ্ছিল্য করেন তাহলে তার উচিত তেল-গ্যস রক্ষা জাতীয় কমিটির যে কোন একজন সদস্যের সঙ্গে জাতীয় টেলিভিশনে সরাসরি বিতর্কে যোগ দেওয়া। দেশের মানুষ দেখুক কে এসম্পর্কে বেশি জানে। দেশের জন্য কার মমতা বেশি।
আমি ভালো বক্তা নই। অন্যরা আমার থেকে অনেক সুন্দর করে বক্তৃতা দিলেন। আমি খুব আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম তাদের বেশ কয়েকজন টেলিভিশনে সরাসরি বিতর্কের বিষয়টি গ্রহণ করে সেটিকে একটা সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ হিসেবে সরকারের কাছে ছুড়ে দিলেন। (লংসার্চ শেষ করে জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি এই চ্যালেঞ্জের কথা ভোলেননি সংবাদ সম্মেলন করে তারা মন্ত্রী, আমলা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, মার্কির রাষ্ট্রদূত এবং তাদের যে কোন অর্থনীতিবিদকে সরাসরি বিতর্কে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখার জন্য অপেক্ষা করছি এই বিতর্কে অংশ নেবার মতো কোনো নৈতিক জোর আদৌ তাদের আছে কিনা।)