৩.
জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ২০০৮ আসলে খুব ছোট একটা দলিল−সুচিপত্রটুকু ছেড়ে দিলে মাত্র ১৯ পৃষ্ঠা। সব মিলিয়ে এখানে পাঁচটা অধ্যায়। কোন অধ্যায় কী নিয়ে সেটা সহজে বোঝা যায় না, কারণ অধ্যায়গুলোর কোনো শিরোনাম নেই; ভেতরের বিষয়গুলো দেখে অনুমান করে নিতে হয়। প্রথম অধ্যায়টি হচ্ছে ভুমিকা, সুচনা পর্ব ও পূর্ব ইতিহাস। দ্বিতীয় অধ্যায় হচ্ছে উন্নয়ননীতির লক্ষ্য। আমার কাছে যে কপিটি আছে সেটা দেখে মনে হলো, এত গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল, কিন্তু এর পরিবেশনাটুকু একটু অগোছালো। এ অধ্যায়ের ১৯টি লক্ষ্যের ক্রমিকসংখ্যাগুলো দেখে বোঝা যায়, নারী উন্নয়ননীতির অন্যান্য অংশের সঙ্গে মিল রেখে এর ক্রমিকসংখ্যা হওয়া উচিত ছিল ২.১ থেকে ২.১৯, কিন্তু লেখা হয়েছে ১.১ থেকে ১.১৯। ফলে এ দলিলটিতে ১.১ থেকে ১.৬ ধারা রয়েছে দুবার এবং বর্ণনা করছে দুটি ভিন্ন বিষয়। তৃতীয় অধ্যায়টি হচ্ছে নারী উন্নয়ননীতির একেবারে মূল বিষয়টি−দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে লক্ষ্যগুলো ঠিক করা হয়েছিল সেগুলো বস্তবায়ন করার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তার তালিকা। নারী উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব বিষয়ই সেখানে আছে, যেমন বলা আছে বৈষম্য কিংবা নির্যাতন কীভাবে দুর করা যাবে। কীভাবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অধিকার দেওয়া যাবে এবং সবশেষে শিক্ষা-দীক্ষা প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি দিয়ে জীবনের মান বাড়াতে হবে।
এই দলিলের চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায় হচ্ছে এই উন্নয়ননীতির বাস্তবায়নের কৌশল, কর্মপরিকল্পনা, অর্থায়ন−এসব বিষয় নিয়ে।
এই নারী উন্নয়ন নীতিমালাটি পড়ার সময় ঘুণাক্ষরেও কারও মনে হবে না যে এখানে বিরোধিতা করার মতো একটি অক্ষরও আছে। মজার ব্যাপার যে ‘আলেম-ওলামারা’ তার পরও এই নারী উন্নয়ন নীতিমালা বিরোধিতা করার মাল-মসলা পেয়ে গেছেন। এটি একেবারে অবিশ্বাস্য, যে বিষয়গুলো আমরা সভ্য মানুষের পরিচয় হিসেবে দেখি তাঁরা সেই বিষয়গুলোরই বিরোধিতা করেছেন, আর সবচেয়ে ভয়ের কথা তাঁরা সেটা করছেন ধর্মের নাম দিয়ে। মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই দেশের যেসব সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ মানুষ আছেন তাঁরা এই আলেম-ওলামাদের প্রতিক্রিয়া দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছেন, তাঁরা কখনো কল্পনাও করেননি তাঁদের ধর্মকে এ রকমভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব!
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়, এই আলেম-ওলামারা বাচ্চার পরিচয় দেওয়ার বেলায় বাবার নাম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের নাম দেওয়ার বিরুদ্ধে! যে মা নয় মাস তাঁর সন্তানকে পেটে ধরে জন্ন দেন, বুক আগলে রক্ষা করেন, সেই মায়ের নাম সন্তানের পরিচয় দেওয়ার সময় লেখা যাবে না−এ রকম কথা কি কোনো সভ্য মানুষ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারেন!
সারা পৃথিবী অনেক চেষ্টা করে বাল্যবিবাহ থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে। এর কী ভয়াবহ ফল হতে পারে সেটি একটা ছোট বাচ্চাও জানে (খবরের কাগজে দেখেছি স্কুলের বান্ধবীকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে খবর পেয়ে ক্লাসের অন্য সবাই মিলে সেটাকে ঠেকিয়ে দিয়েছে)। আমাদের কপাল−এই দেশের আলেম-ওলামারা সেটা জানেন না, তাঁরা বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করতে নারাজ! বাইরের জগৎ যখন এই কথা শুনবে তখন আমরা মুখ দেখাব কেমন করে?
আলেম-ওলামারা এই নারী উন্নয়ননীতির যে ধারাগুলোর বিরোধিতা করেছেন, সেগুলো দেখে এই দেশের নারীরা একটু মুচকি হাসতেও পারেন! সম্ভবত, তাঁরা নারীদের রীতিমতো ভয় পান, মনে হয় নারীদের ক্ষমতায়ন হয়ে যাবে এই বিষয়টি তাঁদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের একটা বিষয়! তারা যেন কোনোভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা না পেয়ে যায়, অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত না হয়ে যায়, সম্পদের অধিকার না পেয়ে যায় সেটাই তাঁদের একমাত্র দুর্ভাবনা। তাঁরা কোটা প্রথারও বিরুদ্ধে, কারণ তাহলে মেয়েরা তাদের ক্ষমতায়নে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে−কিন্তু সেই কথাটা তাঁদের মুখ ফুটে বলার সাহস নেই! তাঁরা বলেন, ‘কোটা প্রথা নারীর জন্য অমর্যাদাকর।’ মজার কথা হচ্ছে তারা কিন্তু সরাসরি ঘোষণা দিয়েছেন, নারীর মর্যাদা পুরুষ থেকে কম−এই ঘোষণায় তাদের যে অমর্যাদা করা হলো সেই কথাটি একবারও তাঁদের মাথায় আসেনি!
৪.
এই দেশের সাত কোটি মানুষ হচ্ছে মহিলা। যারা নারী উন্নয়ননীতির বিরোধিতা করছেন তাঁদের মনে রাখতে হবে তাঁরা এই দেশের এক-দুজন নয় সাত কোটি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করার সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছেন। জেনে হোক না জেনে হোক তাঁদের কর্মকান্ড দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের মেয়েদের মনে ধর্ম নিয়ে একটা প্রশ্ন তৈরি করে দিচ্ছেন। এই মেয়েদের অনেকেই দেখেছে তারা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা তাদের ওপরে, তাহলে কেন তাদের পুরুষের নিচে স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে, সেটা তারা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তাঁরা যে ধর্মের কথা বলে মেয়েদের ঘরের ভেতর আটকে রাখতে চাইছেন, সেই ধর্মের যে তাঁরা অনেক বড় একটা ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন, সেটা কি তাঁরা জানেন?
নারী উন্নয়ননীতি আসলে মোটেও শুধু নারীদের ব্যাপার নয়। এটা আমাদের সবার ব্যাপার, তাই নারী উন্নয়নের জন্য শুধু নারী আর নারী সংগঠনের সদস্যরা কথা বলবেন সেটাও হতে পারে না। যখন দেখব নারীদের অধিকার দেওয়া হচ্ছে না তখন বুঝতে হবে আমাদের কারও অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। সেই অধিকার আদায় করার জন্য শুধু নারীদের নয় আমাদেরও পথে নামতে হবে।