যেসব মানুষ নারীদের সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বলছেন তাঁরা যদি এই পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটু খবর রাখতেন তাহলে তাঁরা মুখ ফুটে এ ধরনের কথা বলতে সাহস পেতেন না। পৃথিবীতে টিকে থাকাটা যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকে তাহলে নারীদের তুলনায় পুরুষেরা রীতিমতো বিপদগ্রস্ত গোষ্ঠী! বিজ্ঞানের এমন একটা পর্যায় এখন এসেছে যে প্রায় রুটিন মাফিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্লোন করা শুরু হয়েছে। নানা রকম আইন-কানুন করে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে, তা না হলে মানুষের ক্লোন করা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। যখন ক্লোন করা ডাল-ভাতের মতো হয়ে যাবে, তখন পৃথিবীর মেয়েরা যদি কোনো কারণে বিরক্ত হয়ে পুরুষদের পরিত্যাগ করে তাহলে এক প্রজন্ন পরই পৃথিবীতে আর কোনো পুরুষ থাকবে না, মেয়েরা কিন্তু নিজেদের ক্লোন করে দিব্যি পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে!
নারী বড় না পুরুষ বড়−স্কুলের ছেলেমেয়েদের মতো আমি মোটেও সেই বিতর্ক শুরু করতে যাচ্ছি না! যে জিনিসটা আমাদের মনে রাখতে হবে সেটা হচ্ছে নারী আর পুরুষ ভিন্ন দুটি প্রজাতি নয়−দুজনই মানুষ। পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে দুজনেরই একই অধিকার কেউ যদি বলে একজনের অধিকার বেশি অন্যের অধিকার কম তাহলে তার থেকে অন্যায় কথা আর কিছু হতে পারে না। মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে তার অধিকার না দেওয়ার মতো বড় অপরাধ আর কী হতে পারে?
২.
১৯৯৭ সালে প্রথমবার জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। নারী আর পুরুষের মধ্যে পার্থক্য দুর করে জাতীয় জীবনে তাদের মোটামুটি এক জায়গায় নিয়ে আসার বিভিন্ন কৌশল এই নারী উন্নয়ননীতিতে ছিল। সেই নারী উন্নয়ননীতিটি সে সময়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থা, নারী অধিকার সংগঠন এবং নানা ধরনের বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনের মাঝে আলাপ-আলোচনার সুযোগ ছিল বলে সবার মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশা ছিল। সেই নারীনীতিতে উত্তরাধিকারের বেলাতেও নারী এবং পুরুষের সমান অধিকারের কথাও বলা হয়েছিল। (মজার ব্যাপার হচ্ছে−এখন প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার করে ইসলামি দলগুলো নারী উন্নয়ননীতির নামে একটা হাঙ্গামা শুরু করলেও তখন সে রকম কিছু করেছিল বলে মনে পড়ে না!)
’৯৭-এর নারী উন্নয়ননীতি এই দেশের মানুষ বেশি দিন দেখতে পায়নি। কারণ জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক দিন রাতের অন্ধকারে সেই নারীনীতি পরিবর্তন করে ফেলা হলো! বলা হয়ে থাকে সেই পরিবর্তনটুকু করেছে জোট সরকারের শরিক জামায়াতে ইসলামী এবং সেই পরিবর্তনের কথা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কিংবা আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দুরে, মহিলা আর শিশু বিষয়কমন্ত্রী খুরশিদ জাহান হকও জানতেন না! পুরোপুরি জামায়াতে ইসলামী কায়দায় পরিবর্তনগুলো করার কারণে সেই দলিলটি তখন আর ‘নারী উন্নয়ননীতি’ থাকল না, বরং হয়ে গেল ‘নারী ঠেকাও নীতি’। পরিবর্তন করা হয়েছিল ২০০৪ সালের মে মাসের মাঝামাঝি, দেশের মানুষ সেটা জানতে পারল ২০০৫ সালের প্রথম দিকে! জানামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে সবাই এই নারী ঠেকাও নীতি প্রত্যাখ্যান করে সবাই ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ননীতি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করতে শুরু করল।
শেষ পর্যন্ত এই বছর বিশ্ব নারী দিবসে প্রধান উপদেষ্টা নারী উন্নয়ননীতি ২০০৮ ঘোষণা করলেন। উত্তরাধিকারের কথাটি নেই, তবুও সবাই প্রাথমিকভাবে একটু সতর্ক হয়ে সেটাকে স্বাগত জানাল, কারণ এর মধ্যে কিছু নতুন বিষয় এসেছে (যেমন−পাঁচ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি, জাতীয় সংসদে বর্ধিত আসনের পরিবর্তে এক-তৃতীয়াংশ আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কোটা বাড়ানো ইত্যাদি)! বলা যেতে পারে, এটা ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ননীতির পুনর্বিন্যাস।
এ পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু এর পরে যা ঘটল তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না! ধর্ম ব্যবসায়ী দলগুলো রুটিনমাফিক তাদের চেঁচামেচি শুরু করে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে সরকারের চরজন উপদেষ্টা এই নারীনীতি পর্যালোচনা করার জন্য এমন একটা কমিটির হাতে তুলে দিলেন, যাঁরা আজীবন প্রগতিশীল কাজের বিরোধিতা করে এসেছেন, আজীবন নারীদের সব ধরনের উন্নয়নে বাধা দিয়ে এসেছেন। ‘আলেম-ওলামা’দের এই কমিটিতে কোনো মহিলা নেই। বাংলাদেশে ১৪ কোটি মানুষের মধ্যে সাত কোটি মহিলা−এই সাত কোটি মহিলার মধ্যে একজন মহিলাও নেই, যিনি ধর্ম সম্পর্কে জানেন? যিনি এই আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বসে ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা পর্যালোচনা করতে পারেন? নারী উন্নয়ননীতি−কিন্তু সেটা পর্যালোচনা করবে কিছু নারীবিদ্বেষী পুরুষ, এটা কোন ধরনের যুক্তি? সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে, এই নারী উন্নয়ননীতিতে কিন্তু এ ধরনের ব্যাপার যেন না ঘটে সেটা নিয়েও সতর্ক করে দেওয়া আছে। ৩.৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো ধর্মের, কোনো অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারীস্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইনবিরোধী কোনো বক্তব্য বা অনুরূপ কাজ করা বা কোনো উদ্যোগ না নেওয়া’। অথচ ঠিক এ কাজটিই করা হলো, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নারীস্বার্থের পরিপন্থী একটা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য কিছু আলেম-ওলামাকে সুযোগ করে দেওয়া হলো−এর চেয়ে উৎকট রসিকতা আর কী হতে পারে?
বর্তমান সরকার বিচ্ছিন্ন কয়েকজন মানুষের সরকার−আমরা আগেও দেখেছি, হঠাৎ করে উপদেষ্টাদের চাকরি চলে যায়! এ রকম অবস্থায় অন্য কিছু না হোক নিজের চাকরির জন্য মায়ার কারণেও তো তাঁদের আরও একটু সতর্ক থাকার কথা−তাঁরা কোন যুক্তিতে এ রকম দায়িত্বহীন একটা কাজ করলেন? সে জন্য তাঁদের কি কখনো দেশের মানুষ ক্ষমা করবে?