২.
ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। কিন্তু ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ আমার অসম্ভব প্রিয়। কেউ যেন মনে না করে, আমি একজন খাঁটি বোদ্ধা। ফুটবল শারীরিক খেলা, একজন খেলোয়াড় ক্রমাগত আরেকজন খেলোয়াড়ের গায়ে গা লাগিয়ে হুটোপুটি করেন বলে আমার ‘সুকুমার’ মনোবৃত্তি আহত হয়—তাই এই খেলাটি আমি দেখতে পারি না। সেই তুলনায় ক্রিকেট ভদ্র মানুষের খেলা, একজন খেলোয়াড় আরেকজন খেলোয়াড়কে স্পর্শ না করে খেলে যান, তাই আমি খেলাটি পছন্দ করি—আসলে সে রকম কিছু নয়। ফুটবলের ওয়ার্ল্ড কাপ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না, কারণ সেই সময়টাতে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশটাতে বিদেশের পতাকা আকাশে উড়তে থাকে এবং দেখে মনে হয়, পুরো দেশটাকে বুঝি বিদেশিরা দখল করে ফেলেছে। জাতীয় পতাকা মোটেও এক টুকরো কাপড় নয়—এটা অনেক বড় রাষ্ট্রীয় ব্যাপার, ইচ্ছে করলেই একটা দেশে অন্য দেশের পতাকা তোলা যায় না। বিশেষ প্রয়োজনে যদি অন্য দেশের পতাকা তুলতে হয়, তাহলে তার আগে অনেক নিয়মকানুন মানতে হয়—অন্য দেশের পতাকা থেকে উঁচুতে নিজের দেশের পতাকাটি টাঙাতে হয়। আমি দেখেছি, আমাদের রাষ্ট্র সেই কথাগুলো কাউকে মনে করিয়ে দেয় না। দেশের মানুষ পুরোপুরি নির্বোধের মতো নিজের দেশকে অপমান করতে থাকে, কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না।
আমি ক্রিকেটের ওয়ার্ল্ড কাপ অসম্ভব ভালোবাসি, কারণ এই সময়টাতে সারা দেশের মানুষ লাল-সবুজ রঙের খেলায় মেতে ওঠে। এই খেলায় আমার নিজের দেশ খেলছে এবং আমরা ক্রমাগত ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ করে চিৎকার করছি। দেশকে ভালোবাসার আর দেশকে নিয়ে গর্ব করার একটা সুযোগ করে দেয় এই ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট খেলা। যাঁরা ক্রিকেট বোদ্ধা, তাঁরা খেলার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেন, আমি পারি না। আমি খেলা দেখতে পারি, যখন সেই খেলায় বাংলাদেশ জিততে থাকে, শুধু তখন! বাংলাদেশ যদি কখনো কোনো খেলায় হেরে যায়, তখন দুঃখে আমার বুক ভেঙে যায়, মনে হয় হাউমাউ করে কাঁদি।
এই দেশের মানুষেরা আজকাল লাল-সবুজ রঙের কাপড় পরে, মাথায় ফেটি বাঁধে। লাল-সবুজ আমাদের জাতীয় পতাকার রং। মার্চ মাস আসছে, আমাদের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অসংখ্য জাতীয় পতাকা তৈরি হবে এবং আকাশে ওড়ানো হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ বলে লাইব্রেরিতে একটি অংশকে আলাদা করে রাখা হয়েছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত যত বই, যত তথ্য—সবকিছু সংগ্রহ করা হচ্ছে। তার দেয়ালে ঝোলানোর জন্য আমি সবচেয়ে বড় জাতীয় পতাকাটি কিনে এনেছিলাম। সেটি ঝোলানোর সময় মেপে আমি আবিষ্কার করলাম, সেটি সঠিক মাপে তৈরি নয়। পুরোটি কেটে আমাকে নতুন করে জাতীয় পতাকা তৈরি করতে হয়েছে। এখন আমি চোখ খোলা রেখে তাকাই এবং একধরনের দুঃখ মেশানো বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করি যে বাংলাদেশে জাতীয় পতাকা নিয়েও একধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। যে কেউ যেকোনো মাপে জাতীয় পতাকা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে, কেউ তাকে থামাচ্ছে না। জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রংটি সঠিক—এ ছাড়া আর কিছু সঠিক নয়। একটি সবুজ আয়তক্ষেত্রে মোটামুটি আকারের একটা লাল বৃত্ত বসিয়ে দিলেই সেটা জাতীয় পতাকা হয়ে যায় না। কিন্তু সেটাই এ দেশে ঘটছে।
অথচ জাতীয় পতাকার মাপটি মোটেও কঠিন নয়। দশ এবং ছয় এই দুটি সংখ্যা মনে রাখলেই জাতীয় পতাকার পুরো মাপটি মনে রাখা সম্ভব। জাতীয় পতাকার দৈর্ঘ্য যদি দশ ফুট হয়, তাহলে তার প্রস্থ হবে ছয় ফুট। এখন আমার জানা দরকার, লাল বৃত্তের সাইজ, দশ থেকে ছয় বিয়োগ দিলেই সেটা বের হয়ে যাবে, অর্থাৎ বৃত্তের ব্যাস হচ্ছে চার ফুট। বৃত্তটি যদি আয়তক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে বসানো হতো, তাহলে আর কিছুই জানতে হতো না—কিন্তু আমাদের জাতীয় পতাকার লাল বৃত্তটি পতাকা টাঙানোর দণ্ডটির দিকে একটু সরে এসেছে। কতটুকু সরে এসেছে, সেটা অনেকভাবে বের করা যায়, সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি এ রকম। বাঁ-দিকে পতাকার খুঁটি থাকলে ডান দিকে এক ফুট কাপড় ভাঁজ করে আয়তক্ষেত্রটি নয় ফুট বাই ছয় ফুট করে ফেলতে হবে। এখন বৃত্তটি বসাতে হবে এই নয় ফুট বাই ছয় ফুট আয়তক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে। দশ ফুট বাই ছয় ফুট সাইজের জাতীয় পতাকা না করে কেউ যদি পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট বা আরও ছোট করতে চায়, তাহলে ঠিক একই মাপে সবকিছু কমিয়ে আনতে হবে।
আমার ইচ্ছা, রাষ্ট্র এই বিষয়গুলোতে একটুখানি নজর দিক। যে ফেরিওয়ালা জাতীয় পতাকা বিক্রি করছে, তাকে বাধ্য করুক সঠিক মাপের জাতীয় পতাকা তৈরি করতে। স্কুলের বাচ্চাদের উৎসাহ দিক লাল-সবুজ কাগজ কেটে সঠিক মাপের জাতীয় পতাকা তৈরি করতে। একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার চল্লিশ বছর পরও আমরা সঠিক জাতীয় পতাকা খুঁজে পাব না—এটা হতে পারে না।
জাতীয় পতাকা নিয়ে আমাদের একটা চমৎকার বিষয় আছে, যেটা অন্য দেশগুলোর নেই। সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাতীয় পতাকা। সেই পতাকার মাঝখানে সোনালি রং দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রটি বসানো ছিল। প্রথম দিন যখন আমি এই মানচিত্র দেখেছিলাম, তখন আমার বুকের ভেতর যেভাবে রক্ত ছলাৎ করে উঠেছিল, আমি এখনো সেটি অনুভব করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের সেই পতাকাটি একটু পরিবর্তন করে এখন আমরা আমাদের নতুন জাতীয় পতাকা পেয়েছি—কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই পতাকাটি কিন্তু হারিয়ে যায়নি। আমরা কিন্তু সেই পতাকাটিকে আমাদের হূদয়ের ভেতরে স্থান করে দিয়েছি। আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি, তরুণ প্রজন্ম এখনো মুক্তিযুদ্ধের পতাকাটিও সমান মমতায় নিজের কাছে রাখছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে জাতীয় পতাকার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পতাকাটিও আমরা গভীর মমতায় ঝুলিয়ে রেখেছি।
গাড়িতে পতাকা লাগানোর একটি ব্যাপার আছে—শুধু মন্ত্রীরা গাড়িতে পতাকা লাগাতে পারেন। এই বিষয়টি আমি ভালো বুঝতে পারি না। জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকার ওপরে দেশের জনগণের সবার একধরনের অধিকার আছে। জাতীয় পতাকাটিকে যথাযথ সম্মান দেখানো হলে যেকোনো মানুষের সেটি ব্যবহার করার অধিকার থাকার কথা ছিল। বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবসে অনেকেই গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে নেন, আমি দেখেছি, পুলিশ তাদের থামিয়ে পতাকা খুলে ফেলতে বাধ্য করছে! মুক্তিযুদ্ধের পতাকাটি লাগালে নিশ্চয়ই পুলিশ কিছু বলতে পারবে না।