ব্যাপারটি আমরা যতভাবেই ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ করি, প্রশ্নটি কিন্তু থেকে যায়। যুক্তিতর্ক, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে এ প্রশ্নটিকেই অর্থহীন করে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ খোলা নেই। সে অঙ্গীকার করে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে এবং আমরা আবার নতুন প্রজন্মের চোখের দিকে তাকিয়ে বলব, কে বলেছে এই দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয় না। এই দেখো, আমরা তাদের বিচার শেষ করেছি, সেই মুহূর্তটির জন্য আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।
আমরা শুনতে পাচ্ছি কি না জানি না, কিন্তু এ দেশের যুদ্ধাপরাধীরা কিন্তু তাদের মৃত্যুঘণ্টা শুনতে শুরু করেছে। ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, এ দেশের যুদ্ধাপরাধীরা ঠিক সেভাবে তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য শেষ আশ্রয়টুকু আঁকড়ে ধরেছে। নিজের কানে শুনে, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না যে এ দেশের যুদ্ধাপরাধীদের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ, শেষ সহায় হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১-এ যে মুক্তিযোদ্ধাদের তারা বলে এসেছে দুষ্কৃতকারী, ভারতের দালাল, ইসলামের দুশমন, বেইমান, গাদ্দার, যাদের তারা আক্ষরিক অর্থে এ দেশের মাটিতে জবাই করেছে; হঠাত্ করে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেখাতে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যে মুক্তিযুদ্ধে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী হয়ে অস্ত্র হাতে এ দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, এখন তারা যে শুধু সেই যুদ্ধকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছে তা নয়, তারা দাবি করছে, সেই মুক্তিযুদ্ধকে তারা সহায়তা করেছে! এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার এ দেশের মানুষ কি কখনো শুনেছে? কখনো শুনবে? যারা বলছে, তারা নিজেরাও তো সেই কথা একবারের জন্যও বিশ্বাস করে না। তাহলে তারা কেন সেটি বলছে?
আমরা সবাই জানি, তারা এই কথাগুলো বলছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য, সংগঠনটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তাদের নিজের দলের তরুণ প্রজন্মকে ধরে রাখার জন্য। যে রাজনৈতিক দল রাজাকার হয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদলেহন করে নিজের মা-বোনকে তাদের হাতে তুলে দেয়, বদর বাহিনী হয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে, কোন তরুণ সেই রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে ছুটে যাবে? সত্যিকারের বিচারের আলো ঘৃণার আগুনে ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকার কষ্ট থেকে তাদের মুক্তি নেই। বিচারে কী হবে, আমরা জানি না, কিন্তু এ দেশের মানুষ তাদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না, সেই কথাটি যুদ্ধাপরাধীদের থেকে ভালো করে আর কেউ জানে না!
আমার ধারণা, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিটুকু উচ্চারণ করেই আমরা এই নতুন বছরকে গ্রহণ করব। এ বছরেই আমরা সত্যিকার অর্থে গ্লানিমুক্ত হব।
নববর্ষের শপথ
পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্যে দিন রাত হয়, বার্ষিক গতির জন্য ঋতু পরিবর্তন হয় সেই হিসেবে ইংরেজী নববর্ষের দিনটি অন্য যে কোনো একটা দিনের মত, তার আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই।
তারপরও শুধুমাত্র নববর্ষের দিন বলে এই দিনটিকে আমরা আলাদাভাবে দেখতে পছন্দ করি। রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে আমরা বিকট চেচামেচি করি, পরিচিতি অপরিচিত সবাইকে “হ্যাপি নিউ ইয়ার” বলে ব্যতিব্যস্ত করে তুলি।
ঘড়ির কাঁটা পেছানোর জন্য ঠিক রাত বারোটা বেছে নেওয়ার কারণে এইবার আমাদের এক ঘণ্টার মাঝে দুই দুইবার নববর্ষ পালনের সুযোগ এসেছিল।
কিন্তু বেরসিক সাংবাদিকদের কারণে সরকার সতর্ক হয়ে ঘড়ির কাঁটা পেছানোর জন্য রাত বারোটা বেছে না নিয়ে এগারোটা উনপঞ্চাশ বেছে নিয়েছে।
যার অর্থ আমরা নববর্ষের এক মিনিটের ভেতর চলে এসে আবার এক লাফে এক ঘন্টা পিছিয়ে যাবো! দুই দুই বার নববর্ষ পালন করার ঐতিহাসিক সুযোগটা আর পাব না।
একবারই হোক আর দু’বারই হোক নববর্ষ দিনটাকে আলাদা ভাবে দেখার জন্য আমরা সব সময়েই নতুন বছরে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করি।
ছাত্রছাত্রীরা সময়মত হোমওয়ার্ক করার পরিকল্পনা করে, গৃহিনীরা হিন্দী সিরিয়াল না দেখার প্রতিজ্ঞা করে, বয়স্ক মানুষেরা সিগারেট ছেড়ে দেবার যোগাড়যন্ত্র করে। প্রথম সপ্তাহ দু’য়েক সবাই তাদের প্রতিজ্ঞায় অটল থাকে, তারপর কীভাবে কীভাবে জানি ঠিক আগের অবস্থায় চলে আসে।
তবে আমাদের জন্য এই নববর্ষটা একটা চমৎকার সুযোগ নিয়ে এসেছে। হোমওয়ার্ক, হিন্দী সিরিয়াল কিংবা সিগারেট সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত থেকেও ভালো সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি – সেটা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি করা।
এই সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, জাতীয় সংসদে সেই সংক্রান্ত একটা সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। খবরের কাগজে দেখেছি বিচারের জন্য ভবন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি, মার্চে ট্রাইবুনাল গঠন হবে, তদন্ত করার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ হবে।
বিষয়টি যত দ্রুত হওয়ার কথা ছিল, তত দ্রুত হচ্ছে না সেটা সত্যি কথা। ভেতরে অন্য কিছু হচ্ছে কি না আমরা সেটাও জানি না। একাত্তরে যে দেশগুলো এই দেশের যুদ্ধাপরাধীদের সাথে সাথে ছিল তাদের অনেক এখনো তাদের সাথে আছে।
যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য তারা নতুন কোনো পায়তারা শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সকল বাধা আর প্রতিবন্ধকতা দূর করার একটা মাত্র উপায় হচ্ছে দেশের সকল মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে এই বিচারের দাবিটি জোরালো বা স্পষ্ট উচ্চারণ করা।