মণি-মঞ্জীর বাজে অরুণিত চরণে সখী
কীর্তন
মণি-মঞ্জীর বাজে অরুণিত চরণে সখী
রুনুঝুনু রুনুঝুনু মণি-মঞ্জীর বাজে।
হেরো গুঞ্জামালা গলে বনমালী চলিছে কুঞ্জ-মাঝে॥
চলে নওল কিশোর,
হেলে দুলে চলে নওল কিশোর।
হেরি সে লাবণি কৌস্তুভমণি নিষ্প্রভ হল লাজে।
চরণ-নখরে শ্যামের আমার চাঁদের মালা বিরাজে॥
বঁধুর চলার পথে পরান পাতিয়া রব
চলিতে দলিয়া যাবে শ্যাম,
আমি হইয়া পথের ধূলি বক্ষে লইব তুলি
চরণ-চিহ্ন অভিরাম॥
ভুলে যা তোরা রাধারে কৃষ্ণ-নিশির আঁধারে
হারায়ে সে গেছে চিরতরে,
কালো যমুনার জলে ডুবেছে সে অতল তলে
মিশে গেছে সে শ্যাম-সাগরে॥
ওই বাঁশি বাজিছে শোন রাধা বলে,
মোর তরুণ তমাল চলে, অঙ্গ-ভঙ্গে শিখী-পাখা টলে।
তার হাসিতে বিজলি
কাজল-মেঘে যেন উঠিছে উছলি।
রূপ দেখে যা দেখে যা,
কোটি চাঁদের জোছনা-চন্দন মেখে যা,
মোর শ্যামলে দেখে যা॥
মন লহো নিতি নাম রাধা-শ্যাম
বেহাগ মিশ্র কাহারবা
মন লহো নিতি নাম রাধা-শ্যাম
গাহো হরিগুণগান।
তব ধন-জন-প্রাণ যাহার কৃপার দান
জপো তারই নাম জয় ভগবান জয় ভগবান॥
জনক-জননীর [স্নেহে] তাঁহার
রূপ হেরিস তুই স্নেহময়,
ভাই ভগিনীর প্রীতিতে যাঁর
শান্ত মধুর পরিচয়।
প্রণয়ী বন্ধুর মাঝে
যাঁর প্রেম-রূপ বিরাজে,
পুত্র কন্যারূপে সেই জুড়ায় তাপিত পরান।
তৃষ্ণা-ক্ষুধায় সেই কৃষ্ণেরই লীলা
হাসে শ্যাম শস্যে কুসুমে রঙিলা,
তরঙ্গে ছলছল আঁখি জল-নীলা,
কল-ভাষা নদী-কলতান।
দেয় দুঃখ শোক সেই, পুন সে করে ত্রাণ।
জপো তার নাম, জয় ভগবান, জয় ভগবান॥
মালঞ্চে আজ কাহার যাওয়া-আসা
খাম্বাজ দাদরা
মালঞ্চে আজ কাহার যাওয়া-আসা।
ঝরা পাতায় বাজে
মৃদুল তাহার পায়ের ভাষা॥
আসার কথা জানায়
ওই যে ফুলের আখর সবুজ পাতায়,
ওই দোয়েল শ্যামার কূজন কয় যে বাণী
ওই ওই ওই তার ভালোবাসা॥
মদীর সমীরণে
তার তনুর সুবাস পাই যে ক্ষণে ক্ষণে।
সবুজ বসন ফেলি
পরল ওই বন কুসমি-রঙা চেলি।
তাই বসুন্ধরায় জাগে
অরুন আশা
ওই ওই ওই আলোকের পিপাসা॥
মোর মাধব-শূন্য মাধবী-কুঞ্জে
কীর্তন
মোর মাধব-শূন্য মাধবী-কুঞ্জে (সখী গো)
আমি যাব না যাব না, দেখিতে পাব না
সে শ্যাম নীরদপুঞ্জে।
মোরে থাকিতে দে গো এমনি পড়ে,
মোরে মাখিতে দে সেই পথের ধূলি
চলে গেছে হরি যে পথ ধরে।
সখী খুলে নীল শাড়ি দে লো তাড়াতাড়ি
গেরুয়া বসন পরায়ে,
ব্রজে নীলমণি নাই, কি হবে বৃথাই
গায়ে নীল শাড়ি জড়ায়ে।
তোরা খুলে নে লো মোর আভরণ,
কপাল যাহার পুড়েছে লো সই
ভস্ম যে তার ললাট-ভূষণ।
জনম যাহার যাইবে কাঁদিয়া
কাঁদিতে দে তারে একাকী,
বৃথা প্রবোধ তারে দিসনে তোরা,
জানি নয়নের জল হয়তো শুকাবে
শুকাবে ব্যথার রেখা কি?
ভুলে যা লো তোরা
ভুলে যা আমায়,
যদি কৃষ্ণেরে তোরা ভুলিতে পারিস
ভুলিতে পারিবি রাধায়॥
রহি রহি কেন আজও সেই মুখ মনে পড়ে
পঞ্চমরাগ-মিশ্র কাওয়ালি
রহি রহি কেন আজও সেই মুখ মনে পড়ে।
ভুলিতে তায় চাহি যত তত স্মৃতি কেঁদে মরে॥
দিয়াছি তাহারে বিদায় ভাসায়ে নয়ননীরে,
সেই আঁখিবারি আজি মোর নয়নে ঝরে॥
হেনেছি যে অবহেলা পাষাণে বাঁধি হিয়া,
তারই ব্যথা পাষাণ-সম রহিল বুকে চাপিয়া॥
সেই বসন্ত ও বরষা আসিবে ফিরে ফিরে,
আসিবে না আর ফিরে অভিমানী মোর ঘরে॥
রেশমি চুড়ির তালে কৃষ্ণচূড়ার ডালে
গৌড়সারং কাওয়ালি
রেশমি চুড়ির তালে কৃষ্ণচূড়ার ডালে
পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা ডেকে ওঠে পাপিয়া।
আঙিনায় ফুল-গাছে প্রজাপতি নাচে,
ফেরে মুখের কাছে আদর যাচিয়া॥
দুলে দুলে বনলতা কহিতে চাহে কথা,
বাজে তারই আকুলতা কানন ছাপিয়া।
শ্যামলী-কিশোরী মেয়ে
থাকে দূর-নভে চেয়ে,
কালো মেঘ আসে ধেয়ে
গগন ব্যাপিয়া॥
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘুর্ণিবায়
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
নাচিছে ঘুর্ণিবায়।
জল তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল
ঢেউ তুলে সে যায়।।
দীঘির বুকের শতদল দলি,
ঝরায়ে বকুল চাঁপার কলি,
চঞ্চল ঝরনার জল ছলছলি
মাঠের পথে সে ধায়।।
বন-ফুল-আভরণ খুলিয়া ফেলিয়া,
আলুথালু এলোকেশ গগনে মেলিয়া
পাগলিনী নেচে যায় হেলিয়া-দুলিয়া
ধূলি-ধূসর কায়।।
ইরানি বালিকা যেন মরু–চারিণী
পল্লির প্রান্তর–বন মনোহারিণী
ছুটে আসে সহসা গৈরিক বরণী
বালুকার উড়ুনি গায়।।
শোনে লো বাঁশিতে
মালকোশ – সেতারখানি
শোনে লো বাঁশিতে
ডাকে আমারে শ্যাম।
গুমরিয়া কাঁদে বাঁশি
লয়ে রাধা নাম॥
পিঞ্জরে পাখি যেন
লুটাইয়া কাঁদে মন,
আশে পাশে গুরুজন বাম॥
সকরুণ নয়নে চাহো আজি মোর বিদায়বেলা
দেশি-টোড়ি-মিশ্র লাউনি
সকরুণ নয়নে চাহো আজি মোর বিদায়বেলা।
ভুলিতে দাও বিদায়-দিনে হেনেছ যে অবহেলা॥
হাসিয়া কহো কথা আজ হাসিতে যেমন আগেতে
হেরিবে মোর জীবন-সাঁঝে গোধূলি রঙের খেলা॥
থেকে যাও আরও কিছুখন থাকিতে বলিব না কাল,
মরণ-সাগরাপানে ভাসে মোর জীবন-ভেলা॥
আজিকার সাঁঝের ছায়া যেন না পড়ে ও মুখে,
সাঁঝের শেষে যেন আসে চাঁদের আর তারকার মেলা॥
হে বন্ধু, বন্ধুর পথে কে কাহার হয়েছে সাথি,
তেমনি থাকিয়া যায় সব, যাবার যে, যায় সে একেলা॥
সখী যায়নি তো শ্যাম মথুরায়
কীর্তন
সখী যায়নি তো শ্যাম মথুরায়,
আর আমি কাঁদব না সই।
সে-যে রয়েছে তেমনই ঘিরে আমায়॥
মোর অন্তরতম আছে অন্তরে
অন্তরালে সে যাবে কোথায়?
আছে ধেয়ানে স্বপনে জাগরণে মোর
নয়নের জলে আঁখি-তারায়॥
কে বলে সখী অন্ধকার এ বৃন্দাবনে কৃষ্ণ নাই,
তমাল-কদম শ্যামপল্লবে হৃদিবল্লভে দেখিতে পাই।
গোকুলে যে আজ কৃষ্ণপক্ষ,
কে বলে সখী কৃষ্ণ নাই।
অন্য পক্ষে কী কাজ সখী,
গোকুলে যে আজ কৃষ্ণপক্ষ,
দেখো কৃষ্ণেরই নাম লয় সবাই।
সখী গো –
আমি অন্তরে পেয়েছি লো, বাহিরে হারিয়ে তায়,
যাক না সে মথুরায়, যেথা তার প্রাণ চায়॥
শ্যামে হেরিয়াছি যমুনার কালো জলে, সাগরে,
আষাঢ়ের ঘন মেঘে হেরিয়াছি নাগরে।
হেরিয়াছি তারে শ্যাম-শস্যে হেমন্তে,
পীত-ধড়া হেরি তার কুসমি বসন্তে।
এঁকেছিলাম শ্যামের ছবি সেদিন সখী খেলার ছলে,
আঁকিনি লো চরণ তাহার, পালায়ে সে যাবে বলে।
আনিয়া দে আজ সে চিত্রপট
আঁকিব লো আজি চরণ তার,
সে যায়নি মথুরা কাঁদিসনে তোরা
আছে আছে শ্যাম হৃদে আমার॥