- বইয়ের নামঃ গীতি-শতদল
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অবুঝ মোর আঁখি-বারি
তিলক-কামোদ – ঠুংরি
অবুঝ মোর আঁখি-বারি
আমি রোধিতে নারি॥
গলেছে যে নদীজল
কে তারে রোধিবে বল,
পাষাণের সে নারায়ণ
তবু সে আমারই॥
অসুর-বাড়ির ফেরত এ মা
ভৈরবী একতালা
অসুর-বাড়ির ফেরত এ মা
শ্বশুরবাড়ির ফেরত নয়।
দশভুজার করিস পূজা
ভুলরূপে সব জগৎময়॥
নয় গৌরী নয় এ উমা
মেনকা যার খেত চুমা,
রুদ্রাণী এ, এ যে ভূমা,
এক সাথে এ ভয়-অভয়॥
অসুর দানব করল শাসন
এইরূপে মা বারে বারে
রাবণ-বধের বর দিল মা
এইরূপে রাম-অবতারে।
দেব-সেনানী পুত্রে লয়ে
যায় এই মা, দিগ্বিজয়ে
সেইরূপে মায়ের কর রে পূজা
ভারতে ফের আসবে জয়॥
আঁখি ঘুম-ঘুম নিশীথ নিঝুম ঘুমে ঝিমায়
ভৈরবী তালফেরতা
আঁখি ঘুম-ঘুম নিশীথ নিঝুম ঘুমে ঝিমায়।
বাহুর ফাঁদে স্বপন-চাঁদে বাঁধিতে চায়॥
আমি কার লাগি
একা নিশি জাগি
বিরহ-ব্যথায়।
কোথায় কাহার বুকে বঁধু ঘুমায়।
কাঁদি চাতকিনি বারি-তৃষায়।
কুসুমগন্ধ আজি যেন বিষমাখা হায়॥
কেন এ ব্যথা এ আকুলতা
পরের লাগি এ পরান পুড়ে,
মরুভূমিতে বারি কভু কি ঝুরে।
আমি এবার যেন মরে আসি তারই রূপ ধরে
সে যাহারে চায়॥
আজ লাচনের লেগেছে যে গাঁদি গো
পল্লি নৃত্যের গান
আজ লাচনের লেগেছে যে গাঁদি গো
আজ লাচনের লেগেছে গাঁদি।
আমার কোমর কাঁকাল ভেঙে গেছে
লেচে লেচে ও দাদি।
আজ লাচনের লেগেছে গাঁদি॥
মাদলের বোল : হুর্র্ হুর্রে দাদা, দাদারে দাদা!
তিন দাদা পুত নাতিন নাচে
দাদারে দাদা!
নাতিন নাচে পুতিন নাচে
সতিন নাচে শ্যাওড়া গাছে দাদারে দাদা!
তিন দাদা পুত নাতিন নাচে॥
বড়কি নাচে ছুটকি নাচে
মুটকি নাচে ধাতিং তিং,
শুঁটকি নাচে থুপি নাচে
নাচে সাথে আহ্লাদি।
আজ লাচনের লেগেছে গাঁদি॥
মাদলের বোল : ও গিজে, মুড়কি ভিজে!
ও গিজে রেল ঠুকে দে!
শিরীষের বাগান-ধারে
হাত বাড়ালে পয়সা পড়ে!
ওরে আমার ফকির চাঁদ
গাই দুয়োব বাছুর বাঁধ॥
বুড়ি নাচে ভুঁড়ি নাচে নাচে ছোঁড়াছুঁড়ি গো,
গোদা পায়ে ঘুঙুর বাঁধে নাচিছে খাঁদা-খাঁদি।
আজ লাচনের লেগেছে গাঁদি॥
মাদলের বোল : ও গিজে যাসনে ভিজে,
ও গিজে ঠানদিদি যে!
সাবাস বেটি বকন-ছা
কলামোচায় ফড়িং খা।
ও গিজে তাল ভটাভট!
ও গিজাং ঘিচতা ঘিচাং ঘিচতা ঘিচাং!
ও গিজে যাচ্চলে যা বরিশাল্যা
পাবনা ঢাকা খুলন্যে জেলা!
তেহাই : পিঁয়াজ পিঁয়াজ রসুন খাক
যার পাঁঠা তার বাপের গোয়ালে যাক,
খাক কাঁকুড় খাক
তোর ছেলে তোর দাদার ছেলে॥
হুল্লোড় ধ্বনি : দে গোরুর গা ধুইয়ে!
আজও ফোটেনি কুঞ্জে মম কুসুম
জংলা খেমটা
আজও ফোটেনি কুঞ্জে মম কুসুম
ভোমরাকে যেতে বল।
সখী গুঞ্জরি ফেরে কেন কুঞ্জে
বৃথাই এত ছল॥
কত কী শুনিয়ে যায় গুনগুনিয়ে হায় –
পাতার ঝরোকায় ঘোরে সে অবিরল॥
আমার প্রাণের ভিতর কেন ওঠায় সে ঝড়,
তারে ফেরালে ফেরে না হাসে কেবল,
সে ফিরিয়া গেলে চোখে আসে জল।
এ কী হল দায় আঁখি নাহি চায়
না দেখিলে তায় প্রাণ পাগল॥
আজকে হোরি ও নাগরী
হোরি দাদরা
আজকে হোরি, ও নাগরী
ওগো গিন্নি ও ললিতে॥
ফাগের রাঙা জল ভরে দাও
ফরসি হুঁকোর পিচকিরিতে॥
গাজর বিট আর লাল বেগুনে
রাঁধবে শালগম তেলে নুনে,
রাঙা দেখে লঙ্কা দিয়ো
লাল নটে আর ফুল-কারিতে॥
গাইব গান দোল পৃর্ণিমাতে
মালোয়ারি জ্বর আসলে রাতে,
তুমি দোহার ধরবে সাথে,
গিঁটে বাতের গিটকিরিতে,
আমি লাল গামছা পরে যাব
লাল-বাজারে পায়চারিতে,
তুমি যাবে চিড়িয়াখানায়
এই মুখেতে গন্ডার মারিতে,
না হয় তুমি যাও বাপের বাড়ি
পাছু পাছু যাব আমি শ্বশুর-বাড়িতে॥
আজি নন্দদুলালের সাথে
খাম্বাজ-কাফি হোরি কাহারবা
আজি নন্দদুলালের সাথে
খেলে ব্রজনারী হোরি।
কুঙ্কুম আবির হাতে
দেখো, খেলে শ্যামল খেলে গোরী॥
থালে রাঙা ফাগ
নয়নে রাঙা রাগ,
ঝরিছে রাঙা সোহাগ
রাঙা পিচকারি ভরি॥
পলাশে শিমুলে ডালিম ফুলে
রঙনে অশোকে মরি মরি।
ফাগ-আবির ঝরে তরুলতা-চরাচরে,
খেলে কিশোর কিশোরী॥
চাঁদ রূপালি থালে জোছনা-আবির ঢালে
রঙে রাঙা চকোর চকোরী।
দোলন চাঁপার শাখে দোয়েলা শ্যামা ডাকে
আজি দোল-পূর্ণিমা স্মরি॥
আজি প্রথম মাধবী ফুটিল কুঞ্জে
কীর্তন
আজি প্রথম মাধবী ফুটিল কুঞ্জে
মাধব এল না সই।
এই যৌবন-বনমালা কারে দিব
মোর বনমালী বই॥
সারা নিশি জেগে বৃথাই নিরালা
গাঁথিলাম নব মালতীর মালা,
অনাদরে হায় সে মালা শুকায়
দেখিয়া কেমনে রই॥
মম অনুরাগ-চন্দন ঘষে,
লাজ ভুলে সাঁঝ হতে আছি বসে,
শুকাইয়া যায় চন্দন হায়
রাধিকা-রমণ কই॥
চলিলাম আমি যথা প্রাণ চায়,
প্রভাতে আসিলে মোর শ্যামরায়
বলিস আঁধারে হারাইয়া হায়
গেছে রাধা রসময়ী॥
আজি মিলন-বাসর প্রিয়া
দ্বৈত গান
পুরুষ॥ আজি মিলন-বাসর প্রিয়া
হেরো মধুমাধবী নিশা।
স্ত্রী॥ কত জনম-অভিসার শেষে
প্রিয় পেয়েছি তব দিশা॥
পু॥ সহকার-তরু হেরো দোলে
মালতী লতায় লয়ে বুকে,
স্ত্রী॥ মাধবী-কাঁকন পরি
দেওদার তরু দোলে সুখে।
উভয়ে॥ হায় প্রাণ কানায় কানায় আজি পুরে
হিয়া আবেশ-পুলক-মিশা॥
পু॥ শরাব-রঙের শাড়ি পরেছে চাঁদনি রাতি,
স্ত্রী॥ তারার রূপে গলে পড়ে গগনে চাঁদের বাতি,
পু॥ হল জোছনা-শিরাজি রঙিন
স্ত্রী॥ নীল আকাশের শিশা॥
পু॥ হেরো জোয়ার-উতলা সিন্ধু পূর্ণিমা চাঁদেরে পেয়ে,
স্ত্রী॥ কোন দূর অতীত স্মৃতি মম প্রাণে-মনে ওঠে ছেয়ে।
উভয়ে॥ মিলন-ঘন-মেঘলোকে আজি মিটিবে মরু-তৃষা॥
আনন্দ-দুলালি ব্রজবালার সনে
হোরি কাহারবা
আনন্দ-দুলালি ব্রজবালার সনে
নন্দদুলাল খেলে হোলি!
রঙের মাতন লেগে যেন শ্যামল মেঘে
খেলিছে রাঙা বিজলি॥
রাঙা মুঠি-ভরা রাঙা আবির-রেণু
রাঙিল পীত-ধড়া শিখী-পাখা বেণু
রাঙিল শাড়ি কাঁচলি॥
লচকিয়া আসে মুচকিয়া হাসে
মারে আবির পিচকারি,
চাঁদের হাট তোরা দেখে যা রে দেখে যা
রঙে মাতোয়ালা নর-নারী!
শিরায় শিরায় সুরার শিহরণ
রঙ্গে অঙ্গে পড়ে ঢলি॥
আবু আর হাবু দুই ভায়ে ভায়ে সদাই ভীষণ দ্বন্দ্ব
আবু আর হাবু দুই ভায়ে ভায়ে সদাই ভীষণ দ্বন্দ্ব।
বোঝালে বোঝে না, এক ভাই কানা আর এক ভাই অন্ধ॥
হাবু বলে, ‘আবু, বিশ্রী দেখায় শিগগির চাঁছো দাড়ি!’
আবু বলে, ‘দাদা, পেঁয়াজের ঝাড় ওই টিকি কাটো তাড়াতাড়ি!’
টিকি ও দাড়িতে চুলোচুলি বাধে ট্রাম বাস হয় বন্ধ॥
হাবু বলে, ‘আবু, তোর কী তাহাতে, বাঁচুক মরুক তুর্কি
বেঁচে থাক তুই আর বেঁচে থাক তোর দরগার মুরগি!’
আবু বলে, ‘দাদা, মুরগি বাঁচাতে ছুটি যে সমরকন্দ’॥
হাবু বলে, ‘আবু, কাছা দে শিগগির!’ আবু বলে, ‘ছাড় গামছা!’
হাবু আনে ছুটে খুন্তি, আবু উঁচাইয়া ধরে চামচা।
হাবু সে দেখায় জুজুৎসু প্যাঁচ, আবু মোহরমি ছন্দ॥
হাবু বলে, ‘আবু, পাঁঠার আমার মেরেছিস তুই জাত,
খোদার খাসি যে করেছিস তারে, দেব অভিসম্পাত?’
আবু বলে, ‘দাদা, মারিনি তো জাত, মেরেছি বোঁটকা গন্ধ’ ॥
আবু আসে তেড়ে লুঙি তুলে, হাবু বাগাইয়া ধরে কোঁচা,
আবু বের করে ছোরাছুরি, হাবু দেখায় বাঁশের খোঁচা।
হাবু বলে, ‘দেব ভুঁড়ি চাপা,’ আবু দেখায় অর্ধচন্দ্র॥
টিকি আর দাড়ি ছেড়ে আড়াআড়ি সহসা হইল দোস্ত,
আবু খায় কিনে গোস্ত কাবাব, হাবু খায় বড়ি পোস্ত,
আবু যায় চলে কাঁকিনাড়া, হাবু চলে যায় গোয়ালন্দ॥
গোঁড়া ও পাতি
আমার-দেওয়া ব্যথা ভোলো
জৌনপুরী-টোড়ি একতালা
আমার-দেওয়া ব্যথা ভোলো
আজ যে যাবার সময় হল॥
নিববে যখন আমার বাতি
আসবে তোমার নূতন সাথি,
আমার কথা তারে বোলো॥
ব্যথা দেওয়ার কী যে ব্যথা
জানি আমি, জানে দেবতা।
জানিলে না কী অভিমান
করেছে হায় আমায় পাষাণ,
দাও যেতে দাও, দুয়ার খোলো॥
আমি যেদিন রইব না গো লইব চির-বিদায়
আশাবরি লাউনি
আমি যেদিন রইব না গো
লইব চির-বিদায়
চিরতরে স্মৃতি আমার
জানি মুছে যাবে হায়॥
আরশিতে তার ছায়া পড়ে
রয় যবে সে সুমুখে,
সে যবে যায় দূরে চলে
অমনি ছবি মিলায়॥
এই ধরণির খেলাঘরে
মনে রাখে কে কারে,
দুলে সাগর চাঁদ-সো্হাগে
মরু মরে পিপাসায়॥
রবি যবে ওঠে নভে
চাঁদে কে মনে রাখে
এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে
মানুষের মন নদীর প্রায়॥
মোর সমাধির বুকে প্রিয়
উঠবে তোমার বাসরঘর,
হায়, অসহায় ভিখারি-মন
কাঁদে তবু সেই ব্যথায়॥
উচাটন মন ঘরে রয় না পিয়া মোর
গারা খাম্বাজ দাদরা
উচাটন মন ঘরে রয় না পিয়া মোর।
ডাকে পথে বাঁকা তব নয়না পিয়া মোর॥
ত্যজিয়া লোক-লাজ
সুখ-সাধ গৃহ-কাজ –
নিজ গৃহে বনবাস সয় না পিয়া মোর॥
লইয়া স্মৃতির লেখা
কত আর কাঁদি একা,
ফুল গেলে কাঁটা কেন যায় না পিয়া মোর॥
এ কোথায় আসিলে হায়
কাফি-মিশ্র কাহারবা
এ কোথায় আসিলে হায়, তৃষিত ভিখারি।
হায়, পথ-ভোলা পথিক, হায়, মৃগ মরুচারী॥
মোর ব্যথায় চরণ ফেলে
চির-দেবতা কি এলে,
হায়, শুকায়েছে যবে মোর নয়নে নয়ন-বারি॥
তোমার আসার পথে প্রিয়
ছিলাম যবে পরান পাতি,
সেদিন যদি আসিতে নাথ
হইতে ব্যথার ব্যথী।
ধোয়ায়ে নয়ন-জলে
পা মুছাতাম আকুল কেশে,
আজ কেন দিন-শেষে
এলে নাথ মলিন বেশে!
হায়, বুকে লয়ে ব্যথা আসিলে ব্যথাহারী॥
স্মৃতির যে শুকানো মালা যতনে রেখেছি তুলি
ছুঁয়ে সে হার ঝরায়ো না ম্লান তার কুসুমগুলি।
হায়, জ্বলুক বুকে চিতা, তায় ঢেলো না আর বারি॥
এ ঘোর শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে
কাজরি কাহারবা
এ ঘোর শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে।
হায়, রহি রহি সেই পড়িছে মনে॥
বিজলিতে সেই আঁখি
চমকিছে থাকি থাকি,
শিহরিত এমনই সে বাহু-বাঁধনে॥
কদম-কেশরে ঝরে তারই স্মৃতি,
ঝরঝর বারি যেন তারই গীতি।
হায় অভিমানী হায় পথচারী,
ফিরে এসো ফিরে এসো তব ভবনে॥
শনশন বহে বায় সে কোথায় সে কোথায়
নাই নাই ধ্বনি শুনি উতল পবনে হায়,
চরাচর দুলিছে অসীম রোদনে॥
এল ফুলের মহলে ভোমরা গুনগুনিয়ে
সিন্ধু মিশ্র খেমটা
এল ফুলের মহলে ভোমরা গুনগুনিয়ে।
ও-সে কুঁড়ির কানে কানে কী কথা যায় শুনিয়ে॥
জামের ডালে কোকিল কৌতুহলে,
আড়ি পাতি ডাকে কূ কূ বলে
হাওয়ায় ঝরা পাতার নূপুর বাজে রুনুঝুনিয়ে॥
‘ধীরে সখা ধীরে’ – কয় লতা দুলে,
‘জাগিয়ো না কুঁড়িরে, কাঁচা ঘুমে তুলে, –
গেয়ো না গুন গুন গুন গুন সুরে
প্রেমে ঢুলে ঢুলে।’
নিলাজ ভোমরা বলে, ‘না-না-না-না’-
–ফুল দুলিয়ে॥
এলে কে গো চিরসাথি অবেলাতে
বেহাগ-খাম্বাজ দাদরা
এলে কে গো চিরসাথি অবেলাতে।
যবে ঝুরিছে সন্ধ্যামণি আঙিনাতে॥
রোদের দাহে এলে স্নিগ্ধ-বাস ফুলরেণু
নিঝুম প্রাণে এলে বাজায়ে ব্যাকুল বেণু,
চাঁদের তিলক এলে আঁধার রাতে॥
ফুল ঝরার বেলা এলে কি শেষ অতিথি,
কাঁদে হা হা স্বরে রিক্ত কানন-বীথি।
এলে কোন মরুভূমে পিয়াসি দয়িত মোর,
শুক্লাতিথির শেষে কাঁদিতে এলে চকোর।
আসিলে জীবন-সাঁঝে ঘুম ভাঙাতে॥
এসো নূপুর বাজাইয়া যমুনা নাচাইয়া
পাহাড়ি মিশ্র কাহারবা
এসো নূপুর বাজাইয়া যমুনা নাচাইয়া
কৃষ্ণ কানাইয়া হরি।
মাখি গোখুর-ধূলিরেণু গোঠে চরাইয়া ধেনু
বাজায়ে বাঁশের বাঁশরি॥
গোপী-চন্দনচর্চিত অঙ্গে
প্রাণ মাতাইয়া প্রেম-তরঙ্গে,
বামে হেলায়ে ময়ূর-পাখা দুলায়ে তমাল-শাখা
নীপবনে দাঁড়ায়ে ত্রিভঙ্গে।
এসো লয়ে সেই শ্যামশোভা ব্রজবধূ মনোলোভা
সেই পীতবসন পরি॥
এসো গগনে ফেলি নীল ছায়া,
আনো পিপাসিত চোখে মেঘমায়া।
এসো মাধব, মাধবীতলে,
এসো বনমালী বনমালা গলে,
এসো ভক্তিতে প্রেমে আঁখি-জলে।
এসো তিলকলাঞ্ছিত সুরনরবাঞ্ছিত
বামে লয়ে রাইকিশোরী॥
এসো শারদ প্রাতের পথিক
সিন্ধু কাফি দাদরা
এসো শারদ প্রাতের পথিক
এসো শিউলি-বিছানো পথে।
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে
এসো অরুণ-কিরণ-রথে॥
দলি শাপলা শালুক শতদল
এসো রাঙায়ে তোমার পদতল,
নীল লাবণি ঝরায়ে ঢলঢল
এসো অরণ্য-পর্বতে॥
এসো ভাদরের ভরা নদীতে ভাসায়ে
কেতকী পাতার তরণি
এসো বলাকার রং পালক কুড়ায়ে
বাহি ছায়াপথ-সরণি।
শ্যাম শস্যে কুসুমে হাসিয়া
এসো হিমেল হাওয়ায় ভাসিয়া,
এসো ধরণিরে ভালোবাসিয়া
দূর নন্দন-তীর হতে॥
ও তুই যাসনে রাইকিশোরী কদমতলাতে
ঝুমুর খেমটা
ও তুই যাসনে রাইকিশোরী কদমতলাতে।
সেথা ধরবে বসন-চোরা ভূতে
পারবিনে আর পালাতে।
— কদমতলাতে॥
সে ধরলে কি আর রক্ষে আছে,
তোর বসন গিয়ে উঠবে গাছে,
ওলো গোবর্ধন-গিরিধারী সে
পারবিনে তায় টলাতে।
দেখতে পেলে ব্রজবালা,
ঘট কেড়ে সে ঘটায় জ্বালা,
ওলো নিজেই গলে জল হবি তুই
পারবিনে তায় গলাতে।
ঠেলে ফেলে অগাধ-নীরে
সে হাসে লো দাঁড়িয়ে তীরে,
শেষেভাসিয়ে নিয়ে প্রেম-সাগরে
ওলো দোলায় নাগরদোলাতে।
ওরে হুলোরে তুই রাতবিরেতে ঢুকিসনে হেঁশেল
পিলু-সাহানা কাহারবা
ওরে হুলোরে তুই রাতবিরেতে ঢুকিসনে হেঁশেল।
কবে বেঘোরে প্রাণ হারাবি বুঝিসনে রাসকেল॥
স্বীকার করি শিকারি তুই গোঁফ দেখেই চিনি,
গাছে কাঁঠাল ঝুলতে দেখে দিস গোঁফে তুই তেল॥
ওরে ছোঁচা ওরে ওঁছা বাড়ি বাড়ি তুই হাঁড়ি খাস,
নাদনার বাড়ি খেয়ে কোনদিন ধনে প্রাণে বা মারা যাস,
কেঁদে মিয়াঁও মিয়াঁও বলে বিবি বেড়ালি
করবে রে হার্টফেল॥
তানপুরারই সুরে যখন তখন গলা সাধিস,
শুনে ভুলো তোরে তেড়ে আসে, তুই ন্যাজ তুলে ছুটিস,
তোরে বস্তায় পুরে কবে কে চালান দিবে ধাপা-মেল॥
বউ ঝি যখন মাছ কোটে রে, তুমি খোঁজ দাঁও,
বিড়াল-তপস্বী, আড়নয়নে থালার পানে চাও,
তুই উত্তম-মধ্যম খাস এত তবু হল না আক্কেল॥
কত জনম যাবে তোমার বিরহে
ভৈরবী দাদরা
কত জনম যাবে তোমার বিরহে।
স্মৃতির জ্বালা পরান দহে॥
শূন্য গেহ মোর শূন্য জীবনে,
একা থাকারই ব্যথা আর কত সহে (ওগো)
স্মৃতির জ্বালা পরান দহে॥
দিয়াছে যে জ্বালা জীবন ভরি হায়
গলি নয়ন-ধারাতে ব্যথা বহে
স্মৃতির জ্বালা পরান দহে॥
কুল রাখ না-রাখ তুমি সে জান
পিলু খেমটা
কুল রাখ না-রাখ
তুমি সে জান,
গোকুলে তোমার কাজ
কুল ভোলানো॥
মহতের পিরিতি
বালির বাঁধসম,
কভু হাতে দাও দড়ি
কভু চাঁদ আন॥
কভু তুমি রাধার, চন্দ্রাবলীর কভু,
যখন যার তখন তার দিকে টান॥
রাজার অপরাধের নালিশ কোথায় করি,
তুমি জান শুধু বাঁশিতে মন-ভেজানো॥
গত রজনির কথা পড়ে মনে
পিলু – মিশ্র দাদরা
গত রজনির কথা পড়ে মনে
রজনিগন্ধার মদির গন্ধে।
এই সে ফুলেরই মোহন-মালিকা
জড়ায়েছিল সে কবরী-বন্ধে॥
বাহুর বল্লরি জড়ায়ে তার গলে
আধেক আঁচলে বসেছি তরুতলে,
দুলেছে হৃদয় ব্যাকুল ছন্দে॥
মুখরা ‘বউ কথা কও’ ডেকেছে বকুল-ডালে,
লাজে ফুটেছে লালি গোলাপকুঁড়ির গালে।
কপোলের কলঙ্ক মোর মেটেনি আজও যে সই
জাগিছে তারই স্মৃতি চাঁদের কপোলে ওই।
কাঁদিছে নন্দন আজি নিরানন্দে॥
গান গাহে মিসি বাবা শুনিয়া শুধায় হাবা
পেগ্যান সংগীত
গান গাহে মিসি বাবা শুনিয়া শুধায় হাবা
খুকি কাঁদে কেন বাবা, ফোড়া কি কাটিছে ওর?
হাসিয়া কহেন পিসি ও দেশেতে শীত বেশি
তাই কাঁদে বাবা মিসি হিহি হিহি হিহি হো –
কিবে গিলে-করা গলা ঢেউ-তোলা আট-পলা,
খায় রোজ এক তোলা স্ক্রু-ভেজানো জল।
সাথে গায়ে হেঁড়ে-গলা ধলীর সহিত ধলা,
কাঁপে বাড়ি তিন-তলা থরহরি টলমল॥
গিন্নির ভাই পালিয়ে গেছে গিন্নি চটে কাঁই
গিন্নির ভাই পালিয়ে গেছে গিন্নি চটে কাঁই।
আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কাঁদিছেন সদাই॥
কোথায় শালা, শালা কোথায়, কেবল ভদ্রলোক,
ডাকতে গিয়ে জিভ কেটে ভাই ফিরিয়ে নি চোখ!
ভ্যালা ফ্যাসাদ হল দাদা, শালায় কোথায় পাই॥
খুঁজতে খুঁজতে দেখতে পেলুম সম্মুখে আট-শালা,
আটশালাতে মোর শালা নাই বসেছে পাঠ-শালা,
গো-শালাতে গোরু বাঁধা, আমার শালা নাই॥
খুঁজতে গেলুম শহর, দেখি শালার ছড়াছড়ি;
পান-শালাতে পান করে যায় মাতাল গড়াগড়ি,
ধর্ম-শালা অতিথ-শালা শালার অন্ত নাই॥
হাতি-শালা ঘোড়া-শালা রাজার ডাইনে বাঁয়ে,
হঠাৎ দেখি যাচ্চে বাবু দো-শালা গায়ে,
দো-শালা তো চাইনে বাবা, এক শালাকে চাই॥
দশ-শালা ব্যবস্থা ঝুলে গরিব চাষার ভাগ্যে,
দিয়া-শালাই পেয়ে ভাবি, শালাই পেলাম, যাকগে!
চাইনু শালা, মুদি দিল গরম মশালাই॥
ঢেঁকি-শালায় ঢেঁকি শুয়ে পাক-শালাতে ছাই,
হায় শালায় কোথায় পাই॥
শালানুসন্ধিৎসু
গুঞ্জামালা গলে কুঞ্জে এসো হে কালা
মালগুঞ্জ ত্রিতাল
গুঞ্জামালা গলে কুঞ্জে এসো হে কালা।
বনমালী এসো দুলায়ে বনমালা॥
তব পথে বকুল ঝরিছে উতল বায়ে,
দলিয়া যাবে বলে অকরুণ-রাঙা পায়ে,
রচেছি আসন তরুণ তমাল-ছায়ে,
পলাশ শিমুলে রাঙা প্রদীপ-জ্বালা॥
ময়ূরে নাচাও তুমি তোমারই নূপুর-তালে,
বেঁধেছি ঝুলনিয়া ফুলেল কদমডালে,
তোমা বিনা বনমালী বিফল এ ফুল-দোল,
বাঁশি বাজাবে কবে উতলা ব্রজবালা॥
গোধূলির রং ছড়ালে কে গো আমার সাঁঝ-গগনে
মাঢ়-খাম্বাজ-মিশ্র দাদরা
গোধূলির রং ছড়ালে কে গো আমার সাঁঝ-গগনে।
বিবাহের বাজল বাঁশি আজি বিদায়ের লগনে॥
নূতন করে আবার বাঁচিবার সাধ জাগে,
সুন্দর লাগে ধরা নিবু-নিবু মোর নয়নে॥
এতদিন কেঁদে কাঁদে ডেকেছি নিঠুর মরণে,
আজি যে কাঁদি বঁধু বাঁচিতে হায় তোমার সনে॥
আজি এ ঝরা ফুলের অঞ্জলি কি নিতে এলে,
সহসা পুরবি সুর বেজে উঠিল ইমনে॥
হইল ধন্য প্রিয় মরণ-তীর্থ মম,
সুন্দর মৃত্যু এলে বরের বেশে শেষ জীবনে॥
ঘুমায়েছে ফুল পথের ধুলায়
দেশ কাওয়ালি
ঘুমায়েছে ফুল পথের ধুলায়, (ওগো)
জাগিয়ো না উহারে ঘুমাইতে দাও।
বনের পাখি ধীরে গাহো গান,
দখিনা হাওয়া ধীরে ধীরে বয়ে যাও॥
এখনও শুকায়নি চোখে তার জল,
এখনও অধরে হাসি ছলছল;
প্রভাত-রবি শুকায়ো না তায়,
ধীরে কিরণে তাহারই নয়নে চাও॥
সামলে পথিক ফেলিয়ো চরণ –
ঝরেছে হেথায় ফুলের জীবন,
ভুলিয়া দোলো না ঝরা পাতাগুলি –
ফুল-সমাধি থাকিতে পারে হেথাও॥
চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়
আরবি (নৃত্যের) সুর কাহারবা
চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়
পল্লিবালিকা বন-পথে যায়।
একেলা বন-পথে যায়॥
শাড়ি তার কাঁটা-লতায়,
জড়িয়ে জড়িয়ে যায়,
পাগল হাওয়াতে অঞ্চল লয়ে মাতে –
যেন তার তনুর পরশ চায়॥
শিরীষের পাতায় নূপুর,
বাজে তার ঝুমুর ঝুমুর,
কুসুম ঝরিয়া মরিতে চাহে তার কবরীতে,
পাখি গায় পাতার ঝরোকায়॥
চাহি তার ওই নয়নে
হরিণী লুকায় বনে,
হাতে তার কাঁকন হতে মাধবী লতা কাঁদে,
ভ্রমরা কুন্তলে লুকায়॥
চাঁদের পিয়ালাতে আজি
বাগেশ্রী কাওয়ালি
চাঁদের পিয়ালাতে আজি
জোছনা-শিরাজি ঝরে।
ঝিমায় নেশায় নিশীথিনী
সে শরাব পান করে॥
সবুজ বনের জলসাতে
তৃণের গালিচা পাতে,
উতল হাওয়া বিলায় আতর
চাঁপার আতরদানি ভরে॥
সাদা মেঘের গোলাব-পাশে
ঝরিছে গোলাব-পানি,
রজনিগন্ধার গেলাসে
রজনি দেয় সুরা আনি।
কোয়েলিয়া কুহুকুহু,
গাহে গজল মুহুমুহু,
সুরের নেশা সুরার নেশা
লাগে আজি চরাচরে॥
চায়ের পিয়াসি পিপাসিত চিত আমরা চাতক-দল
চায়ের পিয়াসি পিপাসিত চিত আমরা চাতক-দল।
দেবতারা কন সোমরস যারে সে এই গরম জল।
চায়ের প্রসাদে চার্বাক ঋষি বাক-রণে হল পাশ,
চা নাহি পেয়ে চার-পেয়ে জীব চর্বণ করে ঘাস।
লাখ কাপ চা খাইয়া চালাক
হয়, সে প্রমাণ চাও কত লাখ?
মাতালের দাদা আমরা চাতাল, বাচাল বলিস বল॥
চায়ের নামে যে সাড়া নাহি দেয় চাষাড়ে তাহারে কও,
চায়ে যে ‘কু’ বলে চাকু দিয়ে তার নাসিকা কাটিয়া লও।
যত পায় তত চায় বলে তাই
চা নাম হল এ সুধার ভাই।
চায়ের আদর করিতে হইল দেশে চাদরের চল॥
চা চেয়ে চেয়ে কাকা নাম ভুলে পশ্চিমে চাচা কয়,
এমন চায়ে যে মারিতে চাহে সে চামার সুনিশ্চয়।
চা করে করে ভৃত্য নফর
নাম হারাইয়া হইল চাকর,
চা নাহি খেয়ে বেচারা নাচার হয়েছে চাষা সকল॥
চায়ে এলে যায় চাল-কুমড়ো সে, চাঁদা করে মারো চাঁটি,
চা না খাইয়া চানা খায় আজ দেখহ অশ্ব-জাতি।
একদা মায়ের মুণ্ডেতে শিব
চা ঢেলে দেন, বের করে জিভ
চা-মুণ্ডা রূপ ধরিলেন দেবী সেইদিন রে পাগল॥
চায়ে পা ঠেকিয়ে সেদিন গদাই পড়িল মোটর চাপা,
চাঁট ও চাটনি চায়েরই নাতনি, লুকাতে পারো কি বাপা?
চায়ে সর বলে গালি দিয়ে মাসি
চামর ঢুলায় হয়ে আজ দাসী,
চাটিম চাটিম বুলি এই দাদা চায়ের নেশারই ফল॥
চা-স্তোত্র
চিরকিশোর মুরলীধর কুঞ্জবনচারী
সুরট মিশ্র ঝাঁপতাল
চিরকিশোর মুরলীধর কুঞ্জবনচারী
গোপনারী-মনোহারী বামে রাধা প্যারি॥
শোভে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম করে,
গোষ্ঠবিহারী কভু, কভু দানবারি॥
তমালতলে কভু কভু নীপবনে
লুকোচুরি খেল হরি ব্রজবধূ সনে
মধুকৈটভারি কংস-বিনাশন,
কভু কণ্ঠে গীতা, শিখীপাখাধারী॥
ছন্দের বন্যা হরিণী অরণ্যা
ইমন মিশ্র কাওয়ালি
ছন্দের বন্যা হরিণী অরণ্যা
নাচে গিরিকন্যা চঞ্চল ঝরনা।
নন্দনপথ-ভোলা চন্দনবর্ণা॥
গাহে গান ছায়ানটে,
পর্বতে শিলাতটে,
লুটায়ে পড়ে তীরে
শ্যামল ওড়না॥
ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ধীরিধীরি বাজে
তরঙ্গ-নূপুর বনপথ-মাঝে।
এঁকেবেঁকে নেচে যায় সর্পিল ভঙ্গে
কুরঙ্গ সঙ্গে অপরূপ রঙ্গে,
গুরুগুরু বাজে তাল মেঘমৃদঙ্গে
তরলিত জোছনা বালিকা অপর্ণা॥
ছাড়ো ছাড়ো আঁচল বঁধু
পিলু – কাহারবা
ছাড়ো ছাড়ো আঁচল, বঁধু,
যেতে দাও।
বনমালী, এমনি করে মন ভোলাও॥
একা পথে দুপুরবেলা
নিরদয়, এ কী খেলা।
তুমি এমনি করে মায়াজাল বিছাও।
পথে দিয়ে বাধা
এ কী প্রেম সাধা,
আমি নহি তো রাধা, বঁধু, ফিরে যাও॥
নিখিল নর-নারী
তোমার প্রেম-ভিখারি
লীলা বুঝিতে নারি তব শ্যামরাও॥
জাগো জাগো জাগো নব আলোকে
টোড়ি কাওয়ালি
জাগো জাগো! জাগো নব আলোকে
জ্ঞান-দীপ্ত চোখে
ডাকে উষসী আলো।
জাগে আঁধার-সীমায় রবি রাঙা মহিমায়,
গাহে প্রভাত-পাখি হেরো নিশি পোহাল॥
জাগো ঊর্ধ্বে ধরার শিশু স্বপ্ন-আতুর,
নব বিস্ময়-লোকে জাগো সৃজন-বিধুর!
রাঙা গোধুলিবেলা রচো ধূলির ধোঁয়ায়,
আনো কল্প-মায়া, নাশো গহন কালো॥
জাগো জাগো, রে মুসাফির
ভৈরবী কাহারবা
জাগো জাগো, রে মুসাফির
হয়ে আসে নিশিভোর।
ডাকে সুদূর পথের বাঁশি
ছাড় মুসাফিরখানা তোর॥
অস্ত-আকাশ-অলিন্দে ওই পান্ডুর কপোল রাখি
কাঁদে মলিন ভোরের শশী, বিদায় দাও বন্ধু চকোর॥
পেয়েছিলি আশ্রয় শুধু, পাসনি হেথায় স্নেহ-নীড়,
হেথায় শুধু বাজে বাঁশি উদাস সুরে ভৈরবীর।
তবু কেন যাবার বেলা ঝরে রে তোর নয়নলোর॥
মরুচারী, খুঁজিস সলিল অগ্নিগিরির কাছে হায়,
খুঁজিস অমর ভালোবাসা এই ধরণির এই ধুলায়।
দারুণ রোদের দাহে খুঁজিস কুঞ্জছায়া স্বপ্নঘোর॥
জাগো যোগমায়া জাগো মৃন্ময়ী
যোগিয়া একতালা
জাগো যোগমায়া জাগো মৃন্ময়ী,
চিন্ময়ী রূপে জাগো।
তব কনিষ্ঠা কন্যা ধরণি
কাঁদে আর ডাকে ‘মা গো’ ॥
বরষ বরষ বৃথা কেঁদে যাই,
বৃথাই মা তোর আগমনি গাই,
সেই কবে মা আসিলি ত্রেতায়
আর আসিলি না গো॥
কোটি নয়নের নীল পদ্ম মা
ছিঁড়িয়া দিলাম চরণে তোর,
জাগিলিনে তুই, এলিনে ধরায়,
মা কবে হয় হেন কঠোর॥
দশ ভুজে দশ প্রহরণ ধরি
আয় মা দশ দিক আলো করি,
দশ হাতে আন কল্যাণ ভরি
নিশীথ-শেষে উষা গো॥
তুমি নন্দনপথ-ভোলা
পিলু – কাফি কাহারবা
তুমি নন্দনপথ-ভোলা
মন্দাকিনী-ধারা উতরোলা॥
তোমার প্রানের পরশ লেগে
কুঁড়ির বুকে মধু উঠিল জেগে,
দোলন-চাঁপাতে লাগে দোলা॥
তোমারে হেরিয়া পুলকে ওঠে ডাকি
বকুলবনের ঘুমহারা পাখি,
ধরার চাঁদ তুমি চির-উতলা॥
তোমার ফুলের মতন মন
আশাবরি দাদরা
তোমার ফুলের মতন মন।
ফুলের মতো সইতে নারে
একটু অযতন॥
ভুল করে এই কঠিন ধরায়
তুমি কেন আসিলে হায়,
একটি রাতের তরে হেথায়
ফুলের জীবন॥
গাঁথবে মালা পরবে গলায়
অর্ঘ্য দেবে দেবতা-পায়,
ফেলে দেবে পথের ধূলায়
মিটলে প্রয়োজন॥
তোমার সৃষ্টি-মাঝে হরি
ভৈরবী দাদরা
তোমার সৃষ্টি-মাঝে হরি
হেরিতে যে নিতি পাই তোমায়।
তোমার রূপের আবছায়া ভাসে
গগনে, সাগরে, তরুলতায়॥
চন্দ্রে তোমার মধুর হাস,
সূর্যে তোমার জ্যোতি প্রকাশ,
করুণা-সিন্ধু, তব আভাস
বারিবিন্দুতে হিমকণায়॥
ফোটা ফুলে হরি, তোমার তনুর
গোপীচন্দন-গন্ধ পাই,
হাওয়ায় তোমার স্নেহের পরশ,
অন্নে তোমার প্রসাদ খাই,
রাসবিহারী! তোমার রূপ দোলে
দুঃখ শোকের হিন্দোলে,
তুমি, ঠাঁই দাও যবে ধরো কোলে,
মোর বন্ধু-স্বজন কেঁদে ভাসায়॥
তোমারে কী দিয়া পূজি ভগবান
জৌনপুরী মিশ্র আদ্ধা কাওয়ালি
তোমারে কী দিয়া পূজি ভগবান।
আমার বলে কিছু নাহি হরি
সকলই তোমারই যে দান॥
মন্দিরে তুমি, মুরতিতে তুমি
পূজার ফুলে তুমি, স্তব-গীতে তুমি,
ভগবান দিয়ে ভগবান পূজা
করিতে – তুমি যদি ভাব অপমান॥
কেমন তব রূপ দেখিনি হরি,
আপন মন দিয়ে তোমারে গড়ি,
হাস না কাঁদ তুমি সে রূপ হেরি,
বুঝিতে পারি না – তাই কাঁদে প্রাণ॥
কোটি রবি শশী আরতি করে যার
মৃৎ-প্রদীপ জ্বালি আমি দেউলে তার,
বন-ডালায় পূজা-কুসুমসম্ভার
যোগী মুনি করে যুগ যুগ ধ্যান।
কোথায় শ্রীমুখ তব কোথায় শ্রীচরণ,
চন্দন দিব কোনখান॥
দাও দাও দরশন পদ্মপলাশলোচন
ভৈরবী কাওয়ালি
দাও দাও দরশন পদ্মপলাশলোচন
কেঁদে দু-নয়ন হল অন্ধ।
আকাশ-বাতাস-ঘেরা তব ও মন্দির-বেড়া
আর কতকাল রবে বন্ধ॥
পাখি যেমন সন্ধ্যাকালে বন্ধু-স্বজন পালে পালে
উড়ে এসে বসেছিল ডালে হে,
রাত পোহালে একে একে উড়ে গেল দিগ্বিদিকে,
পড়ে আছি একা নিরানন্দ।
টুটিল বাঁধন মায়ার, কবে শুনিব এবার
ও রাঙা চরণ-নূপুর-ছন্দ॥
দুঃখ-শোক-রৌদ্রজলে ফেলে মোরে পলে পলে
ছলিতেছ হরি কত ছলে হে,
জীবনের বোঝা প্রভু বহিতে কি হবে তবু,
সহিতে পারি না আর দ্বন্দ্ব।
মরণের সোনার ছোঁয়ায় ডেকে লও ও রাঙা পায়
দেখাও এবার মুখচন্দ॥
দিয়ো ফুলদল বিছায়ে
বারোয়াঁ ঠুংরি
দিয়ো ফুলদল বিছায়ে
পথে বঁধুর আমার।
পায়ে পায়ে দলি ঝরা সে ফুলদল
আজি তার অভিসার॥
আমার আকুল অশ্রুবারি দিয়ে
চরণ দিয়ো তার ধোয়ায়ে,
মম পরান পুড়ায়ে জ্বেলো
দীপালি তাহার॥
দিয়ো ফুলদল বিছায়ে
বারোয়াঁ ঠুংরি
দিয়ো ফুলদল বিছায়ে
পথে বঁধুর আমার।
পায়ে পায়ে দলি ঝরা সে ফুলদল
আজি তার অভিসার॥
আমার আকুল অশ্রুবারি দিয়ে
চরণ দিয়ো তার ধোয়ায়ে,
মম পরান পুড়ায়ে জ্বেলো
দীপালি তাহার॥
দুঃখ ক্লেশ শোক পাপতাপ শত
সিন্ধু কাওয়ালি
দুঃখ ক্লেশ শোক পাপতাপ শত
শ্রান্তি মাঝে হরি শান্তি দাও দাও।
কান্ডারি হে আমার পার করো করো পার,
উত্তাল তরঙ্গ অশান্তি পারাবার,
অভাব দৈন্য শত হৃদি-ব্যথা-ক্ষত,
যাতনা সহিব কত প্রভু, কোলে তুলে নাও॥
হে দীনবন্ধু করুণাসিন্ধু,
অম্বরব্যাপী ঝরে তব কৃপা-বিন্দু,
মরুর মতন চেয়ে আছি নব ঘনশ্যাম –
আকুল তৃষ্ণা লয়ে, প্রভু, পিপাসা মিটাও॥
নখ-দন্তবিহীন চাকুরি-অধীন আমরা বাঙালি বাবু
নখ-দন্তবিহীন চাকুরি-অধীন আমরা বাঙালি বাবু।
পায়ে গোদ, গায়ে ম্যালেরিয়া,
বুকে কাশি লয়ে সদা কাবু॥
ঢিলে-ঢালা কাছা কোঁচা সামলায়ে,
ভুঁড়ি বয়ে ছুটি নিটপিটে পায়ে,
আপিসে কষিয়া কলম পিষিয়া
ঘরে এসে খাই সাবু॥
রবিবার ছুটি আছে বলে ভাই
বাবা বলে চিনে ছেলেপিলে তাই,
নাকে শাঁখ বেঁধে সেদিন ঘুমাই,
নয় ঘরে বসে খেলি গ্রাবু॥
হাঁচি টিকটিকি সিন্নি মানিয়া
পরান-পাখিরে রেখেছি ধরিয়া,
দেখে ব্যাঙের ছাতারে উঠি চমকিয়া
ভয় হয় বুঝি তাঁবু॥
এগজামিনের লাঠি ধরে ধরে
দাঁড়াই আসিয়া আপিসের দোরে,
মাইনে যা পাই তাই দিয়ে খাই
কদলী আর অলাবু॥
গোলামের কুঁড়ি ফোটার এ বোঝা
নামায়ে কোমর হতে দাও সোজা
বাতে আর হাড়-হাবাতে ধরেছে –
বাপ্পুরে কনে যাবু॥
বাঙালি বাবু
নবীন বসন্তের রানি তুমি
দ্বৈত গান
পুরুষ॥ নবীন বসন্তের রানি তুমি
গোলাপ-ফুলি ঢং॥
স্ত্রী॥ তব অনুরাগের রঙে
আমি উঠিয়াছি রেঙে
প্রিয় এই অপরূপ ঢং॥
পু॥ পলাশ কৃষ্ণচূড়ার কলি
রাঙা ও পায়ে এলে কি দলি?
স্ত্রী॥ বেয়ে প্রেমের পথের গলি
এলাম কঠোর হৃদয় দলি
মম পায়ে তাহারই রং॥
পু॥ হায়, হৃদয়-হীনা হৃদয়-সাথি হয় না সে জানি,
অবুঝ হৃদয় তবু চাহে তায় জানে সে পাষাণী।
স্ত্রী॥ ধরিয়া পায়ে প্রেম জানায়ে
যাও পলায়ে শেষে কাঁদায়ে।
পু॥ বায়ু কেঁদে যায় ফুল ঝরায়ে।
স্ত্রী॥ না না যাও যাও মন চেয়ো না
গন্ধ লহো ফুল চেয়ো না,
আছে কাঁটা ফুলের সঙ্গ॥
নমো নটনাথ এ নাট-দেউলে
ভজন
নমো নটনাথ! এ নাট-দেউলে
করো হে করো তব শুভ চরণপাত।
তোমার সংগীতে নৃত্য-ভঙ্গিতে
হউক হেথা নব জীবন সঞ্জাত॥
তব প্রসাদে দেব-দেব হে আদি কবি,
বাক-মুখর হল মূক এ ছায়াছবি,
আজি এ ছবিপটে
তব মহিমা রটে,
আলোছায়ায় দুলে স্বপন-রাঙা রাত॥
তব আশিসে হে মহেন্দ্র দিক আনি
অভিনব আশা প্রাণ এ রূপবাণী।
হৃদয়ে সকলের
দাও হে ঠাঁই এর,
আনুক এ রূপলোকে নবীন প্রভাত॥
নমো নম রাম-খুঁটি
নমো নম রাম-খুঁটি।
তুমি গাদিয়া বসেছ আমাদের বুকে, সাধ্য নাই যে উঠি॥
তুমি নির্বিকার হে পরম পুরুষ
আপনাতে আছ আপনি বেহুঁশ,
তব বাঁধন ছিঁড়িতে বৃথা টানাটানি
বৃথা মাথা কুটোকুটি॥
আইন কানুন আচার বিচার
বিধি ও নিষেধ স্ত্রী পরিবার,
শত রূপে তুমি জগৎ মাঝার
চাপিয়া আছ যে টুঁটি॥
কত রূপে তব লীলার প্রকাশ
কভু হও খুঁটো কভু হও বাঁশ,
কভু হাড়ি-কাঠ কভু ঘানি-গাছ
ঘোরাও ধরিয়া ঝুঁটি॥
কখনও পাঁচনিরূপে পিঠে পড়
কখনও জোয়ালরূপে কাঁধে চড়,
কখনও কঞ্চি বাঁশ চেয়ে দড়
কভু গুঁতো কভু লাঠি।
ঠুঁটো ত্রিভঙ্গ হে প্রভু তোমার
ভয়ে মোরা গুটিসুটি॥
রাম-খুঁটি
নাচিছে নটনাথ শংকর মহাকাল
মাঢ় মিশ্র কাওয়ালি
নাচিছে নটনাথ, শংকর মহাকাল।
লুটাইয়া পড়ে দিবারাত্রির বাঘছাল,
আলো-ছায়ার বাঘ-ছাল॥
ফেনাইয়া ওঠে নীলকণ্ঠের হলাহল,
ছিঁড়ে পড়ে দামিনী অগ্নি-নাগিনি দল,
দোলে ঈশান-মেঘে ধূর্জটি-জটাজাল॥
বিষম ছন্দে বোলে ডমরু নৃত্যবেগে,
ললাট-বহ্নি দোলে প্রলয়ানন্দে জেগে।
চরণ-আঘাত লেগে জাগে শ্মশানে কঙ্কাল॥
সে নৃত্য-ভঙ্গে গঙ্গা-তরঙ্গে
সংগীত দুলে ওঠে অপরূপ রঙ্গে,
নৃত্য-উছল জলে বাজে জলদ তাল॥
নৃত্যের ঘোরে ধ্যান-নিমীলিত ত্রিনয়ন
প্রলয়ের মাঝে হেরে নব সৃজন-স্বপন,
জ্যোৎস্না-আশিস ঝরে উছলিয়া শশী-থাল॥
নাচিয়া নাচিয়া এসো নন্দদুলাল
বেহাগ মিশ্র কাহারবা
নাচিয়া নাচিয়া এসো নন্দদুলাল।
মোর প্রাণে, মোর মনে এসো ব্রজগোপাল॥
এসো নূপুর-রুনুঝুনু পায়ে,
এসো প্রেম-যমুনা নাচায়ে,
এসো বেণু বাজায়ে এসো ধেনু চরায়ে
এসো কানাই রাখাল॥
ঝুলনে হোরিতে রাসে,
এসো কুরুক্ষেত্র-রণে, এসো প্রভাসে,
এসো শিশুরূপে, এসো কিশোর বেশে,
এসো কংস-অরি, এসো মৃত্যু করাল॥
এসো মহাভারতের দেবতা,
আনো নৃত্যের তালে নব বারতা,
এসো মধুকৈটভ-অরি আনো নব গীতা,
এসো নারায়ণ ভগবান বিশ্ব-ভূপাল॥
নাচে ওই আনন্দে নন্দদুলাল
খাম্বাজ কাহারবা
নাচে ওই আনন্দে নন্দদুলাল।
তাতা থই তাতা থই –
নাচে বৃন্দাবনে হরি ব্রজগোপাল॥
ছন্দ নামে, দক্ষিণে বামে,
টলে বাঁকা শিখীপাখা।
উছল যমুনাজলে বাজিছে তাল।
নাচে নন্দদুলাল॥
বিরাট খেলে হেরো আজ শিশুর রূপে,
স্বর্গে কাঙাল করি ধরায় এল চুপে চুপে।
এত রূপ কেমনে দেখি,
দিলে বিধি দুটি আঁখি
তাহে আবার পলক পড়ে;
বিশ্ব-পালক হল বালক রাখাল॥
নিয়ে কাদা মাটির তাল
ভোজপুরি — হোরি খচমচি
নিয়ে কাদা মাটির তাল
খেলে হোরি ভূতের পাল।
নর্দমা হতে ছিটায় কর্দম হরদম কাহার চাঁড়াল॥
দুই পাশের পথিকের গায়
কাদা ছিটিয়ে মোটর যায়,
নল দিয়ে ওই জল ছিটায়
ফুটপাথে উড়িয়া-দুলাল॥
খচমচ খচমচ বাজায় তাল
ভোজপুরি মাড়োয়ারি ভাই,
ঝি ফেলে দেয় ছাদ থেকে
গোবর-গোলা, আখার ছাই,
দেয় ঢেলে পিচদানির পিচ
কাপড়-চোপড় লালে লাল॥
ভুঁড়িতে ফুঁড়িছে ডাক্তার পিচকারি ওই
হোলি হ্যায়!
টক্কর খেয়ে উলটে পড়ে ময়লা গাড়ি –
হোলি হ্যায়!
ষাঁড়ের গুঁতোয় খানায় পড়ে
খেলে হোরি পাঁড় মাতাল॥
পরান হরিয়া ছিলে পাসরিয়া
দ্বৈত গান
পুরুষ॥ পরান হরিয়া ছিলে পাসরিয়া।
কেমনে লো প্রিয়া আনন্দে!
স্ত্রী॥ ছিনু কী যেন স্বপনে মগ্না
পু॥ আজি হবে কি এ কন্ঠ-লগ্না?
স্ত্রী॥ না, না।
পু॥ হায় ফুল ফুটবে না কি এ বসন্তে।
মালঞ্চে পাপিয়া উঠিছে ডাকিয়া,
বিরহী এ হিয়া উঠিছে কাঁপিয়া
হৃদয় চাপিয়া রেখো না আর,
খোলো গো মনের দ্বার!
স্ত্রী॥ মুখে আসে না বুকের ভাষা,
কেমনে জানাই ভালোবাসা?
পু॥ প্রেমের দরিয়া ওঠে উছলিয়া,
স্ত্রী॥ কে করে সে প্রেমের আশা।
পু॥ চাও?
স্ত্রী॥ যাও।
পলাশ ফুলের গেলাস ভরি
পিলু-মিশ্র কাহারবা
পলাশ ফুলের গেলাস ভরি
পিয়াব অমিয়া তোমারে প্রিয়া।
চাঁদিনি রাতের চাঁদোয়া-তলে
বুকের আঁচল দিব পাতিয়া॥
নয়ন-মণির মুকুরে তোমার
দুলিবে আমার সজল ছবি,
সবুজ ঘাসের শিশির ছানি
মুকুতা-মালিকা দিব গাঁথিয়া॥
ফিরোজা আকাশ আবেশে ঘুমায়,
দিঘির বুকে কমল ঘুমায়,
নীরব যখন পাখির কূজন
আমরা দুজন রব জাগিয়া॥
ছাতিম তরুর শীতল ছায়ায়
ঘুমাব মোরা প্রিয় ঘুম যদি পায়,
বনের শাখা ঢুলাবে পাখা,
ঝরিবে রাঙা ফুল কপোল চুমিয়া।
পলাশ ফুলের মউ পিয়ে ওই
শংকরা একতালা
পলাশ ফুলের মউ পিয়ে ওই
বউ-কথা-কও উঠল ডেকে।
শিস দিয়ে যায় উদাস হাওয়া
নেবুফুলের আতর মেখে॥
এমন পূর্ণচাঁদের রাতি
নেই গো সাথে জাগার সাথি,
ফুলহারা মোর কুঞ্জবীথি
কাঁটার স্মৃতি গেছে রেখে॥
শূন্য মনে একলা গুনি
কান্নাহাসির পান্না-চুনি,
বিদায়বেলার বাঁশি শুনি
আসছে ভেসে ওপার থেকে॥
পলাশ-মঞ্জরী পরায়ে দে লো মঞ্জুলিকা
রসিয়া [?] কাহারবা
পলাশ-মঞ্জরী পরায়ে দে লো মঞ্জুলিকা।
আজি রসিয়ার রাসে হব আমি নায়িকা লো
মঞ্জুলিকা॥
কৃষ্ণচূড়ার সাথে রঙ্গনে অশোকে
বুলাল রঙের মোহন তুলিকা লো
মঞ্জুলিকা॥
মাদার শিমুল ফুলে, রঙিন পতাকা দোলে,
জ্বলিছে মনে মনে আগুন শিখা লো
মঞ্জুলিকা॥
পিউ পিউ পিউ বোলে পাপিয়া
দেশ-মিশ্র আদ্ধা কাওয়ালি
পিউ পিউ পিউ বোলে পাপিয়া।
বুকে তারই পিয়ারে চাপিয়া।
বাতাবি নেবুর ফুলেলা কুঞ্জে
মাতাল সমীরণ প্রলাপ গুঞ্জে,
ফুলের মহলায় চাঁদিনি শিহরায়
নদীকূলে ঢেউ ওঠে ছাপিয়া॥
এমনই নেবুফুল এমনই মধুরাতে
পরাত বঁধু মোর বিনোদ-খোঁপাতে,
বাতায়নে পাখি করিত ডাকাডাকি,
মনে পড়ে তায় উঠি কাঁপিয়া॥
পিয়াসি প্রাণ তারে চায়
পিলু ঠুংরি
পিয়াসি প্রাণ তারে চায়,
এনে দে তায়।
জনম জনম বিরহী প্রাণ মম
সাথিহীন পাখি-সম কাঁদিয়া বেড়ায়।
চাঁদের দীপ জ্বালি খুঁজিছে আকাশ তারে
না পেয়ে তাহার দিশা কাঁদে সে বাদল-ধারে।
ঝরে আভিমানে ফুল তারে না-দেখতে পেয়ে,
বহে কাঁদন-নদী পাষাণ-গিরি বেয়ে।
আসিব বলে সে গেছে চলে
(আমি) আজও আছি বেঁচে তারই আশায়॥
ফিরিয়া এসো এসো হে ফিরে
দেশ কাওয়ালি
ফিরিয়া এসো এসো হে ফিরে,
বঁধু এ ঘোর বাদলে নারি থাকিতে একা।
হায় গগনে মনে আজই মেঘের ভিড়
যায় নয়নজলে মুছে কাজললেখা॥
ললাটে কর হানি কাঁদিছে আকাশ,
শ্বসিছে শনশন হুতাশ বাতাস,
তোমারই মতো ঝড় হানিছে দ্বারে কর,
খোঁজে বিজলি তোমারই পথ-রেখা॥
মেঘেরে শুধাই তুমি কোথায়,
কাঁদন আমার বাতাসে ডুবে যায়!
ঝড়ের নূপুর পরি রাঙা পায়,
মোর শ্যামল-সুন্দর দাও দেখা॥
ফিরে গেছে সই এসে
দাদরা ঠুংরি
ফিরে গেছে সই এসে (নন্দকুমার)
অভিমানে ডাকিনি হেসে (নন্দকুমার)
হানিয়া অবহেলা
এ কী হল জ্বালা,
ডাকি আজি তাহারেই
নয়ন-জলে ভেসে – (নন্দকুমার)॥
ফিরে ফিরে দ্বারে আসে যায় কে নিতি
ভৈরবী দাদরা
ফিরে ফিরে দ্বারে আসে যায় কে নিতি − ।
তার অধরে হাসি আর নয়নে প্রীতি॥
দোদুল তাহার কায়া ঘনায় চোখে মায়া
জেগে ওঠে দেখে তায় পুরানো স্মৃতি॥
তাহার চরণ-পাতে তাহার সাথে সাথে,
আসে আঁধার রাতে শুক্লা চাঁদের তিথি॥
গেলে মন দিতে চাহে না সে নিতে,
ধরিতে গেলে চোখে সে কী তার ভীতি॥
ডাকি প্রিয় বলে তবু সে যায় চলে,
পায়ে পায়ে দলে হৃদয়-ফুল-বীথি॥
ফিরে যা সখী ফিরে যা ঘরে
কীর্তন
ফিরে যা সখী ফিরে যা ঘরে
থাকিতে দে লো এ পথে পড়ে
যে পথ ধরে গিয়াছে হরি চলি।
আমি যাব না আর গোকুলে,
লোকনিন্দা মানব না সই
যাব না আর গোকুলে,
সখী শিশিরে আর ভয় কী করি ভেসেছি যবে অকূলে॥
সখী দিসনে লো দিসনে লো রাখ গোপী-চন্দন,
চন্দনে জুড়ায় না প্রাণের ক্রন্দন,
দ্বিগুণ বাড়ায় জ্বালা নব মালতী-মালা,
ও যে মালা নয়, মনে হয় সাপিনির বন্ধন॥
সখী যাহার লাগিয়া বসন ভূষণ, সেই গেল যদি চলে,
কী হবে এ ছার ভূষণের ভার ফেলে দে যমুনাজলে।
সকলের মায়া কাটায়েছি সখী, টুটিয়াছে সব বন্ধন,
যেতে দে আমায়, যথা মথুরায় বিহরে নন্দন॥
দেখব তারে, — আমি রাজার সাজে দেখব তারে
রাজার সাজে কেমন মানায় গো-রাখা রাখাল-রাজে।
আমার হৃদয়ের রাজা রাজ্য পেয়েছে
দেখিতে যাইব আমি,
যদি চিনিতে না পারে আসিব লো ফিরে
দুয়ারে ক্ষণেক থামি।
মোর রাজ-দর্শন পুণ্য হবে,
আমি তীর্থের ফল লভিয়া ফিরিব
দেখিয়া জীবনস্বামী॥
বন-হরিণীরে তব বাঁকা আঁখির
পিলু খেমটা
বন-হরিণীরে তব বাঁকা আঁখির,
ওগো শিকারি, মেরো না তির॥
ভীরু-হরিণী বনের ছায়ায়,
খেলে বেড়ায় সে অধীর (চপলা)।
তার সুখ-হাসি-সাধ লয়ে হে নিষাদ
দিয়ো না নয়নে নীর॥
আজও বোঝে না সে বাঁকা-চোখের ভাষা,
পিয়ার লাগি জাগেনি পিয়াসা।
সরল চোখে তার প্রেমের লালি
ফোটেনি আবেশ মদির (নয়নে)।
তার আয়নার প্রায় স্বচ্ছ হিয়ায়
আঁকিয়ো না হায়, দাগ গভীর॥
বহু পথে বৃথা ফিরিয়াছি প্রভু
ভজন
বহু পথে বৃথা ফিরিয়াছি প্রভু
আর হইব না পথহারা।
বন্ধু-স্বজন সব ছেড়ে যায়
তুমি একা জাগো ধ্রুবতারা॥
মায়ারূপী হায় কত স্নেহনদী
জড়াইয়া মোরে ছিল নিরবধি,
সব ছেড়ে গেল হারাইল যদি
তুমি এসো প্রাণে প্রেমধারা॥
ভ্রান্ত পথের শ্রান্ত পথিক লুটায় তোমার মন্দিরে,
প্রভু, আরও যাহা কিছু আছে মোর প্রিয়
লও বাঁচায়ে বন্দিরে!
জগতের এই প্রেম বিষ-মিশা,
মিটে না তাহাতে অগস্ত্য-তৃষা;
হে প্রেমসিন্ধু, মিটাও পিপাসা
চাহি না বন্ধু-সুত-দারা॥
কী হবে লয়ে এ মায়ার খেলনা
কী হবে লয়ে এ তাসের ঘর,
ছুঁতে ভেঙে যায় তবু শিশুপ্রায়
ভুলাও মোদেরে নিরন্তর।
ডাকি লও মোরে মুক্ত আলোকে
তব আনন্দ-নন্দন-লোকে
শান্ত হোক এ ক্রন্দন, আর
সহে না এ বন্ধন-কারা॥
বাজিছে বাঁশরি কার অজানা সুরে
বাগেশ্রী আদ্ধা কাওয়ালি
বাজিছে বাঁশরি কার অজানা সুরে।
ডাকিছে সে যেন তার সুদূর বঁধুরে॥
তারা-লোকের সাথিরে যেন সে চাহে ধরাতে,
তারই কাঁদন যেন ঝরা কুসুমে ঝুরে॥
চাঁদের স্বপন লয়ে জাগে সে নিশীথে একা,
নিরালা গাহে গান হায় বিষাদ-মধুরে॥
তাহারই অভিমান যেন উঠিছে বাতাসে কাঁপি,
তাহারই বেদনা দূর আকাশে ঘুরে॥
বাজিয়ে বাঁশি মনের বনে
সুরট মিশ্র দাস পয়রা
বাজিয়ে বাঁশি মনের বনে
এসো কিশোর বংশীধারী।
চূড়ায় বেঁধে ময়ূর-পাখা
বামে লয়ে রাধাপ্যারি॥
আমার আঁধার প্রাণের মাঝে
এসো অভিসারের সাজে,
নয়ন-জলের যমুনাতে
উজান বেয়ে ছুটুক বারি॥
এমনি চোখে তোমায় আমি
দেখতে যদি না পাই হরি,
দেখাও পদ্মপলাশ আঁখি,
তোমার প্রেমে অন্ধ করি।
ঘুচাও এবার মায়ার বেড়ি
পরাও তিলক কলঙ্কেরই
‘শ্যাম রাখি কি কুল রাখি’ ভাব
শ্যাম হে আর সইতে নারি।
বিজন গোঠে কে রাখাল বাজায় বেণু
বাউল
বিজন গোঠে কে রাখাল বাজায় বেণু।
আমি সুর শুনে তার বাউল হয়ে এনু গো॥
ওই সুরে পড়ে মনে
কোন সুদূর বৃন্দাবনে
যেত নন্দদুলাল ব্রজের গোপাল বাজিয়ে বেণুবনে।
পথে লুটত কেঁদে গোপবালা, ভুলত তৃণ ধেনু গো॥
কবে নদিয়াতে গোরা
ও ভাই ডেকে যেত এমনি সুরে এমনি পাগলকরা,
কেঁদে ডাকত বৃথাই শচিমাতা, সাধত বসুন্ধরা,
প্রেমে গলে যেত নরনারী যাচত পদরেণু গো॥
বেলা পড়ে এল জলকে সই চল চল
খাম্বাজ খেমটা
বেলা পড়ে এল জলকে সই চল চল।
ডাকিছে ওই তটিনী ছলছল॥
বকের সারিকার মালা দুলিয়ে,
আসিছে সাঁঝ ওই চিকুর এলিয়ে,
আকাশের কোলে শিশু-শশীরে ওই
দেখিতে আসিছে তারকা দলে দলে॥
কমলিনীর মলিন মুখ
হাসে জলে শাপলা শালুক,
বনের পথ হল আঁধার
জোনাকি ওই চমকে ঝলমল॥
ব্রজের দুলাল ব্রজে আবার আসবে ফিরে কবে
কীর্তন
ব্রজের দুলাল ব্রজে আবার আসবে ফিরে কবে?
জাগবে কি আর ব্রজবাসী ব্যাকুল বেণুর রবে?
বাজবে নূপুর তমালছায়ায়
বইবে উজান হৃদ-যমুনায়,
অভাগিনি রাধার কি আর তেমন সুদিন হবে?
গোঠে নাহি যায় রাখালেরা আর
লুটায়ে কাঁদে পথের ধুলায়,
ধেনু ছুটে যায় মথুরা পানে
না হেরি গোঠে রাখাল-রাজায়।
উড়িয়া গিয়াছে শুকসারি পাখি
শুনি না কৃষ্ণ-কথা (আর),
শ্যাম-সহকার তরুরে না হেরি
শুকাল মাধবীলতা।
শ্যাম বিনে নাই সে শ্যাম-কান্তি,
শুকায়েছে সব।
কদম তমাল তরুপল্লব হাসি-উৎসব শুকায়েছে সব।
সখী গো –
চির-বসন্ত ছিল যথা আজ সেথা শূন্যতা
হাহাকার রবে কাঁদে শ্যাম (হে)
ললিতা বিশাখা নাই, নাই চন্দ্রাবলী
নাই ব্রজে শ্রীদাম সুদাম। (সখা হে)
ভবের এই পাশা খেলায়
বাউল লোফা
ভবের এই পাশা খেলায়
খেলতে এলি, হায় আনাড়ি।
হাতে তোর দান পড়ে না
হাত খোলে না তাড়াতাড়ি॥
তুই আর তোর সাথি ভাই
কাঁচা খেলোয়াড় দু-জনাই,
মায়া-রিপুর সাথে তাই
নিত্য হেরে ফিরিস বাড়ি॥
তোরই সে চালের দোষে
যায় কেঁচে তোর পাকা ঘুঁটি,
ফিরিতে হয় অমনি
যেমনি যাস ঘরে উঠি।
ও হাতে হরদম চক ছয়-তিন-নয় পড়ছে আড়ি॥
সংসার-ছক পেতে হায়,
বসে রোস মোহের নেশায়,
হেরে যে সব খোয়ালি
যাসনে তবু খেলা ছাড়ি॥
প্রাণ মন দুই ঘুঁটিতে যুগ বেঁধে তুই যা এগিয়ে,
দেহ তোর একলা ঘুঁটি রাখ আড়িতে মার বাঁচিয়ে।
আড়িতে মার খেলে তুই স্বর্গে যাবি জিতবি হারি॥
ভালো প্রিয় ভোলো ভোলো আমার স্মৃতি
পিলু খাম্বাজ লাউনি
ভালো প্রিয় ভোলো ভোলো আমার স্মৃতি।
তোরণ-দ্বারে বাজে করুণ বিদায়-গীতি॥
তুমি ভুল করে এসেছিলে,
ভুলে ভালো বেসেছিলে,
ভুলের খেলা ভুলের মেলা
তাই প্রিয় ভেঙে দিলে।
ঝরা ফুলে হেরো ঝুরে কানন-বীথি॥
তব সুখ-দিনে তব হাসির মাঝে অশ্রু মম
রবির দাহে শিশিরসম শুকাইবে প্রিয়তম!
হাসিবে তব নিশীথে নব চাঁদের তিথি।
ফোটে ফুল যায় ঝরে
গহন বনে অনাদরে,
গোপনে মোর প্রেম-কুসুম
তেমনই গেল গো মরে ;
আমার তরে কাঁটার ব্যথা কাঁদুক নিতি॥
ভালোবেসে অবশেষে কেঁদে দিন গেল
বাউল কাহারবা
ভালোবেসে অবশেষে কেঁদে দিন গেল,
ফুল-শয্যা বাসি হল, বঁধু না এল।
পানের খিলি শুকাইল বাটাতে ভরা,
এ পান আমি কারে দিব সে বঁধু ছাড়া,
নীলাম্বরী শাড়ি ছি ছি পরলেম মিছে লো॥
সখী এবার ধরে দিস যদি তায়
তারে রাখব বেঁধে বিনোদ খোঁপায়,
কাঙালে পাইলে রতন যেমন রাখে লো॥
সোঁদা-মাখা দিসনে কেশে, গন্ধে যে লো তার
মনে আনে চন্দন-গন্ধ সোনার বঁধুয়ার।
এত দুঃখ ছিল আমার এই বয়েসে লো॥
ভুবনে ভুবনে আজি ছড়িয়ে গেছে রং
হোরি
কাফি সাদ্রা
ভুবনে ভুবনে আজি ছড়িয়ে গেছে রং।
রাঙিল, মাতিল ধরা অভিনব ঢং॥
রাঙা বসন্ত হাসে নন্দন-আনন্দে,
চিত্ত-শিখী নাচে মদালস-ছন্দে,
নাচিছে পরানে আজি তরুণ দুরন্ত
বাজায়ে মৃদং॥
কামোদ নটে আমোদে ওঠে গান
মাতিয়া ওঠে প্রাণ।
উতল যমুনা-জলতরঙ্গ,
অঙ্গে অপাঙ্গে আজি খেলিছে অনঙ্গ,
পরানে বাজে সারং সুর
কাফির সঙ্গ॥
ভুল করে আসিয়াছি অপরাধ যেয়ো ভুলে
খাম্বাজ – মিশ্র কাহারবা
ভুল করে আসিয়াছি
অপরাধ যেয়ো ভুলে।
দেবতা চাহে কি ফুল মরে যবে পদমূলে॥
ভুলে গেছি স্বপন-ঘোরে
তুমি যে ভুলেছ মোরে,
তব খুঁজি স্মৃতির রেখা
ভাঙন-ধরা মনের কূলে॥
নাহি মনে – ব্যথা দিয়ে কবে কথা কয়েছিলে,
বিশ্ব আমার শূন্য করে কবে বঁধু বিদায় নিলে।
হাসি-মুখখানি শুধু মনে ওঠে দুলে দুলে॥
আমার স্মৃতির চিতা পুড়িতে সে কত বাকি,
দেখিয়া চলিয়া যাব যে দেশে নাই তোমার আঁখি।
তুমি থাক হাসির দেশে, আমি হতাশার কূলে॥
ভোলো অতীত-স্মৃতি ভোলো কালা
বেহাগ-খাম্বাজ ঠুংরি
ভোলো অতীত-স্মৃতি ভোলো কালা।
কী হবে কুড়ায়ে এ ছিন্ন মালা॥
মিছে রোধি পথ
মিনতি করিছ কত,
জাগায়ে পুরানো ক্ষত
দিয়ো না জ্বালা॥
মণি-মঞ্জীর বাজে অরুণিত চরণে সখী
কীর্তন
মণি-মঞ্জীর বাজে অরুণিত চরণে সখী
রুনুঝুনু রুনুঝুনু মণি-মঞ্জীর বাজে।
হেরো গুঞ্জামালা গলে বনমালী চলিছে কুঞ্জ-মাঝে॥
চলে নওল কিশোর,
হেলে দুলে চলে নওল কিশোর।
হেরি সে লাবণি কৌস্তুভমণি নিষ্প্রভ হল লাজে।
চরণ-নখরে শ্যামের আমার চাঁদের মালা বিরাজে॥
বঁধুর চলার পথে পরান পাতিয়া রব
চলিতে দলিয়া যাবে শ্যাম,
আমি হইয়া পথের ধূলি বক্ষে লইব তুলি
চরণ-চিহ্ন অভিরাম॥
ভুলে যা তোরা রাধারে কৃষ্ণ-নিশির আঁধারে
হারায়ে সে গেছে চিরতরে,
কালো যমুনার জলে ডুবেছে সে অতল তলে
মিশে গেছে সে শ্যাম-সাগরে॥
ওই বাঁশি বাজিছে শোন রাধা বলে,
মোর তরুণ তমাল চলে, অঙ্গ-ভঙ্গে শিখী-পাখা টলে।
তার হাসিতে বিজলি
কাজল-মেঘে যেন উঠিছে উছলি।
রূপ দেখে যা দেখে যা,
কোটি চাঁদের জোছনা-চন্দন মেখে যা,
মোর শ্যামলে দেখে যা॥
মন লহো নিতি নাম রাধা-শ্যাম
বেহাগ মিশ্র কাহারবা
মন লহো নিতি নাম রাধা-শ্যাম
গাহো হরিগুণগান।
তব ধন-জন-প্রাণ যাহার কৃপার দান
জপো তারই নাম জয় ভগবান জয় ভগবান॥
জনক-জননীর [স্নেহে] তাঁহার
রূপ হেরিস তুই স্নেহময়,
ভাই ভগিনীর প্রীতিতে যাঁর
শান্ত মধুর পরিচয়।
প্রণয়ী বন্ধুর মাঝে
যাঁর প্রেম-রূপ বিরাজে,
পুত্র কন্যারূপে সেই জুড়ায় তাপিত পরান।
তৃষ্ণা-ক্ষুধায় সেই কৃষ্ণেরই লীলা
হাসে শ্যাম শস্যে কুসুমে রঙিলা,
তরঙ্গে ছলছল আঁখি জল-নীলা,
কল-ভাষা নদী-কলতান।
দেয় দুঃখ শোক সেই, পুন সে করে ত্রাণ।
জপো তার নাম, জয় ভগবান, জয় ভগবান॥
মালঞ্চে আজ কাহার যাওয়া-আসা
খাম্বাজ দাদরা
মালঞ্চে আজ কাহার যাওয়া-আসা।
ঝরা পাতায় বাজে
মৃদুল তাহার পায়ের ভাষা॥
আসার কথা জানায়
ওই যে ফুলের আখর সবুজ পাতায়,
ওই দোয়েল শ্যামার কূজন কয় যে বাণী
ওই ওই ওই তার ভালোবাসা॥
মদীর সমীরণে
তার তনুর সুবাস পাই যে ক্ষণে ক্ষণে।
সবুজ বসন ফেলি
পরল ওই বন কুসমি-রঙা চেলি।
তাই বসুন্ধরায় জাগে
অরুন আশা
ওই ওই ওই আলোকের পিপাসা॥
মোর মাধব-শূন্য মাধবী-কুঞ্জে
কীর্তন
মোর মাধব-শূন্য মাধবী-কুঞ্জে (সখী গো)
আমি যাব না যাব না, দেখিতে পাব না
সে শ্যাম নীরদপুঞ্জে।
মোরে থাকিতে দে গো এমনি পড়ে,
মোরে মাখিতে দে সেই পথের ধূলি
চলে গেছে হরি যে পথ ধরে।
সখী খুলে নীল শাড়ি দে লো তাড়াতাড়ি
গেরুয়া বসন পরায়ে,
ব্রজে নীলমণি নাই, কি হবে বৃথাই
গায়ে নীল শাড়ি জড়ায়ে।
তোরা খুলে নে লো মোর আভরণ,
কপাল যাহার পুড়েছে লো সই
ভস্ম যে তার ললাট-ভূষণ।
জনম যাহার যাইবে কাঁদিয়া
কাঁদিতে দে তারে একাকী,
বৃথা প্রবোধ তারে দিসনে তোরা,
জানি নয়নের জল হয়তো শুকাবে
শুকাবে ব্যথার রেখা কি?
ভুলে যা লো তোরা
ভুলে যা আমায়,
যদি কৃষ্ণেরে তোরা ভুলিতে পারিস
ভুলিতে পারিবি রাধায়॥
রহি রহি কেন আজও সেই মুখ মনে পড়ে
পঞ্চমরাগ-মিশ্র কাওয়ালি
রহি রহি কেন আজও সেই মুখ মনে পড়ে।
ভুলিতে তায় চাহি যত তত স্মৃতি কেঁদে মরে॥
দিয়াছি তাহারে বিদায় ভাসায়ে নয়ননীরে,
সেই আঁখিবারি আজি মোর নয়নে ঝরে॥
হেনেছি যে অবহেলা পাষাণে বাঁধি হিয়া,
তারই ব্যথা পাষাণ-সম রহিল বুকে চাপিয়া॥
সেই বসন্ত ও বরষা আসিবে ফিরে ফিরে,
আসিবে না আর ফিরে অভিমানী মোর ঘরে॥
রেশমি চুড়ির তালে কৃষ্ণচূড়ার ডালে
গৌড়সারং কাওয়ালি
রেশমি চুড়ির তালে কৃষ্ণচূড়ার ডালে
পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা ডেকে ওঠে পাপিয়া।
আঙিনায় ফুল-গাছে প্রজাপতি নাচে,
ফেরে মুখের কাছে আদর যাচিয়া॥
দুলে দুলে বনলতা কহিতে চাহে কথা,
বাজে তারই আকুলতা কানন ছাপিয়া।
শ্যামলী-কিশোরী মেয়ে
থাকে দূর-নভে চেয়ে,
কালো মেঘ আসে ধেয়ে
গগন ব্যাপিয়া॥
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘুর্ণিবায়
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
নাচিছে ঘুর্ণিবায়।
জল তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল
ঢেউ তুলে সে যায়।।
দীঘির বুকের শতদল দলি,
ঝরায়ে বকুল চাঁপার কলি,
চঞ্চল ঝরনার জল ছলছলি
মাঠের পথে সে ধায়।।
বন-ফুল-আভরণ খুলিয়া ফেলিয়া,
আলুথালু এলোকেশ গগনে মেলিয়া
পাগলিনী নেচে যায় হেলিয়া-দুলিয়া
ধূলি-ধূসর কায়।।
ইরানি বালিকা যেন মরু–চারিণী
পল্লির প্রান্তর–বন মনোহারিণী
ছুটে আসে সহসা গৈরিক বরণী
বালুকার উড়ুনি গায়।।
শোনে লো বাঁশিতে
মালকোশ – সেতারখানি
শোনে লো বাঁশিতে
ডাকে আমারে শ্যাম।
গুমরিয়া কাঁদে বাঁশি
লয়ে রাধা নাম॥
পিঞ্জরে পাখি যেন
লুটাইয়া কাঁদে মন,
আশে পাশে গুরুজন বাম॥
সকরুণ নয়নে চাহো আজি মোর বিদায়বেলা
দেশি-টোড়ি-মিশ্র লাউনি
সকরুণ নয়নে চাহো আজি মোর বিদায়বেলা।
ভুলিতে দাও বিদায়-দিনে হেনেছ যে অবহেলা॥
হাসিয়া কহো কথা আজ হাসিতে যেমন আগেতে
হেরিবে মোর জীবন-সাঁঝে গোধূলি রঙের খেলা॥
থেকে যাও আরও কিছুখন থাকিতে বলিব না কাল,
মরণ-সাগরাপানে ভাসে মোর জীবন-ভেলা॥
আজিকার সাঁঝের ছায়া যেন না পড়ে ও মুখে,
সাঁঝের শেষে যেন আসে চাঁদের আর তারকার মেলা॥
হে বন্ধু, বন্ধুর পথে কে কাহার হয়েছে সাথি,
তেমনি থাকিয়া যায় সব, যাবার যে, যায় সে একেলা॥
সখী যায়নি তো শ্যাম মথুরায়
কীর্তন
সখী যায়নি তো শ্যাম মথুরায়,
আর আমি কাঁদব না সই।
সে-যে রয়েছে তেমনই ঘিরে আমায়॥
মোর অন্তরতম আছে অন্তরে
অন্তরালে সে যাবে কোথায়?
আছে ধেয়ানে স্বপনে জাগরণে মোর
নয়নের জলে আঁখি-তারায়॥
কে বলে সখী অন্ধকার এ বৃন্দাবনে কৃষ্ণ নাই,
তমাল-কদম শ্যামপল্লবে হৃদিবল্লভে দেখিতে পাই।
গোকুলে যে আজ কৃষ্ণপক্ষ,
কে বলে সখী কৃষ্ণ নাই।
অন্য পক্ষে কী কাজ সখী,
গোকুলে যে আজ কৃষ্ণপক্ষ,
দেখো কৃষ্ণেরই নাম লয় সবাই।
সখী গো –
আমি অন্তরে পেয়েছি লো, বাহিরে হারিয়ে তায়,
যাক না সে মথুরায়, যেথা তার প্রাণ চায়॥
শ্যামে হেরিয়াছি যমুনার কালো জলে, সাগরে,
আষাঢ়ের ঘন মেঘে হেরিয়াছি নাগরে।
হেরিয়াছি তারে শ্যাম-শস্যে হেমন্তে,
পীত-ধড়া হেরি তার কুসমি বসন্তে।
এঁকেছিলাম শ্যামের ছবি সেদিন সখী খেলার ছলে,
আঁকিনি লো চরণ তাহার, পালায়ে সে যাবে বলে।
আনিয়া দে আজ সে চিত্রপট
আঁকিব লো আজি চরণ তার,
সে যায়নি মথুরা কাঁদিসনে তোরা
আছে আছে শ্যাম হৃদে আমার॥
সবুজ শোভার ঢেউ খেলে যায়
খাম্বাজ দাদরা
সবুজ শোভার ঢেউ খেলে যায়
নবীন আমন ধানের খেতে।
হেমন্তের ওই শিশির-নাওয়া হিমেল হাওয়া,
সেই নাচনে উঠল মেতে॥
টই-টুম্বুর ঝিলের জলে
কাঁচা রোদের মানিক ঝলে,
চন্দ্র ঘুমায় গগনতলে
সাদা মেঘের আঁচল পেতে॥
নটকান-রং শাড়ি পরে কে বালিকা
ভোর না হতে যায় কুড়াতে শেফালিকা।
আনমনা মন উড়ে বেড়ায়
অলস প্রজাপতির পাখায়,
মৌমাছিদের সাথে সে চায়
কমল-বনের তীর্থে যেতে॥
সাগর আমায় ডাক দিয়েছে
বাউল দাদরা
সাগর আমায় ডাক দিয়েছে
মন-নদী তাই ছুটছে ওই।
পাহাড় ভেঙে মাঠ ভাসিয়ে
বন ডুবিয়ে তাই তো বই॥
তরঙ্গে তাই রাত্রি দিন
গান গেয়ে যাই নিদ্রাহীন
বাজিয়ে ঢেউ-এর বীণ।
বন্যা এনে মায়ার পুরী ভাসিয়ে নাচি তাথই থই॥
সেই পুরানো সুরে আবার গান গেয়ে কে যায় নিতি
ঝিঁঝিট কাহারবা
সেই পুরানো সুরে আবার গান গেয়ে কে যায় নিতি।
গেয়েছিল এমনই সুরে একদা এক অতিথি॥
কণ্ঠে তাহার এমনি মায়া প্রাণ-মাখানো এমনই,
গাইত হতাশ তরুণ পথিক, এমনই করুণ-গীতি॥
এনেছিল বাসন্তী রং তার ছোঁয়া আমার প্রাণে,
মুছে গেছে রঙের সে দাগ, কে জাগায় ফের তার স্মৃতি॥
চলে গেছে তাহার সাথে বসন্ত মোর অকালে,
ভরে গেছে ঝরা ফুলে শুকনো পাতায় বনবীথি॥
ভুলিয়া ছিলাম ভালো তাই কি পুন কাঁদাতে
আসিল সে সিঁদুর-রাগে রাঙাতে সাঁঝের সিঁথি॥
সেদিনও প্রভাতে রাতুল শোভাতে
ভৈরবী আদ্ধা কাওয়ালি
সেদিনও প্রভাতে রাতুল শোভাতে
হেসেচ বুকে মোর চারুহাসিনী।
পরেছ খোঁপাতে আমার-দেওয়া ফুল
সে কি গো সবই ভুল বিজনবাসিনী॥
যেচেছ কত না আদর-সোহাগ
ক্ষণে অভিমান ক্ষণে অনুরাগ,
কত প্রিয় নামে ডেকেছ আমারে
সে কি গেছ ভুলে মধুভাষিণী॥
আমার আশা সাধ সাধনা সুখ হাসি
তোমার সাথে প্রিয় গিয়াছে সব ভাসি
কেন ফেলে দিলে নিরাশার কূলে,
কোন অপরাধে বলো উদাসিনী॥
হুল ফুটিয়ে গেলে শুধু
ভৈরবী দাদরা
হুল ফুটিয়ে গেলে শুধু পারলে না হায় ফুল ফোটাতে।
মৌমাছি যে ফুলও ফোটায় হুল ফোটানোর সাথে সাথে॥
আঘাত দিলে, দিলে বেদন,
রাঙাতে হায় পারলে না মন,
প্রেমের কুঁড়ি ফুটল না তাই
পড়ল ঝরে নিরাশাতে॥
আমায় তুমি দেখলে নাকো, দেখলে আমার রূপের মেলা।
হায় রে দেহের শ্মশানচারী, শব নিয়ে মোর করলে খেলা।
শয়ন-সাথি হলে আমার রইলে নাকো নয়ন-পাতে॥
ফুল তুলে হায় ঘর সাজালে, করলে নাকো গলার মালা,
ত্যজি সুধা পিয়ে সুরা হলে তুমি মাতোয়ালা।
নিশাস ফেলে নিভাইলে যে দীপ আলো দিত রাতে॥
হেসে হেসে কলসি নাচাইয়া কিশোরী চলে
ভৈরবী খেমটা
হেসে হেসে কলসি নাচাইয়া কিশোরী চলে।
রিনিঠিনি কলস-কাঁকনে কী কথা বলে॥
নেচে চলে চাঁপা-বরনা যেন ঝরনা
বাহু দোলাইয়া,
নয়ন-কুরঙ্গ জাগায় গো তরঙ্গ
নদীর জলে॥
এত রূপ লাখ চোখে ধরে না
তারে দেখি কী করে,
বিধি দিল দুটি আঁখি আমারে
তাহে হায় পলক পড়ে।
গ্রামের পথ চাহে তারে
ডাকে বাঁশি বন-পারে,
গিরি-দরি-নদী চাহে যারে
তাহারে চাহি কোন ছলে॥
হোরির রং লাগে আজি গোপিনীর তনু মনে
রসিয়া হোরি
হোরির রং লাগে আজি গোপিনীর তনু মনে।
অনুরাগে-রাঙা গোরীর বিধু-বদনে॥
ফাগের লালি আনিল কে,
কাজল-কালো চোখে
কামনা-আবির ঝরে রাঙা নয়নে॥
অশোক রঙন ফুলের আভা
জাগে ডালিম-ফুলি গালে,
নাচিছে হৃদয় আজি
রসিয়ার নাচের তালে।
তাম্বুল- রাঙা ঠোঁটে
ফাগুনের ভাষা ফোটে,
প্রাণের খুশির রং লেগেছে
রাঙা বসনে॥