- বইয়ের নামঃ যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
০১. পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া বোলে
এক অহোরাত্র আট প্রহরে বা যামে বিভক্ত। অর্থাৎ প্রতি তিন ঘণ্টায় এক প্রহর বা যাম। সংগীতের স্বর সপ্তকের মধ্যে কড়ি ‘মা’ বা তীব্র মধ্যম স্বর এই যাম বা প্রহর যোজনায় সেতু স্বরূপ। প্রতি প্রহরকে এই তীব্র মধ্যম যেন আহ্বান করে আনে আগত প্রহরের সাথে বিদায় প্রহরের পরিচয় করে দেয়! নিশির শেষ প্রহরে যে রাগ গীত হয়, তার মধ্যে ললিত রাগ অন্যতম। ললিত রাগের শুদ্ধ ও তীব্র দুই ‘মা’। ‘পা’ নেই বলেই বোধ হয় দুই ‘মা’র কোলে ললিত রাগ লালিত হয়েছে। এই রাগের খেয়াল শুনুন। ‘মা’ এ রাগের প্রাণ।
ললিত–তেতালা (চিত্তরায়)
পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া বোলে।
কৃষ্ণচূড়ার বনে ফাল্গুন-সমীরণে
ঝুরে ফুল বন-পথ তলে
নিশি পোহায় যায় কাহার লাগি
নয়নে নাহি ঘুম বসিয়া জাগি
আমারই মতো হায় চাহিয়া আশা-পথ
নিশীথের চাঁদ পড়ে গগনে ঢলে॥
০২. উদার প্রাতে কে উদাসী এলে
টোড়ি রাগিণী দ্বিতীয় প্রহরে গীত হয়। ভৈরবী আশাবরি গান্ধারী প্রভৃতি রাগিণীর পর রাগের তীব্র মধ্যম তীব্র সুরে জানিয়ে দেয় যে, দিনের দ্বিতীয় প্রহর এল। দু-একটি টোড়িতে দুই মধ্যম লাগে। শুদ্ধ টোড়ির এক ‘মা’। আরোহণের সময় এর পা পড়ে বক্র গতিতে। আরোহণের সময় ঋষভ বা রেখাবে চড়তে এ একটু ইতস্তত করে। অবরোহণের বেলায় কিন্তু ঋষভের গা ঘেঁষে খেলা করে। টোড়ির খেয়াল শুনুন।
টোড়ি–তেতালা
উদার প্রাতে কে উদাসী এলে।
প্রশান্ত দীঘল নয়ন মেলে॥
স্নিগ্ধ সকরুণ তোমার হাসি
আঘাত করে কেন আমারে আসি?
পাষাণ সম তব মৌন মুরতি
মোর বুকে বিষাদের ছায়া কেন ফেলে॥
উন্মন ভিখারি গো, বল মোর কাছে
শূন্য ঝুলি তব কোন মন যাচে।
অশ্রু-তুষার-ঘন বিগ্রহ তব
গলিয়া পড়িবে প্রেমে কার মালা পেলে॥
০৩. ভবনে আসিল অতিথি সুদূর
টোড়ির পর যে সব সারং গীত হয় তার মধ্যে শুদ্ধ সারং ও গৌড় সারং ছাড়া অন্য রাগে তীব্র মধ্যম নেই। গৌড় সারংকে দিনের বেহাগও বলা হয়। দুপুর বেলায় এই রাগ গাওয়া হয়। এরও দুই ‘মা’। এর দুই ‘মা’-র উপরে সমান টান। এর চলন অত্যন্ত বাঁকা। এর খেয়াল গান গাওয়া হচ্ছে, শুনলেই এর বাঁকা স্বভাবের পরিচয় পাবেন।
গৌড় সারং – তেতালা
ভবনে আসিল অতিথি সুদূর।
সহসা উঠিল বাজি রুমুরুমু ঝুমু
নীরব অঙ্গনে চঞ্চল নূপুর॥
মুহু মুহু বন-কুহু বোলে
দোয়েল শ্যামল ডালে দোলে,
মেঘের ধ্যান ভুলি চমকি আঁখি খোলে
‘কে গো কে’ বলে বন-ময়ূর॥
‘দগ্ধ হিয়ার জ্বালা ভুলায়ে
সজল মেঘের শীতল চন্দন কে দিল কে দিল বুলায়ে ।
বকুল-কেয়া-বীথি হতে
ছুটে এল সমীরণ চঞ্চল স্রোতে,
চাঁদিনি নিশীথের আবেশ আনে
মিলন-তন্দ্রাতুর অলস দুপুর॥
০৪. মুকুর লয়ে কে গো বসি
গৌড় সারং-এর পরে অন্য প্রহরকে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য আসেন মুলতান রাগের তীব্র মধ্যম। মুলতান রাগের এক ‘মা’ – অর্থাৎ এতে কেবল কড়ি ‘মা’ লাগে। সকালের টোড়ি আর বিকালের মুলতান একই ঘরের ছেলে মেয়ে। শুধু চাল চলনের তফাতের জন্য দুই জনের স্বভাব দু-রকমের হয়ে গেছে। টোড়ি শুনেছেন, এখন মুলতান খেয়াল শুনুন, তা-হলেই এদের চালের তফাত বুঝতে পারবেন। টোড়ির রাধা অর্থাৎ ‘রে’ আর ‘ধা’ প্রীতি প্রবল, পা দুর্বল। মুলতানির ‘পা’ বেশ প্রবল। রাধা-প্রীতি খুব কম।
মুলতানি–তেতালা
মুকুর লয়ে কে গো বসি
হেরিছে আপন ম্লান মুখ-শশী॥
সখীরা ডাকে, বেলা বয়ে যায়
দোপাটির ফুল ঝুরে আঙিনায়,
ধুলাতে লুটায় কাঁখের কলশি॥
হেরিয়া তারি আলস ছবি
ডুবিতে নারে সাঁঝের রবি।
কমল-কলি লয়ে আঁচলে
ডাকিছে তারে গাঁয়ের সরসী॥
০৫. বিদায়ের বেলা মোর ঘনায়ে আসে
বিকালের মুলতানির পর পিলু ভীমপলশ্রী প্রভৃতি রাগিণীতে আর ‘কড়ি মা’ নেই। সান্ধ্য প্রহর যেই এল, অমনি কড়ি ‘মা’ আনলেন ‘পুরবি’কে ধরে। পুরবি এল কাঁদতে কাঁদতে। দুই ‘মা’-র গলা জড়িয়ে এর কান্না অতি সকরুণ।
পুরবি–তেতালা
বিদায়ের বেলা মোর ঘনায়ে আসে।
দিনের চিতা জ্বলে অস্ত-আকাশে॥
দিন শেষে শুভদিন এল বুঝি মম
মরণের রূপে এলে মোর প্রিয়তম
গোধূলির রঙে তাই দশ দিশি হাসে॥
দিন গুনে নিরাশার পথ চাওয়া ফুরাল
শ্রান্ত এ জীবনের জ্বালা আজি জুড়াল।
ওপার হতে কে আসে তরি বাহি
হেরিলাম সুন্দরে আর ভয় নাহি,
আঁধারের পারে তার চাঁদ-মুখ ভাসে॥
পুরবি পুরিয়া প্রভৃতি রাগের কান্নার পর, রাত্রি যেমন ঘনিয়ে এল অমনি চাঁদের চাঁদ-মুখ দেখে রাতের চোখে ফুটে উঠল হাসি। তীব্র মধ্যম নিয়ে এল চঞ্চল ছায়ানটকে ধরে। নটের মতো এর আঁকাবাঁকা গতি, মধুর অঙ্গভঙ্গি কী অপরূপ, তার আভাস পাবেন এই সুরের গানে।
০৬. বিরহী বেণুকা কেন বাজে সখী ছায়ানটে
বিরহী বেণুকা কেন বাজে সখী ছায়ানটে।
উথলি উঠিল বারি শীর্ণা যমুনা তটে॥
নীরব কুঞ্জে কুহু
গেয়ে ওঠে মুহু মুহু
আঁধার মধু বনে বকুল চম্পা ফোটে॥
সহসা সরসা হল বিরস বৃন্দাবন
চন্দ্রা-যামিনী হাসে খুলি মেঘ-গুণ্ঠন।
সে এলে তারে নিরখি
পরান কি রবে সখী?
আবেশে অঙ্গ মম থরথর কেঁপে ওঠে॥
০৭. নিশি নিঝুম, ঘুম নাহি আসে
ছায়ানটের পর আসে নিঝুম নিশি। বিহগ যখন ঘুমায় বেহাগ তখন জাগে। শুদ্ধ মধ্যমই এর আসল মা। কড়ি ‘মা’ এর সৎমা। দুই মধ্যমে এর যে অপরূপ শ্রী ফুটে উঠে তার বুঝি তুলনা নেই।
বেহাগ–তেতালা
নিশি নিঝুম, ঘুম নাহি আসে।
হে প্রিয় কোথা তুমি দূর প্রবাসে॥
বিহগী ঘুমায় বিহগ-কোলে
ঘুমায়েছে ফুল মালা শ্রান্ত আঁচলে
ঢুলিছে রাতের তারা চাঁদের পাশে॥
ফুরায় দিনের কাজ, ফুরায় না রাতি
শিয়রের দীপ হায় অভিমানে নিভে যায়
নিভিতে চাহে না নয়নের বাতি!
কহিতে নারি কথা তুলিয়া আঁখি,
বিষাদ-মাখা মুখ গুণ্ঠনে ঢাকি,
দিন যায় দিন গুনে নিশি যায় নিরাশে॥
০৮. পর জনমে যদি আসি এ ধরায়
বেহাগের পর নিশীথের তৃতীয় প্রহরে কড়ি মধ্যম ধরে আনে চঞ্চল ‘পরজ’কে। এর মান অত্যন্ত প্রবল – অর্থাৎ কড়ি মধ্যম ও নিখাদে এর অত্যন্ত প্রীতি। এর তীব্র নিখাদ ও মধ্যম ঘুমন্তের ঘুম ভেঙে দেয়। এর বিরহ যেন বিলাস। বসন্তের সাথে এর অত্যন্ত প্রীতি।
পরজ–তেতালা
পর জনমে যদি আসি এ ধরায়
ক্ষণিক বসন্ত যেন না ফুরায়॥
মিলনে যেন নাহি আসে অবসাদ
ক্ষয় নাহি হয় যেন চৈতালি চাঁদ॥
কণ্ঠ লগ্না মোর প্রিয়ার বাহু
ঢলিয়া না পড়ে যেন, নিশি না পোহায়॥
বাসি নাহি যেন হয় রাতের মালা
ভরা থাকে যৌবন রস পিয়ালা।
জীবনে রবে না মরণ-স্মৃতি
পুরাতন হবে না প্রেম-প্রীতি।
রবে অভিমান, রহিবে না বিরহ
ফিরে যেন আসে প্রিয়া মাগিয়া বিদায়॥