আনন্দ-দুলালি ব্রজবালার সনে
হোরি কাহারবা
আনন্দ-দুলালি ব্রজবালার সনে
নন্দদুলাল খেলে হোলি!
রঙের মাতন লেগে যেন শ্যামল মেঘে
খেলিছে রাঙা বিজলি॥
রাঙা মুঠি-ভরা রাঙা আবির-রেণু
রাঙিল পীত-ধড়া শিখী-পাখা বেণু
রাঙিল শাড়ি কাঁচলি॥
লচকিয়া আসে মুচকিয়া হাসে
মারে আবির পিচকারি,
চাঁদের হাট তোরা দেখে যা রে দেখে যা
রঙে মাতোয়ালা নর-নারী!
শিরায় শিরায় সুরার শিহরণ
রঙ্গে অঙ্গে পড়ে ঢলি॥
আবু আর হাবু দুই ভায়ে ভায়ে সদাই ভীষণ দ্বন্দ্ব
আবু আর হাবু দুই ভায়ে ভায়ে সদাই ভীষণ দ্বন্দ্ব।
বোঝালে বোঝে না, এক ভাই কানা আর এক ভাই অন্ধ॥
হাবু বলে, ‘আবু, বিশ্রী দেখায় শিগগির চাঁছো দাড়ি!’
আবু বলে, ‘দাদা, পেঁয়াজের ঝাড় ওই টিকি কাটো তাড়াতাড়ি!’
টিকি ও দাড়িতে চুলোচুলি বাধে ট্রাম বাস হয় বন্ধ॥
হাবু বলে, ‘আবু, তোর কী তাহাতে, বাঁচুক মরুক তুর্কি
বেঁচে থাক তুই আর বেঁচে থাক তোর দরগার মুরগি!’
আবু বলে, ‘দাদা, মুরগি বাঁচাতে ছুটি যে সমরকন্দ’॥
হাবু বলে, ‘আবু, কাছা দে শিগগির!’ আবু বলে, ‘ছাড় গামছা!’
হাবু আনে ছুটে খুন্তি, আবু উঁচাইয়া ধরে চামচা।
হাবু সে দেখায় জুজুৎসু প্যাঁচ, আবু মোহরমি ছন্দ॥
হাবু বলে, ‘আবু, পাঁঠার আমার মেরেছিস তুই জাত,
খোদার খাসি যে করেছিস তারে, দেব অভিসম্পাত?’
আবু বলে, ‘দাদা, মারিনি তো জাত, মেরেছি বোঁটকা গন্ধ’ ॥
আবু আসে তেড়ে লুঙি তুলে, হাবু বাগাইয়া ধরে কোঁচা,
আবু বের করে ছোরাছুরি, হাবু দেখায় বাঁশের খোঁচা।
হাবু বলে, ‘দেব ভুঁড়ি চাপা,’ আবু দেখায় অর্ধচন্দ্র॥
টিকি আর দাড়ি ছেড়ে আড়াআড়ি সহসা হইল দোস্ত,
আবু খায় কিনে গোস্ত কাবাব, হাবু খায় বড়ি পোস্ত,
আবু যায় চলে কাঁকিনাড়া, হাবু চলে যায় গোয়ালন্দ॥
গোঁড়া ও পাতি
আমার-দেওয়া ব্যথা ভোলো
জৌনপুরী-টোড়ি একতালা
আমার-দেওয়া ব্যথা ভোলো
আজ যে যাবার সময় হল॥
নিববে যখন আমার বাতি
আসবে তোমার নূতন সাথি,
আমার কথা তারে বোলো॥
ব্যথা দেওয়ার কী যে ব্যথা
জানি আমি, জানে দেবতা।
জানিলে না কী অভিমান
করেছে হায় আমায় পাষাণ,
দাও যেতে দাও, দুয়ার খোলো॥
আমি যেদিন রইব না গো লইব চির-বিদায়
আশাবরি লাউনি
আমি যেদিন রইব না গো
লইব চির-বিদায়
চিরতরে স্মৃতি আমার
জানি মুছে যাবে হায়॥
আরশিতে তার ছায়া পড়ে
রয় যবে সে সুমুখে,
সে যবে যায় দূরে চলে
অমনি ছবি মিলায়॥
এই ধরণির খেলাঘরে
মনে রাখে কে কারে,
দুলে সাগর চাঁদ-সো্হাগে
মরু মরে পিপাসায়॥
রবি যবে ওঠে নভে
চাঁদে কে মনে রাখে
এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে
মানুষের মন নদীর প্রায়॥
মোর সমাধির বুকে প্রিয়
উঠবে তোমার বাসরঘর,
হায়, অসহায় ভিখারি-মন
কাঁদে তবু সেই ব্যথায়॥
উচাটন মন ঘরে রয় না পিয়া মোর
গারা খাম্বাজ দাদরা
উচাটন মন ঘরে রয় না পিয়া মোর।
ডাকে পথে বাঁকা তব নয়না পিয়া মোর॥
ত্যজিয়া লোক-লাজ
সুখ-সাধ গৃহ-কাজ –
নিজ গৃহে বনবাস সয় না পিয়া মোর॥
লইয়া স্মৃতির লেখা
কত আর কাঁদি একা,
ফুল গেলে কাঁটা কেন যায় না পিয়া মোর॥
এ কোথায় আসিলে হায়
কাফি-মিশ্র কাহারবা
এ কোথায় আসিলে হায়, তৃষিত ভিখারি।
হায়, পথ-ভোলা পথিক, হায়, মৃগ মরুচারী॥
মোর ব্যথায় চরণ ফেলে
চির-দেবতা কি এলে,
হায়, শুকায়েছে যবে মোর নয়নে নয়ন-বারি॥
তোমার আসার পথে প্রিয়
ছিলাম যবে পরান পাতি,
সেদিন যদি আসিতে নাথ
হইতে ব্যথার ব্যথী।
ধোয়ায়ে নয়ন-জলে
পা মুছাতাম আকুল কেশে,
আজ কেন দিন-শেষে
এলে নাথ মলিন বেশে!
হায়, বুকে লয়ে ব্যথা আসিলে ব্যথাহারী॥
স্মৃতির যে শুকানো মালা যতনে রেখেছি তুলি
ছুঁয়ে সে হার ঝরায়ো না ম্লান তার কুসুমগুলি।
হায়, জ্বলুক বুকে চিতা, তায় ঢেলো না আর বারি॥
এ ঘোর শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে
কাজরি কাহারবা
এ ঘোর শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে।
হায়, রহি রহি সেই পড়িছে মনে॥
বিজলিতে সেই আঁখি
চমকিছে থাকি থাকি,
শিহরিত এমনই সে বাহু-বাঁধনে॥
কদম-কেশরে ঝরে তারই স্মৃতি,
ঝরঝর বারি যেন তারই গীতি।
হায় অভিমানী হায় পথচারী,
ফিরে এসো ফিরে এসো তব ভবনে॥
শনশন বহে বায় সে কোথায় সে কোথায়
নাই নাই ধ্বনি শুনি উতল পবনে হায়,
চরাচর দুলিছে অসীম রোদনে॥
এল ফুলের মহলে ভোমরা গুনগুনিয়ে
সিন্ধু মিশ্র খেমটা
এল ফুলের মহলে ভোমরা গুনগুনিয়ে।
ও-সে কুঁড়ির কানে কানে কী কথা যায় শুনিয়ে॥
জামের ডালে কোকিল কৌতুহলে,
আড়ি পাতি ডাকে কূ কূ বলে
হাওয়ায় ঝরা পাতার নূপুর বাজে রুনুঝুনিয়ে॥
‘ধীরে সখা ধীরে’ – কয় লতা দুলে,
‘জাগিয়ো না কুঁড়িরে, কাঁচা ঘুমে তুলে, –
গেয়ো না গুন গুন গুন গুন সুরে
প্রেমে ঢুলে ঢুলে।’
নিলাজ ভোমরা বলে, ‘না-না-না-না’-
–ফুল দুলিয়ে॥
এলে কে গো চিরসাথি অবেলাতে
বেহাগ-খাম্বাজ দাদরা
এলে কে গো চিরসাথি অবেলাতে।
যবে ঝুরিছে সন্ধ্যামণি আঙিনাতে॥
রোদের দাহে এলে স্নিগ্ধ-বাস ফুলরেণু
নিঝুম প্রাণে এলে বাজায়ে ব্যাকুল বেণু,
চাঁদের তিলক এলে আঁধার রাতে॥
ফুল ঝরার বেলা এলে কি শেষ অতিথি,
কাঁদে হা হা স্বরে রিক্ত কানন-বীথি।
এলে কোন মরুভূমে পিয়াসি দয়িত মোর,
শুক্লাতিথির শেষে কাঁদিতে এলে চকোর।
আসিলে জীবন-সাঁঝে ঘুম ভাঙাতে॥