বেণুকা ওকে বাজায় মহুয়া-বনে
বেণুকা ওকে বাজায় মহুয়া-বনে।
কেন ঝড় তোলে তার সুর আমার মনে॥
বলে, আয় সখী, সে দুরন্তে সখী
আমারে কাঁদাবে সারা জনম ওকি?
সে কি ভুলিতে দেবেনা সারা জীবনে॥
সখী মন্দ ছিল তার তির ধনুক মধুর
বাজে এবার সুমধুর তার বেণুকার সুর
সখী কেন সে বন-বিলাসী
আমার ঘরের পাশে বাজায় বাঁশি
আছে আরো কত দেশ কত নারী ভুবনে॥
ভালোবাসার ছলে আমায় তোমার নামে গান গাওয়ালে
ভালোবাসার ছলে আমায় তোমার নামে গান গাওয়ালে।
চাঁদের মতন সুদূর থেকে সাগরে মোর দোল খাওয়ালে॥
কাননে মোর ফুল ফুটিয়ে উড়ে গেল গানের পাখি,
যুগে যুগে আমায় তুমি এমনি করে পথ চাওয়ালে॥
আঁকি তোমার কতই ছবি, তোমায় কতই নামে ডাকি,
পালিয়ে বেড়াও, তাই তো তোমায় রেখার সুরে ধরে রাখি।
মানসী মোর! কোথায় কবে আমার ঘরের বধূ হবে,
লোক হতে লোকান্তরে সেই আশে তরি বওয়ালে॥
মদিনা! মদিনা! কেন তোমার এত অহংকার
‘মদিনা’! ‘মদিনা’! কেন তোমার এত অহংকার?
তোমার বাড়িতে আমি কভু আসব না আর।
মোরে বাংলার সকলে ভালোবাসে
সেই গৌরবে এসেছিলাম তোমার কাছে।
মদিনা! মদিনা! মদিনা
মদিনা! মদিনা! মদিনা!
তোমায় ছাড়া আর কারেও ভালোবাসি না।
‘মদিনা! তব আর একটা নাম কি
কেউ বলে ‘হাসনাহেনা’, আমি তোমায় ‘মদিনা’ বলে ডাকি।
মদিনা! আমি তোমায় ছাড়া আর কারেও জানি না॥
মদিনা! তুমি রইবে চিরদিন মোর ঘরে এসে
তোমায় আমায় মিলন হবে ভালোবেসে।
‘মদিনা!’ আমার ছেলে দুটির ডাক নাম ‘সানি’ ও ‘নিনি’
ওরা দুটি ভাই,
‘সানি’ ও ‘নিনি’রে যেন আপন ছেলের মতো ভালোবেসো
এই আমি চাই।
আমি নওজোয়ান, আমি কবি সুন্দর, সুন্দরের পূজারি,
আমায় ভালোবাসে বাংলার সব নরনারী।
আমার কথার ফুলে ‘মদিনা’
তোমার গানের ডালা সাজাই।
মদিনা! মদিনা! মদিনা!
তোমায় ছাড়া আর কারেও ভালোবাসি না।
মম তনুর ময়ূর সিংহাসনে এ রূপকুমার কবি নৌজোয়ান
মম তনুর ময়ূর সিংহাসনে এ রূপকুমার কবি নৌজোয়ান।
মোর ঘুম যবে ভাঙিলে প্রিয়তম, উঠিল পূর্ণিমা চাঁদ
জ্যোৎস্নায় হাসিল আশমান॥
আমি ‘মদিনা’ হেরেমের নন্দিনী যে
আছি প্রাসাদে আছি বন্দিনী যে,
ভেবেছিনু তুমি শুধু রূপের পাগল
যদি সমান ভালবেসে থাকো
তা হলে আমায় শিখাও এসে তোমার গান॥
তুমি অনেক ছবি এঁকেছ যে মম, মোরে দিলে যে মধু।
সেই মধু চেয়ে সেই মধু বুকে লয়ে বলি,
ফিরে এসো ফিরে এসো বঁধু।
আমার ঘরে এসো হে প্রেমিক বিরহী
কেন গান গেয়ে ফির ‘মদিনা’ ‘মদিনা’ কহি,
চলে গেছে বিষাদের বিলাপ
ভাঙাও এসে মোর অভিমান॥
মহুয়া বনে আধো নিশীথ রাতে বেণুকা বাজায়ে
মহুয়া বনে আধো নিশীথ রাতে বেণুকা বাজায়ে
ডাকে গো মোরে কোন বিরহী।
সে মানা মানে না, সখী সে কি জানে না
আমি ভবনের বধূ, বন-বালিকা নহি॥
বন-কেতকী বলে, তারে চাতকী জানে
তাই কাঁদিয়া মরে চেয়ে মেঘের পানে।
বলে যমুনার জল,ওর ডাক সে যে ছল
তাই রোদনের স্রোত হয়ে অকূলে বহি॥
মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল
মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল
(যেন) বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম, আজও করে ঝলমল॥
কত সম্রাট হল ধূলি স্মৃতির গোরস্থানে,
পৃথিবী ভুলিতে নারে প্রেমিক শাহজাহানে
শ্বেত মর্মরে সেই বিরহীর ক্রন্দন-মর্মর, গুঞ্জরে অবিরল॥
কেমনে জানিল শাহজাহান? প্রেম পৃথিবীতে মরে যায়!
(তাই) পাষাণ-প্রেমের স্মৃতি রেখে গেল পাষাণে লিখিয়া হায়?
(যেন) তাজের পাষাণ-অঞ্জলি লয়ে নিঠুর বিধাতা পানে
অতৃপ্ত প্রেম, বিরহী-আত্মা আজও অভিযোগ হানে,
(বুঝি) সেই লাজে বালুকায় মুখ লুকাইতে চায় শীর্ণা যমুনা-জল॥
রুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম কে বাজায়
রুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম কে বাজায়
জল-ঝুমঝুমি।
চমকিয়া জাগে ঘুমন্ত বনভূমি॥
দুরন্ত অরণ্যা গিরি-নির্ঝরিণী
রঙ্গে সঙ্গে লয়ে বনের হরিণী
শাখায় শাখায় ঘুম ভাঙায়
ভীরু মুকুলের কপোল চুমি।
কুহ কুহু কুহরে পাহাড়ি কুহু
পিয়াল-ডালে,
পল্লব-বীণা বাজায় ঝিরিঝিরি সমীরণ
তারই তালে তালে।
সেই জল-ছলছল সুরে জাগিয়া
সাড়া দেয় বন পারে বাঁশি রাখালিয়া;
বউ কথা কও কোকিল পাপিয়া
পল্লির প্রান্তর ওঠে শিহরি
বলে, চঞ্চলা কে গো তুমি
রেশমি চুড়ির তালে কৃষ্ণচূড়ার ডালে
রেশমি চুড়ির তালে কৃষ্ণচূড়ার ডালে
পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা ডেকে ওঠে পাপিয়া
আঙিনায় ফুল-গাছে
প্রজাপতি নাচে
ফেরে মুখের কাছে
আদর যাচিয়া॥
দুলে দুলে বনলতা কহিতে চাহে কথা
বাজে তারই আকুলতা কানন ছাপিয়া।
শ্যামলী কিশোরী মেয়ে
থাকে দূর নভে চেয়ে
কালো মেঘ আসে ধেয়ে
গগন ব্যাপিয়া॥
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
নাচিছে ঘূর্ণি বায়।
জল-তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল
ঢেউ তুলে সে যায়
দিঘির বুকে শতদল দলি,
ঝরায়ে বকুল চাঁপার কলি,
চঞ্চল ঝরনার জল ছলছলি
মাঠের পথে সে ধায়॥
বনফুল আভরণ খুলিয়া ফেলিয়া
আলুথালু এলোকেশ গগনে মেলিয়া
পাগলিনি নেচে যায় হেলিয়া দুলিয়া
ধূলি-ধূসর কায়॥
ইরানি বালিকা যেন মরু-চারিণী
পল্লবী প্রান্তর বন-মনোহারিণী
ছুটে আসে সহসা গৈরিক-বরনি
বালুকার উড়নি গায়॥
শোনো ও সন্ধ্যামালতী বালিকা তপতী
শোনো ও সন্ধ্যামালতী
বালিকা তপতী–
বেলাশেষের বাঁশি বাজে।
মাধবী চাঁদের মধুর মিনতি
উদাস আকাশ-মাঝে॥
তব মৌন ব্রত ভাঙো, কও কথা কও,
মোর নৃত্য-আরতির সঙ্গিনী হও!
মাধবী হেনা হেরো এল বাহিরে –
রস-রাজে হেরি রাস-নৃত্যের সাজে॥
তুমি যার লাগি সারা দিন বিরহ-ধ্যান -লীন
একাকিনী কুঞ্জে,
হেরো সে মাধব নিশীথ ভ্রমর হয়ে
তব পাশে গুঞ্জে।
হেরো সুন্দর দাঁড়ায়ে তব দ্বারে আঁধারে,
মঞ্জরি-দীপ জ্বালো, ডাকো তারে
বুকের চন্দন-সুরভি ঢালো
পাতার আঁচলে মুখ ঢেকো না লাজে॥