একা ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে কে
একা ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে কে
ভ্রমর-কুন্তলা কিশোরী?
আধেক অঙ্গ জলে, রূপের লহর তোলে
সে ফুল দেখে বেভুল সিনান বিসরি॥
একি নতুন ছবি,আঁখিতে দেখি ভুল,
কমল ফুল যেন তোলে কমল ফুল
ভাসায়ে ঝিলের জলে অরুণ গাগরি।
ঝিলের নিথর জলে আবেশে ঢল ঢল
গলে পড়ে সে শত তরঙ্গে,
শারদ আকাশে দলে দলে আসে
মেঘ-বলাকা খেলিতে সঙ্গে!
আলোক-মঞ্জরি প্রভাত-বেলা
বিকশি জলে কি গো করিছে খেলা?
আবেশে বুকের আঁচলে ফুল উঠিছে শিহরি॥
এল ফুলের মহলে ভোমরা গুনগুনিয়ে
এল ফুলের মহলে ভোমরা গুনগুনিয়ে
ও-সে কুঁড়ির কানে কানে কি কথা যায় শুনিয়ে॥
জামের ডালে কোকিল কুতূহলে,
আড়ি পাতি ডাকে কূ কূ বলে
হাওয়ায় ঝরা পাতার নূপুর বাজে রুনঝুনিয়ে॥
ধীরে সখা ধীরে – কয় লতা দুলে
জাগিয়ো না কুঁড়িরে, কাঁচা ঘুমে তুলে–
গেয়ো না গুন গুন গুন গুন সুরে
প্রেমের ঢুলে ঢুলে।
নিলাজ ভোমরা বলে, ‘না-না-না-না’
– ফুল দুলিয়ে॥
এসো এসো বন-ঝরনা উচ্ছল-চল-চরণা
এসো এসো বন-ঝরনা উচ্ছল-চল-চরণা।
সর্পিল ভঙ্গে লুটায়ে তরঙ্গে
ফেন-শুভ্র ওড়না॥
পাষাণ জাগায়ে এসো নির্ঝরিণী
এসো যৌবন-চঞ্চলা জল-হরিণী,
মরু-তৃষিতের প্রাণে ঢালো ধারা-জল
শ্যাম-মেঘ বরনা॥
এসো বুনো পথ বেয়ে সুমধুর গান গেয়ে
গভীর অরণ্যের মৌন-ব্রত ভেঙে ভয়হীন পাহাড়ি মেয়ে
নৃত্যপরা পায়ে ছন্দ আনো
আনন্দ আনো মৃত-প্রাণ জাগানো।
অনাবিল হাসির ঝরা ফুল ছড়ায়ে
এসো মঞ্জুলা মনোহরণা॥
কার মঞ্জীর রিনিঝিনি বাজে – চিনি চিনি
সিন্ধুড়া–কাওয়ালি
কার মঞ্জীর রিনিঝিনি বাজে – চিনি চিনি
কার মঞ্জীর রিনিঝিনি বাজে – চিনি চিনি
প্রাণের মাঝে সদা শুনি তারই রাগিণী –
চিনি চিনি॥
বন-শিরীষের জিরিজিরি পাতায়
ধীরে ধীরে ঝিরিঝিরি নূপুর বাজায়,
তমাল ছায়ায় বেড়ায় ঘুরে মায়া-হরিণী।
চিনি চিনি॥
আমার গানে তারই চরণের অনুরণনে
ছন্দ জাগে রসে গন্ধে রূপে বরনে ।
কান পেতে রই দুয়ার-পাশে
তারই আসার আভাস আসে,
ঝংকার তোলে মনের বীণায় বীণ-বাদিনী–
চিনি চিনি॥
গত রজনির কথা পড়ে মনে
গত রজনির কথা পড়ে মনে
রজনিদগন্ধার মদির গন্ধে।
এই সে ফুলেরই মোহন-মালিকা
জড়ায়ে ছিল সে কবরী-বন্ধে॥
বাহুর বল্লরি জড়ায়ে তার গলে
আধেক আঁচলে বসেছি তরুতলে,
দুলেছে হৃদয় ব্যাকুল ছন্দে॥
মুখরা ‘বউ কথা কও’ ডেকেছে বকুল-ডালে
লাজে ফুটেছে লালি গোলাপ কুঁড়ির গালে।
কপোলের কলঙ্ক মোর মেটেনি আজো যে সই
জাগিছে তারই স্মৃতি চাঁদের কপোলে ওই।
কাঁদিছে নন্দন আজি নিরানন্দে॥
গোধূলির রং ছড়ালে কে গো আমার সাঁঝ গগনে
৪১
মাঢ়-খাম্বাজ-মিশ্র–দাদরা
গোধূলির রং ছড়ালে কে গো আমার সাঁঝ গগনে
গোধূলির রং ছড়ালে কে গো আমার সাঁঝ গগনে
বিবাহের বাজল বাঁশি আজি মোর নৌজোয়ানি জীবনে॥
নতুন করে আমার বাঁচিবার সাধ জাগে
সুন্দর লাগে ধরা মোর আনন্দিত নয়নে॥
ঘরে যদি এলে প্রিয়
২৪
মাঢ়-মিশ্র–কারফা
ঘরে যদি এলে প্রিয়
ঘরে যদি এলে প্রিয়
নাও একটি খোঁপার ফুল।
আমার চোখের দিকে চেয়ে
ভেঙে দাও মনের ভুল॥
অধর কোণের ঈষৎ হাসির আলোকে
বাড়িয়ে দাও আমার গহন কালোকে
যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে
দুলিয়ে যেয়ো দুল॥
একটি কথা কয়ে যেয়ো, একটি নমস্কার,
সেই কথাটি গানের সুরে গাইবো বারবার
হাত ধরে মোর বন্ধু ভুলো
তোমার মনের সকল ভুল॥
চৈত্র পূর্ণিমা রাত্রি, মাধবী-কানন মধুক্ষরা
চৈত্র পূর্ণিমা রাত্রি, মাধবী-কানন মধুক্ষরা
মধুর আনন্দ-উল্লাসে রাত্রে ভাসে বসুন্ধরা॥
মুকুল-সৌগন্ধ ভারে দখিনা পবন
নৃত্যের ছন্দে চলে মর্মরিয়া বেণু-বন।
তটিনী ঊর্মির মর্ম নিয়া
শত ভঙ্গে চন্দ্র নিবেদিয়া
দুর্নিবার প্রেমোচ্ছ্বাসে কণ্ঠ-কল-গীতে ভরা॥
মধুর পূর্ণিমা নিশি, পূর্ণপাত্র শিরাজি হস্তে যেন সাকি,
জ্যোৎস্নার মদির স্বপ্নে মুকুলিত মাধবীর আঁখি।
গোলাপের স্নিগ্ধগন্ধে অস্থির অন্তর,
আজি রাত্রে হাসিছে সমাহিত প্রসন্ন সুন্দর।
পরিতৃপ্ত চকোরের রুদ্ধ-কণ্ঠ লভিতে চন্দ্রের
পান করি শারাব গেলাস-ভরা।
ছড়ায়ে বৃষ্টির বেল-ফুল
ছড়ায়ে বৃষ্টির বেল-ফুল
ঝরায়ে দোলন-চাঁপা বকুল
দুলায়ে মেঘলা চাঁচর-চুল
চপল চোখে কাজল মেখে আসিল কে॥
ছিটিয়ে জল বাজায়ে কে মেঘের মাদল
একা ঘরে বিজলিতে এমন হাসি হাসিল কে॥
এলে কি গো দুরন্ত মোর ঝোড়ো হাওয়া
চির-বিরহী প্রিয় মধুর পথ-চাওয়া
হৃদয়ে মোর দোলা লাগে
ঝুলনেরই আবেশ জাগে
ভুলে যাওয়া আমারে আবার
ভালোবাসিলে কে॥
তোমার গানের চেয়ে তোমায় ভালো লাগে আরও
তোমার গানের চেয়ে তোমায় ভালো লাগে আরও
(মোর) ব্যথায় আস প্রিয় হয়ে, কথায় যখন হারো।
(তব) সুর যবে দূরে যায় চলে
তখন আস মোর আঁখির জলে
ভালোবাসায় যে মধু দাও বঁধু
তা কি ভাষায় দিতে পার॥
আমায় যখন সাজাও সুরে ছন্দ অলংকারে
তখন তুমি থাক যেন কোন গগনের পারে।
গান থামিয়ে একলা ঘরে
আস যখন আমার তরে
সেই তো আমার আনন্দ, তাহা ছন্দে দিতে পার॥
দুরন্ত বায়ু পূরবইয়াঁ
৩৭
কাফি-সিন্ধু–কাহারবা
দুরন্ত বায়ু পূরবইয়াঁ
বহে অধীর আনন্দে।
তরঙ্গে দুলে আজি নাইয়াঁ
রণ-তুরঙ্গ ছন্দে॥
অশান্ত অম্বর-মাঝে
মৃদঙ্গ গুরুগুরু বাজে,
আতঙ্কে থরথর অঙ্গ
মন অনন্তে বন্দে॥
ভুজঙ্গী দামিনীর দাহে
দিগন্ত শিহরিয়া চাহে,
বিষণ্ণ ভয়-ভীতা যামিনী
খোঁজে সে তার ছন্দে॥
মালঞ্চে এ কী ফুল-খেলা,
আনন্দে ফোটে যুথি বেলা,
কুরঙ্গী নাচে শিখী-সঙ্গে
মাতি কদম্ব-গন্ধে॥
একান্তে তরুণী তমালী
অপাঙ্গে মাখে আজি কালি,
বনান্তে বাঁধা পল দেয়া
কেয়া-বেণির বন্ধে॥
দিনান্তে বসি কবি একা
পড়িস কি জলধারা-লেখা,
হিয়ায় কি কাঁদে কুহু-কেকা
আজি অশান্ত দ্বন্দ্বে॥