- বইয়ের নামঃ মদিনা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত-দেহা, চির-চেনা
অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত-দেহা, চির-চেনা,
ফোটাও মনের বনে তুমি বকুল হেনা
চির-চেনা॥
যৌবন-মদ-গর্বিতা তন্বী
আননে জ্যোৎস্না, নয়নে বহ্নি,
তব চরণের পরশ বিনা
অশোক তরু মুঞ্জরে না, চির-চেনা॥
নন্দন-নন্দিনী তুমি দয়িতা চির-আনন্দিতা,
প্রথম কবির প্রথম লেখা তুমি কবিতা।
নৃত্য-শেষের তব নূপুরগুলি হায়
রয়েছে ছড়ানো আকাশে তারকায়,
সুর-লোক-উর্বশী হে বসন্ত-সেনা! চির-চেনা॥
আজ নিশীথে অভিসার তোমারই পথে
আজ নিশীথে অভিসার তোমারই পথে,
প্রিয়তম,
বনের পারে নিরালায় দিয়ো হে দেখা,
নিরুপম॥
সুদূর নদীর ধারে নিরালাতে বালুচরে –
চখার তরে যথা একা চখী কেঁদে মরে,
সেথা সহসা আসিয়ো গোপন প্রিয়
স্বপন সম॥
তোমারই আশায় ঘুরি শত গ্রহে শত লোকে,
(ওগো) আমারই বিরহ জাগে বিরহী চাঁদের চোখে,
অকূল পাথার নিরাশার পারায়ে এসো
প্রাণে মম॥
আধো-আধো বোল
ভৈরবী পিলু–কারফা
আধো-আধো বোল
লাজে বাধো-বাধো বোল
বলো কানে কানে।
যে কথাটি আধো রাতে
মনে লাগায় দোল –
বলো কানে কানে॥
যে কথার কলি সখি আজও ফুটিল না
শরমে মরম-পাতে দোলে আনমনা,
যে কথাটি ঢেকে রাখে বুকের আঁচল –
বলো কানে কানে॥
যে কথা লুকায়ে থাকে লাজ-নত চোখে
না বলিতে যে কথাটি জানাজানি লোকে
যে কথাটি ধরে রাখে অধরের কোল–
বলো কানে কানে॥
যে কথা বলিতে চাহ বেশভূষার ছলে,
যে কথা দেয় বলে তব তনু পলে পলে,
যে কথাটি বলিতে সই গালে পড়ে টোল –
বলো কানে কানে॥
আনো গোলাপ-পানি আনো আতরদানি গুলবাগে
আনো গোলাপ-পানি আনো আতরদানি গুলবাগে
সহেলি গো খুব ভালো লাগে, সুমধুর লাগে॥
বেদুইনি ছেলের বাঁশি কারে ডাকে
হেসে হেসে অনুরাগে॥
মরুযাত্রীদের উটের সারি
যেমন চাহে তৃষ্ণার বারি
তেমনই মম পিয়াসি পরান
যেন কার প্রেম-অমৃত বারি মাগে॥
চাঁদের পিয়ালাতে জোছনা-শিরাজি ঝরে যায়
আমারি হৃদয় সুমধুর সে মধু পায়।
হায় হায়! বাদাম গাছের আঁধার বনে
মধুর নিশ্বাস ওঠে বুলবুলির শিসের সনে।
বিরহী মোদের কোথায় হাসে কোন মদিনাতে
ফোরাত নদীর স্রোতের সম বুকে ঢেউ জাগে॥
আবার ভালোবাসার সাধ জাগে
আবার ভালোবাসার সাধ জাগে।
সেই পুরাতন চাঁদ আজি নতুন লাগে মধুর লাগে॥
যে ফুল দলিয়াছি নিঠুর পায়ে
সাধিয়া তারে বুকে জড়ায়ে
উদাসীন হিয়া হায় রেঙে ওঠে অবেলায়
সোনার গোধূলি-রাগে॥
আবার ফাগুন-সমীরণ কেন বহে
আবার ভুবন ভরি বেজে ওঠে বাঁশরি অসীম বিরহে।
তপোবনের বুকে ঝরনার সম
কে এলে সহসা নিরুপম,
তোমার নূপুর-ধ্বনি প্রাণে ওঠে অনুরণি
সহসা কে এলে প্রিয়তম আমার হৃদয়-বৃন্দাবনে
সহসা রাঙাইলে কুঙ্কুম-ফাগে॥
আমার গানের মালা আমি
আমার গানের মালা আমি
করব তারে দান।
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
মোর করুণ অভিমান॥
চোখে সজল কাজল-লেখা
কণ্ঠে ডাকে কুহু-কেকা
কপোল যার অশ্রু রেখা
একা যাহার প্রাণ।
মালা করব তারে দান॥
শাখায় ছিল কাঁটার বেদন
মালায় ছিল সূচির জ্বালা,
কণ্ঠে দিতে খুশি হই আমি
মোর আনন্দের মালা।
বিরহে মোর প্রেম-আরতি
জ্যোতির্লোকের অরুন্ধতী
তার তরে মোর এই গান
মালা মোর করব তারে দান॥
আমি ‘মদিনা’ মহারাজার মেয়ে, সকলের জানা আছে
আমি ‘মদিনা’ মহারাজার মেয়ে, সকলের জানা আছে।
নওজোয়ান! তুমি কার ছেলে তুমি কেন এলে মোর কাছে॥
আমি গান গাইতে জানি
তুমি কি গান লিখতে জান?
তা হলে তুমি বাড়ি গিয়ে
আমার তরে অনেক গান লিখে আনো;
তা হলে তোমায় মালা গেঁথে দিব
মোর গুলবাগানে অনেক ফুল ফুটেছে ফুলের গাছে॥
তুমি মহারাজার, বাদশার ছেলে হও,
তাহলে আমার ঘরে এসে কথা কও।
তব ভালো নাম কি হে কবি
তা হলে আঁকব আমি তোমার ছবি
আমি পর্দানশিন কুমারী, মোরে এখন কেউ নাহি যাচে॥
আরক্ত কিংশুক কাঁপে। মালতীর বক্ষ ভরি
আরক্ত কিংশুক কাঁপে। মালতীর বক্ষ ভরি
চন্দ্রের অমৃত-স্পর্শে উঠিতেছে শিহরি শিহরি॥
নীরব কোকিলের গুঞ্জন
চৈত্র পূর্ণিমা রাত্রি, বাড়িয়াছে বক্ষের স্পন্দন।
মোদের নাচের নূপুরের ছন্দ
কভু চপল কভু মৃদু-মন্দ,
বসন্ত-উৎসব-সজ্জা অন্তরাল হতে মৃদু ভাষে
সুন্দর গুঞ্জন-ধ্বনি কেন ভেসে আসে।
মমতার মধু-বিন্দু, ক্ষরিল মোরা মধু খেয়ে বলিলাম–আহা মরি॥
ধরণির অঙ্গ হতে বাসরের সজ্জা পড়ে খুলি
গভীর আনন্দে মোরা চাহি দুটি আঁখি তুলি।
চৈত্রের পূর্ণিমা রাত্রি এল ফিরি
প্রিয়, তুমি কেন চলে গেলে ধীরি ধীরি।
তুমি ফিরে এলে মোরা লভিলাম অমৃতের স্বাদ
চন্দ্রের অমিয়া পান করি॥
ইরানের রূপ-মহলের শাহজাদি শিরীঁ! জাগো
ইরানের রূপ-মহলের শাহজাদি শিরীঁ! জাগো
জাগো শিরীঁ
‘প্রিয়া জাগো’ বলে তোমার প্রিয়তম
ডাকে শোনো আগে রাতে ধীরে ধীরে॥
(তুমি) ধরা দিবে বলেছিলে বে-দরদি
(যদি) পাহাড় কাটিয়া আনিতে পার নদী।
হেরো গো শিলায় আজি উঠিয়াছে ঢেউ
(সেথা) তব মুখ ছাড়া নাহি আর কেউ,
প্রেমের পরশে যেন মোমের পুতুল হয়েছে পাষাণ গিরি॥
গলিল পাষাণ, আমি তোমার প্রিয়তম ফিরে এলাম বিরহী বিবাগী
তোমার দেখার লাগি
তুমি আমার প্রিয়তমা হও আমার পানে চাহো ফিরি
এসো শিরী! এসো শিরী!!