এদের জীবনে এদের সাহেবের আদেশ ছাড়া কোন কিছুই কার্যকর হয় না।আমি অনেক চিকিৎসক মেয়ের কথা জানি,এরা স্বামীর বিদেশে চাকরির নিসচয়তা এবং নিজের চাকরির অনিসচয়তা নিয়ে কেবল স্বামীর সংগী হিসেবে বিদেশে পাড়ি দেন। এরপর যে ঘটনাটি ওখানে ঘটে তা হলো,স্বামী সাহেবটি দিব্যি চাকরি করেন এবং স্ত্রী বেচারা রান্না ঘরে পেঁয়াজ কাটেন অথবা ফিরনি রান্না করেন। চিকিৎসার বদলে রন্ধন শিল্পের পিছনে পাঁচ ছ’ বছর খাটা-খাটনি করলে এদের বর্তমান জীবন অধিকতর আনন্দময় হতো সন্দেহ নেই।
কোনও কোনও মেয়ে বড় আহ্লাদ করে বলেন আমার স্বামী চাকরি করা পছন্দ করেন না।তাঁর স্বামী মাছ খেতে পছন্দ করে না সুতরাং তার মাছ রান্না করা বারণ,তার স্বামী বেড়াতে পছন্দ করেননা তাই তার বেড়াতে যাওয়া বারণ,তাঁর স্বামী চাকরি করা পছন্দ করেন না তাই স্ত্রীর চাকরি করা বারণ। এক্ষেত্রে স্ত্রীর পছন্দ অপছন্দের তোয়াক্কা কিন্তু কেউ করে না।
৩.দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি এবং তাঁর স্ত্রী বিলেতে বার বছর থাকার পর দেশে এসেছেন এমন এক দূর আত্মিয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা শেষে আত্মীয়টি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন এবং বিলেতি অভ্যেস মত করমর্দন করলেন ভিসির সঙ্গে এবং হাত বাড়ালেন ভিসির স্ত্রীর দিকে।আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম, আমি স্পষ্ট দেখলাম ভিসির স্ত্রী , যার নাম আমি জানি না , ভিসির স্ত্রী বলেই তিনি পরিচিত,সম্ভবত নিজের নামের চেয়ে এই পরিচয় টিই তাকে অধিক আনন্দ দেয়, তাঁর ডান হাতের আঙ্গুলগুলো কুঁকড়ে এমন এক অবস্থা করেছেন যেন এই পাপ কাজে হাত বাড়াতে তাঁর মোটেও ইচ্ছা নেই,দু’বার তিনি আড়চোখে দেখলেন তাঁর সাহেব বা কর্তাটি তাঁর উপর অসন্তুষ্ঠ হচ্ছেন কিনা। তারপর ভিসির বাড়িতে কি ঘটেছে আমি জানি না। আমি কেবল আন্দাজ করতে পারি, আন্দাজ করতে পারি অপর পুরুষের করস্পর্শ স্ত্রীর জন্য কি পরিমান গর্হিত একটি কাজ।
৪. ডিসেম্বর মাস চলছে। আঠারো বছর আগে ন’মাস যুদ্ধের পর যে মাসে বাঁশের কঞ্চিতে গাঢ় সবুজের উপর লাল, লালের মধ্যে হলুদ মানচিত্র আঁকা একটুকরো কাপড় বেঁধে একঝাক শিশু সারা উঠোন জয় বাংলা বলে মিছিল করছি , সে মাস ডিসেম্বর মাস।
ময়মনসিংহ শহরে একাত্তরের মার্চ থেকে নভেম্বর অব্দি বড় মসজিদের ইমাম সাহেব নিজের হাতে মানুষ জবাই করে কুয়োয় ফেলেছে, এই মাসে কুয়ো থেকে অগণিত লাশ তুলে শহরবাসী খুঁজছে চেনা মুখ , আমার আত্মীয়রা খুঁজতে গিয়েছে যুদ্ধে যাওয়া , হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া স্বজন ।পাকিস্থানি সৈন্য আমাদের টাকাকড়ি লোট করেছে। যাবার আগে পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়ী ,আমার বাবাকে ধরে নিয়ে বুট ও বেয়নেট এ পিষছে, দুই কাকাকে গুলি করে ফেলে রেখেছে রাস্তার মোড়ে , আমার ভাইয়ের ডান চোখ উপড়ে নিয়ে গেছে। এই মাসে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া তিন মামার দুজন ফিরে এসেছে, ষোল দিন পর ক্যাম্প থেকে ফিরে এসেছে আমার একুশ বছর বয়সের খালা। পড়শি যারা যুদ্ধ করেছে , কারও হাত নেই , কারও পা। তবুও আত্মীয়রা ওদের ফেরার আনন্দে যে মাসে আত্মহারা হয়েছে সে মাস ডিসেম্বর মাস।
কেবল আমার খালার ফিরে আসা কেউ চায়নি। যেন ফিরে না এলেই সকলে স্বস্তি পেত। এতকাল গর্ব করে বলেছি আমার বাবা, ভাই, কাকা, মামার কথা, গর্ব করেছি আমাদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে। কিন্তু আমার খালার কথা এতটুকু উচ্চারণ করিনি। আজ সকল নিষেধের আওতা থেকে বেরিয়ে আমি গর্ব করে বলছি ক্যাম্পের অন্ধকার ঘরে আমার খালাকে দশজন পশুস্বভাবী কামুক একটানা ষোল দিন ধর্ষণ করেছে।
আমাদের সমাজ আমার খালাকে নিয়ে গর্ব করেনি। বড় বড় লোকজন কাগজপত্রে, সভাসমিতিতে ধর্ষিতা নারী নিয়ে বড় বড় কথা বলেছে। বীরঙ্গনা খেতাব দিয়ে উদারতার নামে এক ধরনের ফাজলামো করেছে।
যুদ্ধের সকল ভাঙ্গন, বুট ও বেয়নেটের নৃশংস অত্যাচার এবং মৃত্যুর মত বীভৎসতা সকলে গ্রহন করলেও ধর্ষণ নামক দুর্ঘটনাটি গ্রহন করেনি।
বাইরে যখন ধর্ষিতা মা বোনের সম্মান নিয়ে চিৎকার করছে রাজনীতির নেতারা, তখন অসম্মান থেকে নিজেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হিসেবে ঘরের কড়িকাঠে আমার খালা যে মাসে ফাঁসি নিয়েছে, সে মাস ডিসেম্বর মাস।
০৯. আদিলা বকুলের ভালবাসা
১. কবি অসীম সাহা মাঝে মধ্যেই আদিলা বকুলের প্রশংসা করে বলেন—আদিলার লেখার অভ্যোস ছিল। কিন্তু স্বামী রফিক আজাদকে আদিলা এত বেশি ভালবাসেন যে নিজের লেখালেখি পর্যন্ত ছেড়ে দেন। অসীম সাহা আদিলার এই সাহিত্য-ত্যাগের কথা বেশ গুছিয়ে বর্ণনা করেন। আদিলা বকুল রফিক আজাদকে ভালবাসেন, কিন্তু এতে তার লেখা ছেড়ে দেবার এবং লেখা ছেড়ে দিলে ভালবাসার ওজন বৃদ্ধি পাবার কোনও কারণ আমি দেখি না।
আসলে মেয়েদের কিছু ত্যাগ দেখলে ছেলেরা বড় খুশি হয়। একটি ছেলের জন্য মেয়ে তার আত্মীয়-স্বজন ত্যাগ করলে ছেলের আনন্দ আর ধরে না। স্বামী গান গাওয়া পছন্দ করে না বলে মেয়ে গানের সকল সম্ভাবনার ইতি ঘটালে ছেলে বড় আহ্লাদিত হয়।
যে মেয়ে নাচে কিংবা ছবি আঁকে তার নাচ-ছবি আঁকা বন্ধ করে স্বামী বড় গর্ব করে বলেন যে তার স্ত্রীকে বিয়ের পর তিনি আর নাচতে কিংবা ছবি আঁকতে দেন না। স্বামী লেখেন বলে আদিলার না লেখার মধ্যে কবি অসীম সাহা ভালবাসার তীব্রতা খুঁজে পেয়েছেন।