কী শেখেছে তাঁর অগুণতি পাঠক এবং তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ অনুসারী? শিখেছে এই যে, তিন কন্যা যথেষ্ট নয়, একটি পুত্রই সন্তান হিসেবে সম্পূর্ণ এবং একটি পুত্র জন্মানোর আগে উৎপাদন বন্ধ করা অনুচিত। শিখেছে শরীরে ও মনে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠলেও নারীর পঙ্গুত্ব কাটে না। তাই লিখতে গেলে বড় বড় নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ, কিন্তু স্বভাবে চরিত্রে এই নীতির চর্চা সম্ভব নয়।
এ কথা নারী সবচেয়ে বেশি জানে যে তার জন্ম অনাকাঙ্খিত। একটি দু’টি পুত্রের পর যদি কন্যা জন্মে তবে সেই কন্যা-জন্মে কেউ হয়ত রুষ্ট হয় না। কিন্তু কন্যা কখনও একক ও সম্পূর্ণ রূপে কোনও দম্পতির প্রার্থিত নয়। আমাদের খ্যাতিমান সাহিত্যিকও আর দশজন মানুষের মত পুত্র প্রত্যাশী। তার মন ও মেঘার স্তর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মূর্খ মানুষের স্তর ডিঙিয়ে সামাণ্যও উর্ধ্বে ওঠেনি।
২. নারীর প্রতি ঘৃণা যাঁর প্রবচনের প্রধান উপাদেয় বিষয়, নারীকে অশ্রদ্ধা এবং অকথ্য অপমান করা যাঁর স্বভাবের হাড়মজ্জার অন্তর্গত সেই নারীবিদ্বেষী পুরুষই ‘নারীবাদী গ্রন্থ’ লিখবার কৃতিত্ব অর্জন করতে আগ্রহী। কৃতিত্ব সবসময় খুব সুস্বাদু জিনিস। নারীকে হেয় করে প্রবচন রচনা করবার কৃতিত্ব যে পুরুষ একবার অর্জন করেছেন, সে পুরুষই নারীবাদী গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব অর্জন করেন–এই চূড়ান্ত স্ববিরোধী আচরণে ‘কৃতিত্ব’ই একমাত্র উপার্জন। নারীকে একবার গালে চড় দিয়ে আনন্দে তাঁরা হাততালি দেন, আরেকবার চুমু দিয়ে উল্লাসে নৃত্য করেন। মূলত নারী নিয়ে তাঁরা খেলা করেন। তাঁরা নারীকে যখন খুশি ভাঙেন, যেমন ইচ্ছে গড়েন। নারী নিয়ে এই মজাদার খেলা খেলবার কৃতিত্ব পুরুষের জন্য বীরত্বের সম্মন বয়ে আনে নিশ্চয়ই।
তাছাড়া বাণিজ্যও হচ্ছে। এদেশে নারী নিয়ে বাণিজ্য করতে গেলে কোনও মেধা বা পুঁজির দরকার হয় না, কিন্তু ফলাফল লাভজনক। নারী নিয়ে বাণিজ্য করে আজ অবধি কারও ক্ষতি হয়নি, বরঙ অর্থ-যশ-খ্যাতি প্রতিপত্তি সকল কিছুই বেড়েছে।
এই নারী বিদ্বেষী ভাষাবিদেরও সম্ভবত ইহকাল সমৃদ্ধ হবে।
৩. এদেশের এক স্বনামধন্য কবির কথা জানি–কবি তখন দ্বিতীয় বিয়ে করবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, প্রথম স্ত্রীকে তিনি তালাকনামা লিখে দেবার জন্য চাপ দিচ্ছেন প্রতিদিন–কবি তাঁর স্ত্রী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হতে চাচ্ছেন, এতে দেন মোহরের টাকার ঝামেলা থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, স্ত্রী এই প্রস্তাবে রাজী না হলে প্রখ্যাত কবিটি স্ত্রীকে বলেন–‘আমি তোমার চরিত্রের দোষ ছড়িয়ে দেব চারদিকে। তুমি এখনও রাজি হও তা না হলে বলে বেড়াব তুমি একটা আস্ত বেশ্যা।’
নারীর চরিত্র এমনই এক অদ্ভুত জিনিস যে, ‘শারীরিক’ সম্পর্কই তাঁর চরিত্র ভাল-খারাপের মাপকাঠি। বিতরণের জন্য নারীর চারিত্রিক দোষ যতটা উপযোগী, তত আর অন্য কিছু নয়।
সেই কবি শেষ অব্দি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীকে তিনি চরিত্র দোষের ভয় দেখিয়েছিলেন, যেন এই ভয়ে স্ত্রী তাঁর সকল প্রস্তাব মেনে নেন। চরিত্র তো আগলে রাখবার জিনিস, বিশেষ করে নারীর জন্য। এই মূল্যবান জিনিসটিকে আগলে না রাখলে নারীর আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। নারীর এই একটিমাত্র সম্পদ–এই সম্পদটিকে হাতছাড়া করলে তার আর সমাজে বেঁচে থাকা মানায় না। ‘সতীত্ব’ই নারীর চরিত্র বাঁচিয়ে রাখে। আগে ‘সতীদাহ’ করে নারীর সতীত্ব রক্ষা হত, আজকাল সতীদাহর নিয়ম নেই, ঘরের পুরুষ-প্রহরীরা নারীর সতীত্ব রক্ষা করে। তারাই নিজেদের প্রয়োজনে নারীকে কখনও ‘সতী’ এবং কখনও ‘অসতী’ বানায়। এই বানানোটা এত সহজ যে আমাদের খ্যাতিমান কবিও নিজের দ্বিতীয় বিয়ের প্রয়োজনে প্রথম স্ত্রীকে ‘অসতী’ বানিয়েছিলেন। এতে কারও লজ্জা হয় না, দ্বিধা হয় না, সঙ্কোচ হয় না। সে যত বড় কবি বা চিত্রকরই হোন না কেন, সে যত বড় শিল্পী বা শিল্পপতিই হোন না কেন।
৪. আমাদের বুদ্ধিজীবিরা তাঁদের বুদ্ধির চর্চার সঙ্গে কিছুটা মাজার চর্চা, কিছুটা নারীচর্চা বজায় রেখে জীবনযাপনে স্বাভাবিকতা আনেন। এতে করে দেশের নির্বোধ জনগণের কাতারে দাঁড়ানোও হয় এবং সকলের একজন বলে দাবী করবার মধ্যেও এক ধরনের গৌরব হয়। আমাদের বুদ্ধিজীবিরা এই গৌরব থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে কিছুতেই রাজি নন।
৭৮. কুমারীর ব্রত
কুমারী শব্দটির অর্থ অবিবাহিত নারী। দশ থেকে ষোল বছর বয়সের অনূঢ়া কন্যাকেও কুমারী বলে। কুমারী নারীর প্রতি পুরুষের প্রবল আকর্ষণ সমাজের সর্বত্র বিরাজমান। পুরুষের আকর্ষণ যেন কিছুতেই হ্রাস না পায় এবং ঈশ্বরও যেন কুমারীর প্রতি বিশেষ নজর রাখেন—তাই সমাজের ভাল মানুষেরা কুমারী মেয়েদের সতীত্ব রক্ষার ব্যাপারে নানাবিধ উপদেশ বর্ষণ করেন এবং ‘ব্রত’ পালনের ব্যবস্থা করেন। হিন্দু ধর্মে কুমারীদের জন্য বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন ব্রতের নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। বৈশাখ মাসে শিবব্রত, পুণ্য পুকুর, দশ পুতুল, হরির চরণ, অশ্বখ পাতা, গোকুল ও পৃথিবী ব্ৰত; কার্তিক মাসে যম পুকুর ব্ৰত; অগ্রহায়ণ মাসে–সেঁজুতির ব্ৰত; পৌষ মাসে তুঁষ-তুষলী ব্ৰত; এইসব ব্রতে নানারকম মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। প্রতিটি মন্ত্রের মূল কথা—সতী হওয়া, স্বামী পাওয়া, পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়া, ভাল রাঁধুনি হওয়া, সধবা অবস্থায় মৃত্যু হওয়া এবং সাত ভাইয়ের এক বোন হওয়া। পুণ্যি পুকুর ব্রতে পুকুরে জল ঢালবার মন্ত্র—পুণ্যি পুকুর পুষ্প-মালা/কে পূজেরে দুপুর বেলা?/আমি সতী লীলাবতী/সাত ভা’য়ের বোন ভাগ্যবতী।/এ পূজলে কি হয়?/নির্ধনীর ধন হয়।/সাবিত্রী—সমান হয়।/স্বামী আদরিণী হয়৷/পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে।/ মরণ-যেন হয় গঙ্গাজলে॥/দশ পুতুল ব্রত করতে হয় মেয়েদের পাঁচ বছর বয়স থেকে। এই ব্রতের মন্ত্র—এবার মরে মানুষ হব, রামের মত পতি পাব।/এবার মরে মানুষ হব, সীতার মত সতী হব।/এবার মরে মানুষ হব, দশরথের মত শ্বশুর পাব।/এবার মরে মানুষ হব, কৌশল্যার মত শাশুড়ি পাব। এবার মরে মানুষ হব, কুন্তীর মত পুত্রবতী হব। এবার মরে মানুষ হব, দ্রৌপদীর মত রাঁধুনি হব৷/এবার মরে মানুষ হব, পৃথিবীর মত ভার সব।