নারীর মোহ আছে, কিন্তু মোহের বর্ণনা নেই। পুরুষের অঙ্গ দেখে নারীর শিহরণ লাগছে—এই সত্য উচ্চারণ আমি কোনও নারীর মুখে শুনিনি। কিন্তু নারীর কোনও অঙ্গ দেখে বা ছয়ে পুরুষের কী ধরনের পুলক লাগে–তা এত ভাষায়, এত বিশদ বর্ণনায়, এত নিদ্বিধায় উচ্চারিত হয়েছে এতকাল যে নির্দিষ্ট করে কিছু উল্লেখ করবার দরকার হয় না।
আমি নারী চিত্রকরকে দেখি নারীর কামময় ছবি আঁকছে, আমি নারী ঔপন্যাসিককে দেখি নারীর রূপ বর্ণনায় অবিকল পুরুষের মতই সিদ্ধহস্ত। তবে পুরুষের রূপের বর্ণনা করবে কে? পুরুষের শরীর থেকে দুৰ্গন্ধ দূর করবার পরামর্শ দেবে কে? পুরুষের শরীরকে এমনই আকর্ষক দ্রব্যে তৈরি করা উচিত, যেন তারা রোজ সাবান মেখে শরীর পরিচ্ছন্ন রাখে, যেন নারী তাদের শরীরে কোনও ধুলো ময়লার অস্তিত্ব না দেখে। যেন তারা চুলের চাষে ও চর্চায় মনোনিবেশ করে, যেন তার ত্বককে সতেজ ও কোমল রাখে, উরুকে সুঠাম ও নিতম্বকে সুগঠিত রাখে, যেন তারা বুককে লোমশ ও প্রশস্ত রাখে, যেন তারা পা ও পায়ের গোড়ালিকে মসৃণ ও তাজা রাখে। পুরুষের শরীরকে পণ্য করে তুললে পুরুষের ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন ও বিক্রিও বেশ জমজমাট হবে।
ক্রেতা কেবল চিরকাল এক পক্ষই কেন? ক্রেতা এবং বিক্রেতা তাদের পণ্য নিয়ে উল্টো দিকে বিক্রেতা ও ক্রেতাও বটে। তা না হলে এই বাণিজ্যের জগতে এক পক্ষেরই কেবল লাভ, ক্ষতি অন্য পক্ষের।
নারীর জন্য এখন চমৎকার চাহিদা হোক কামরাঙার মত পুরুষের ঠোঁট, মরিচ-চেরা কালো চোখ, করমচার মত জিভ, কাঠালের কোষের মত গায়ের রঙ, নাশপাতির মত দাঁত, মাচার লাউ-এর মত সুঠাম উরু, রজনীগন্ধার মত গায়ের ঘ্রাণ। নারীর চাহিদামাফিক পুরুষ এখন সর্বাঙ্গে উপযুক্ত হয়ে উঠুক। সম্পূর্ণ হয়ে উঠুক। নারীর শরীরের প্রতি তৃষ্ণ যদি পুরুষের জন্য বৈধ হয়ে থাকে—তবে কেন একইভাবে নারীর জন্যও বৈধ নয় পুরুষের সর্বাঙ্গ? কেন নারী উচ্চারণ করতে লজ্জাবোধ করে এই কথা–তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাদে প্রতি অঙ্গ মোর? পুরুষ তো এ কথা লিখতে লজ্জা করেনি।
ফুল ও ফলের সঙ্গে নারী অঙ্গের তুলনা চলে। ফুল ও ফলের আয়ু খুব অল্প, ঘ্ৰাণ নিলে, খেলে ফুল ও ফল দুটোই আবর্জনার ঝুড়িতে চলে যায়, একই রকম নারীও। নারীকেও খেয়েদেয়ে এঁটো-কাটার মতই ফেলে দেওয়া হয়। পুরুষকে কেউ শত খেলেও ছিবড়ে হয় না, কারণ সে ফুল বা ফল নয়, সে মানুষ। এক্ষেত্রে নারীও যে ফুল বা ফল নয়, সেও যে মানুষ তা বোঝাতে গেলে মানুষ নামের পুরুষকেও একই কাতারে নামিয়ে এনে তাকেও ফুল বা ফলের উপমায় দাঁড় করতে হবে, যেন প্রমাণ হয়—ফুল ও ফল যদি কারুকে বলা যায় তবে নারী ও পুরুষ দু’জনকেই বলা যায়। আর না হলে কারুকেই নয়।
৭৪. রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা
এ কথা আমি বিশ্বাস করি না যে রুদ্র নেই। রুদ্র মিঠেখালির চিংড়ি খামারে নেই, মোংলা বন্দরে নেই, রাজাবাজারে নেই, বিকেলে অসীম সাহার প্রেস, সন্ধ্যায় রামপুরার সঙ্গীত পরিষদ–কোথাও রুদ্র নেই। আমি বিশ্বাস করি না রুদ্র আর মঞ্চে উঠবে না, কবিতা পড়বে না। কাঁধে কালো ব্যাগ নিয়ে রুদ্র আর হাঁটবে না, রুদ্র আর কথা বলবে না, হাসবে না, কবিতা পরিষদ–সাংস্কৃতিক জোট নিয়ে ভাববে না, নতুন কোনো সংগঠন গড়বে না। এ আমার বিশ্বাস হয় না রুদ্র নেই, একুশের মেলায় নেই, চায়ের স্টলের আড্ডায় নেই, বাকুশায় নেই, সাকুরায় নেই।
রুদ্রকে আমি আমার সতেরো বছর বয়স থেকে চিনি। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে রুদ্র আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল। আমাকে যে মানুষ অল্প অল্প করে জীবন চিনিয়েছে, জগৎ চিনিয়েছে–সে রুদ্র। আমাকে যে মানুষ একটি একটি অক্ষর জড়ো করে কবিতা শিখিয়েছে–সে রুদ্র। করতলে আঙুলের স্পর্শ রেখে রুদ্র আমাকে প্রথম বলেছে–ভালোবাসি। বলেছে–আমরা জ্বলাবো আলো কৃষ্ণপক্ষ পৃথিবীর তীরে, জীবনে জীবন ঘষে অপরূপ হৃদয়ের আলো।
রুদ্র আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। যে আমি কেবল নদীই দেখেছি, সেই আমাকে উথল সমুদ্র যেমন দেখিয়েছে, ঘোলা জলাশয়ও কিছু কম দেখায়নি। রদ্র আমাকে পূর্ণিমা দেখিয়েছে জানি, অমাবস্যাও কিছু কম নয়। রুদ্রর হাত ধরে আমি খোলা মাঠে হাওয়ায় হাওয়ায় নেচেছি, গহন অরণ্যে হেঁটেছি আর আঠারো, উনিশ, বিশ, একুশ করে বয়স পেরিয়েছি।
আমি এক অমল তরুণী, রুদ্রর উদোম উদগ্র জীবনে এসে স্তম্ভিত দাঁড়িয়েছিলাম। যে কবিকে আমি নিখাদ ভালোবাসি, যে প্রাণবান যুবককে ভালোবেসে আমি সমাজ সংসার তুচ্ছ করেছি, হৃদয়ের দুকূল ছাওয়া স্বপ্ন নিয়ে যাকে প্রথম স্পর্শ করেছি–তাকে আমি অনিয়ন্ত্রিত জীবন থেকে শেষ অব্দি ফেরাতে পারিনি; নিরন্তর স্খলন থেকে, স্বেচ্ছাচার থেকে, অবাধ অসুখ থেকে আমি তাকে ফেরাতে পারিনি। তার প্রতি ভালোবাসা যেমন ছিল আমার, প্রচন্ড ক্ষোভও ছিল তাই। আর রুদ্র সেই মানুষ, সেই প্রখর প্রশস্ত মানুষ, যে একই সঙ্গে আমার আবেগ এবং উষ্মা, আমার ভালোবাসা এবং ঘৃণা ধারণ করবার ক্ষমতা রেখেছে। রুদ্রকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, দূর থেকেও। রদ্র সেই মানুষ, রুদ্রই সেই মানুষ, যে কোনো দূরত্ব থেকে তাকে ভালোবাসা যায়।
যৌথ জীবন আমরা যাপন করতে পারিনি, কিন্তু যত দূরেই থাকি, আমরা পরস্পরের কল্যাণকামী ছিলাম। রুদ্রর সামান্য স্খলন আমি একদিন মেনে নেইনি, রুদ্রর দু’-চারটে অন্যায়ের সঙ্গে আমি আপোস করিনি–পরে সময়ের স্রোতে ভেসে আরো জীবন ছেনে, জীবন ঘেটে আমি দেখেছি রুদ্র অনেকের চেয়ে অনেক বড় ছিল হৃদয়ে, বিশ্বাসে। রুদ্রর ঔদার্য, রুদ্রর প্রাণময়তা, রুদ্রর অকৃত্রিমতার সামনে যে কারুকে দাঁড় করানো যায় না।