সামাজিক পতিত-পুরুষেরা চিরকালই পতিতা উচ্ছেদ বা পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার শিশু-পতিতা উদ্ধারের মহত্ত্ব দেখিয়েই উচ্ছেদ অভিযান স্তিমিত করে। কেউই পতিতা-প্রথার উৎপাটন, উন্মলন বা বিনাশ চায় না। নারায়ণগঞ্জে গাড়ি পুড়েছে, পুলিশ আহত, উচ্ছেদ কমিটির সদস্যরা গ্রেফতার হচ্ছে—শেষ অবধি হবে কি? পতিতা প্রথার বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন কতদূর অগ্রসর হবে?
জানি, খবর বেরোবে—আন্দোলন থিতিয়ে আসছে। প্রতিরোধ কমিটি তাদের দাবি তুলে নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আপস করেছে। প্রশাসন যদি পতিতাবৃত্তি টিকিয়ে রাখতে চায়, তবে পতিতাদের এবং কোনও প্রতিরোধ কমিটির কি শক্তি আছে ‘পতিতা’ নিমূলের?
কেউ কেউ যুক্তি দেখায়—পতিতাবৃত্তি না থাকলে সমাজে অনাচার বাড়বে, অপহরণ বাড়বে, ধর্ষণ বাড়বে। এগুলো হচ্ছে শিশুকে ঘুম পাড়াবার জন্য মামদো ভূতের ভয় দেখাবার মত। পতিতা ব্যবস্থা আছে বলে কি দেশে সন্ত্রাস নেই? অবাধ ধর্ষণ নেই, অনাচার নেই, অপহরণ নেই?
মামদো ভূতের দেশে আমরা আর মামদো ভূতের ভয়ে কাতর হতে চাই না। সামাজিক নিগ্রহের শিকার ওইসব মেয়েদের–আমি ওদের পতিতা বলতে চাই না, কারণ পতিতা শব্দের অর্থ ভ্ৰষ্টা, কুলটা ও কুচরিত্রা—আমি এই শব্দগুলোর একটিকেও ওদের জন্য যোগ্য মনে করি না, আমি ওদের নারী বলতে চাই, এবং ‘মানুষ’ বলতে চাই। আমি ওদের জানাতে চাই আমার সর্বোত্তম শ্রদ্ধা।
৭৩. ফুলের মত পবিত্র
‘ফুলের মত সুন্দর এবং পবিত্র’—এই উপমাটি প্রায়শই ব্যবহার হয়, ব্যবহার হয় মেয়েদের ক্ষেত্রে। যে মেয়েটি ছেলেপিলের দিকে চোখ তুলে তাকায় না, ছাদে ওঠে না, হাসে না, পোশাক-আশাকে পর্দানশিন, হাঁটাচলায় মন্থর, কণ্ঠস্বর অনুচ্চ, সাধারণত সেই মেয়েকেই ‘ফুলের মত পবিত্র’ বলে রায় দেওয়া হয়।
পবিত্রতার গাঢ় অর্থ নারীকে কোনও পুরুষের স্পর্শ না করা, বিশেষ করে পর-পুরুষ। ফুলের সঙ্গে কখনও কোনও পুরুষের উপমা হয় না, হয় নারীর। ফুল দেখতে বাহারি, সুগন্ধ ছড়ায়। নারীকে দেখতে নানা রঙের হতে হয়। গোলাপের পাপড়ির মত ঠোট, ভ্রমর কালো চোখ, গোলাপি গাল, ঘনকালো রেশমি চুল, দুধে আলতা অথবা কাচা হলুদ রঙের ত্বক, মুক্তোর মত সাদা দাঁত। মেয়েদের চুল ও ত্বক থেকে মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ না বেরোলে মেয়েদের ঠিক মেয়ে বলে মানায় না। তাই প্রতিদিন ঘষে মেজে গায়ের দুর্গন্ধ দূর করবার জন্য সাবান তৈরি হচ্ছে, সেসব সাবানে কমনীয় রমণীরা সৌন্দর্য রক্ষার বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে। নানা রকম সুগন্ধিতেও বাজার ছেয়ে গেছে। মানুষেরা ফুলের সুগন্ধ নেয়, এক্ষেত্রে ফুল যদি নারী হয়, মানুষ তবে পুরুষ। মানুষরূপী পুরুষেরা ফুলরাপী নারীর ঘ্রাণ গ্রহণ করে, নানা রঙে মুগ্ধ হয়। ফুলকে কেউ ছলে-ছিড়লে ফুল যেমন নেতিয়ে পড়ে বা মরে শুকিয়ে যায়, নারীকে তেমনি পুরুষ স্পর্শ করলে নারীর পবিত্রতা নেতিয়ে পড়ে বলে মনে করা হয়। নারীকে সুগন্ধি ফুল ভাবা হয় বলেই তাকে ভ্রাত বা অনাঘ্ৰাতা বিশেষণে চিহ্নিত করা হয়। অনাঘ্ৰাতা নারী অর্থ যে নারীর ঘ্রাণ কেউ নেয়নি। নারী যে কোনও সুগন্ধি উদ্ভিদ বা সুগন্ধি দ্রব্য—যা একই সঙ্গে বর্ণে ও গন্ধে মানুষ’-কে মুগ্ধ করে, মোহিত করে, তুষ্ট করে ও তৃপ্ত করে।
আজ অবধি কোনও পুরুষকে এরকম বর্ণ গন্ধযুক্ত উদ্ভিদের উপমায় অলস্কৃত করা হয়নি। আজ অবধি কোনও নারী চিত্রকর বা ভাস্কর পুরুষের শরীরকে নানা ঢংয়ে, রঙে ও রেখায় স্পষ্ট করেনি—যেরকম করেছে পুরুষ চিত্রকর বা ভাস্কর নারী-শরীর নিয়ে। আজ অবধি কোনও নারী-কবি বা ঔপন্যাসিক পুরুষের শরীরের নানা প্রত্যঙ্গের লোভনীয় বর্ণনা করেনি—যেরকম করেছে পুরুষ কবি বা ঔপন্যাসিক নারী-শরীর নিয়ে। এর কারণ পুরুষ-শরীরের প্রতি নারীর আকর্ষণ কিছু কম–তা কিন্তু নয়। এ হচ্ছে এক ধরনের লজ্জার অনুশীলন—যে লজ্জা নারীকে মোহনীয় করে তোলে বলে মনে করা হয়।
পুরুষের চুল, চোখ, বাহু, বুক, নিতম্ব দেখে নারীও মুগ্ধ হয়, যেরকম নারীর কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুরুষের মুগ্ধতা ও কামের কারণ। কিন্তু নারীর মুগ্ধতার কোনও স্বচ্ছন্দ প্রকাশ নেই, না সমাজে, না সাহিত্যে। বিয়ে করতে গেলে ছেলে এবং ছেলের জ্ঞাতিগোষ্ঠী টিপে-টুপে পরখ করে মেয়ে নিয়ে আসে ঘরে। মেয়ের ত্বক, দাঁত, চুল, চোখ, আকার, আকৃতি, কোমর, নিতম্ব কিছুই পরখ করতে বাকি রাখা হয় না। কিন্তু ছেলেকে পরখ করবার নিয়ম নেই। অথচ ছেলের শরীর যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় কোনও মেয়ের কাছে—তা কিন্তু নয়। এও হচ্ছে সেই লজ্জার নিরলস চর্চা। মেয়েরা জন্মেই সবটুকু ‘মেয়ে’ হয় না, এইসব লাজ ও লজ্জার সফল চর্চার পর পূর্ণাঙ্গ ‘মেয়ে’ হয়ে ওঠে। পুরুষের লোমশ বাহু, কাল গভীর চোখ, ঘন ভ্রু, খাড়া নাক, ঘন কালো চুল, প্রশস্ত কাঁধ, মসৃণ পিঠ, লোমশ বুক—ইত্যাদির আকর্ষণ নারীর কাছে ঠিক তেমন—যেমন নারীর লম্বা কালো রেশমি চুল, আয়ত চোখ, খাড়া নাক, পাতলা ঠোট, উন্নত বুক, সরু কোমর ও ভারী নিতম্বের প্রতি আকর্ষণ পুরুষের। নারীও পুরুষের নিতম্ব ও উরুর প্রতি একই আকর্ষণ অনুভব করে, যে আকর্ষণ নারীর নিতম্ব ও উরুর প্রতি পুরুষের।