কিন্তু যে অন্ধকার যুগে, যে বর্বরতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ব্যভিচারের যুগে হযরত মুহম্মদ বহুবিবাহ ব্যবহারে বাধ্য হয়েছিলেন, তা উল্লেখ করে এ যুগের বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবিগণ বহুবিবাহ রোধকল্পে অনায়াসে উদ্যোগী হতে পারেন। মানবতার পক্ষে যে কোনও আইন তৈরি করতে প্রায় দেড়শ বছর আগে একদিন মানুষ এগিয়ে এসেছিল, আজ কেন এগোবে না? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন শাস্ত্রবিরোধী বিধবা-বিবাহের কথা বলেছিলেন–শাস্ত্রবিরোধী বহুবিবাহ রোধের পক্ষে অনেকে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তখন বিপক্ষের শক্তি (শ্রীযুক্ত তারানাথ তর্কবাচস্পতি, ক্ষেত্রপাল স্মৃতিরত্ন, গঙ্গাধর রায়, কবিরাজ কবিরত্ন উল্লেখযোগ্য) প্রচণ্ড হলেও পক্ষের শক্তি নেহাত কম ছিল না।
এখন, এই একবিংশ শতাব্দীর দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা প্ৰণম্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুশতবার্ষিকীতে কেন এই বিলটি উত্থাপন করছি না, যে –No marriage, contracted by any male person of the Muslim religion, who has a wife alive। আমরা কেন আমাদের পক্ষের শক্তি একত্রিত করছি না বিদ্যাসাগরের মত, কেন আমরা কেবল স্মরণ করছি, দীক্ষা নিচ্ছি না? এ আমাদের ‘অতিজঘন্য’ চাতুর্য নয়?
ধর্মের যুগোপযুক্ত, বিজ্ঞানোপযোগী ব্যাখ্যা দাড় করাতে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার জাগোধ্যাত্মিক পণ্ডিতেরা নিরলস পরিশ্রম করছেন। এই পরিশ্রম একেবারেই নিরর্থক হবে, যদি না বহুবিবাহের মত একটি ঘৃণাকর, অনর্থকর ও অধর্মকর ব্যবহারকে উচ্ছেদ করা যায়। এবং আমরা বিদ্যাসাগরের কৃপায় স্ত্রী শিক্ষা প্রাপ্ত (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন এবং প্রসার করেছিলেন) নারীরা একটি ‘অতিগর্হিত’, ‘অতিজঘন্য’ ও ‘অতিনৃশংস’ একটি প্রথাকে (যে প্রথাকে বিদ্যাসাগর হিন্দু সমাজ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন) বাঁচিয়ে রাখি, তবে আমরাই বা আমাদের ক্ষমা করব কোন যুক্তিতে?
বহু বিবাহ প্রথার নষ্ট শেকড় সমাজের রন্ধে রন্ধে বিস্তারিত, মুসলমান ধর্মাবলম্বী নারীরা পুরুষের নৃশংসতা, স্বার্থপরতা, বিলাসিতা ও অবিমূশ্যকারিতার শিকার। ঘরে ঘরে বহু বিবাহের অনাচার ও উচ্ছঙ্খলতা নারীকে ‘ভোগ্যবস্তু হিসেবে নিরূপণ করছে এবং মানুষ’ হিসেবে নারীর মর্যাদা তিলার্ধও অবশিষ্ট রাখছে না। স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বিয়ে করবার যে উদার আইনটি প্রচলিত, তা নেহাত আইনের নামে ফাজলামো ছাড়া কিছু নয়। যে পরিবারে পুরুষই সর্বময় কর্তা হিসেবে বিবেচিত, সেখানে পুরুষের কোনও ইচ্ছেকে ‘অনুমতি’ না দেবার ক্ষমতা বা কণ্ঠস্বর কোনও নারী অর্জন করে না।
এই সময় চলুন, আমরা আমাদের ব্যাপারে সচেতন হই, উচ্চকণ্ঠ হই, এবং এরকম সংগঠিত হই যে আমাদের সম্মিলিত প্রস্তাবকে রাষ্ট্র যদি আইনসিদ্ধ না করে তবে এই রাষ্ট্রকেও আমরা ছেড়ে কথা কইব না।
৭২. অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
নারায়ণগঞ্জের ‘অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি’ বেশ একটা কাণ্ড করছে বটে। তারা পতিতাদের উচ্ছেদ চাইছে। ‘উচ্ছেদ’ অর্থ যদি উৎপাটন বুঝি, উন্মূলন বা বিনাশ বুঝি তবে আমিও মিছিলে নামব, আমি শ্লোগান দেব, আমিও অনৈসলামিক কার্যকলাপ কমিটির অন্যতম সদস্য হব। কিন্তু এই উচ্ছেদ অর্থ যদি স্থানচ্যুতি হয়, যদি এক স্থান থেকে একই রকম আরেক স্থানে নিতে হয় তবে আমি প্রতিরোধ কমিটির সকল কার্যকলাপ সবলে রোধ করতে চাই।
‘পতিতা’ শব্দের অর্থ ভ্ৰষ্টা, কুলটা ও কুচরিত্রা এবং ‘পতিত’ শব্দের অর্থ ভ্ৰষ্ট, স্থলিত, অধোগত, পাপী ও কুচরিত্র। দেশে ‘পতিতা’র চেয়ে ‘পতিত’র সংখ্যা কম নয় বরং বহুগুণে বেশি। অথচ পতিতাদের চিহ্নিত করবার ব্যবস্থা আছে, যেমন নির্দিষ্ট একটি বাড়ির মধ্যে তাদের জড়ো করা হয়। আর পুরুষ পতিতরা থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, তাদের পতিত হিসেবে চিহ্নিত করবার কোনও ব্যবস্থা নেই। গোয়ালের গরুর নামও গরু, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাঠ-ঘাটের গরুর নামও গরু। সুতরাং সমাজে বাস করে বলে এবং খাতায় নাম রেজিস্ট্রি হয়নি বলে ‘পতিত’রা যে ‘পতিত’ নয়, তা নয়; ‘পতিত’ পতিতই। আমরা কেবল তাদের পতিত বলে ডাকি না। কারণ ডাকবার চল নেই।
চল তো অনেক কিছুরই থাকে না। আগে তো মেয়েদের লেখাপড়া করবারই চল ছিল না, এখন চল হয়েছে। আচলেরও প্রচলিত হতে দেরি হয় না। দেশে লক্ষ লক্ষ পতিত রেখে পতিত শব্দটিই যোগ্য পুরুষের জন্য প্রচলিত হচ্ছে না, (যেমন পতিতা শব্দটি নারীর বেলায় প্রচলিত) এ কি কম দুঃখ! ‘পতিত’ কোথায় নেই? অফিসে, আদালতে, খবরের কাগজে, জাহাজে, লঞ্চে, কলে-কারখানায়—কোথায় নেই?
সর্বত্র বিরাজমান ‘পতিত’ পুরুষদের ‘পতিত’ বলবার রীতি শুরু হোক আজ থেকে। ‘পতিত’দের চিহ্নিতকরণ এসময় খুব জরুরী। কারণ ‘পতিত’রা নির্মুল না হলে ‘পতিত’ জন্মাবেই। মূলত ‘পতিত’র স্বার্থেই ‘পতিতা’র প্রয়োজন হয়।
‘পতিত’রা সমাজে ঘোরাফেরা করে। তারা তাদেরই স্বার্থে পতিতা পল্লীগুলো বাঁচিয়ে রাখে। আর দোষ হয় কেবল পতিতার, পতিত’র নয়। অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি পতিতা উচ্ছেদ চাইছেন, পতিতারা তা হতে দিচ্ছে না। সরকার যদি পতিতাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেন, তবে পতিতরা এই পতিতাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানেই কেবল সরাবে, স্থানান্তর ছাড়া কোনও উৎপাটন বা বিনাশ ঘটবে না। তাই উদ্যোগী হতে হবে সরকারকে। সরকার যদি পতিত না হন, উদ্যোগী হবেন। উদ্যোগী হবেন পতিতাদের সামাজিক পুনর্বাসনে। আর এই প্রতিরোধ কমিটিকে কেবল অনৈসলামিক নামেই সন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। ‘অমানবিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি’ নামেও মিছিলে নামতে হবে।