নারীর জন্য শিক্ষা নয়, ধন নয়, এমনকি নিজের শরীর ও নারীর জন্য নয়। নারীর নিজস্ব কিছু থাকতে নেই, কোন ও পার্থিব বা অপার্থিব কিছু। নারীকে নিঃস্ব করে দেবার নানারকম মন্ত্র তৈরি হয়েছে, আর সে সবই লোকে বড় শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে।
মৈত্রায়নি সংহিতা বলেছে নারী অশুভ (৩/৮/৩) । যজ্ঞকালে কুকুর, শুদ্র ও নারীর দিকে তাকাবে না ( শতপথ ব্রাহ্মণ ৩/২/৪/৬)। অতিথি সৎকারে ,উৎসবে, যুদ্ধে, যজ্ঞে, যৌতুকে দানে ও দক্ষিনায় গাভি- স্বর্ণ- রথ- গজ- অশ্বের সংগে অগণন নারী দান করা হত। নারীকে ভোগ্য বস্তু ভাবা হতো বলেই গরু ঘোড়ার নারী উল্ল্যেখে কেউ বিব্রত হয়নি। কুকুর শুদ্র, নারী- সবই অস্পৃশ্য। সবই সমাজে নিগৃহীত ঘৃণিত বস্তু।
কন্যা অভিশাপ ( ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬/৩/৭/১৩)। তাই সন্তান সম্ভবা নারীর একটি অবশ্য করনীয় অনুষ্ঠান হল ‘পুংসবন’, যেন গর্ভের সন্তানটি পুত্র হয়। নারী মিথ্যাচারিণী, দুরভাগ্যস্বরুপিনী্ সুরা বা দ্যুতক্রিরার মত একটি ব্যসন মাত্র (মৈত্রায়নী সংহিতা ১/১০/১১, ৩/৬/৩)। সর্ব গুণান্বিত শ্রেষ্ঠ নারী ও তাই অধমতম পুরুষের চেয়েও হীন ( তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২)।
আসলে সব কথার সারকথা নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না। শতপথ ব্রাহ্মণে আছে স্ত্রী স্বামীর পরে খাবে। কারণ ভুক্তেবাচ্ছিষ্টং বধ্বেই দদাৎ , খেয়ে এটোটা স্ত্রীকে দেবার বিধান শাস্ত্রে আছে। বাড়ির কুকুর বিড়াল, এবং স্ত্রী একই জাতের জীব বলে এঁটো দিয়েই প্রতিপালন আছে। আপস্তম্ব ধর্মসুত্র এ (১/৯/২৩/৪৫) বলা হয়েছে কালো পাখি, শকুনি, নেউল, ছুঁচো, ও কুকর হত্যা করলে যে প্রাইশ্চিত্ত, নারিহত্যা, শুদ্রহত্যার সেই একই প্রায়শ্চিত্ত, মাত্র একদিনের কৃচ্ছ্রসাধন।
শকুনি, নেউল, ছুঁচো, কুকুর, শুদ্র ও নারীর মধ্যে শাস্ত্র কোন ও পার্থক্য করেনি। শাস্ত্র করে বলে সমাজও করেনি। বৈদিক ভারতবর্ষ নারীকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দেয়নি।খৃষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের সমাজ নারীকে যতটুকু অসম্মান করেছে , তিন হাজার বছর পর ও বর্তমান খ্রিস্টাব্দের সমাজ ভিন্ন কৌশলে, ভিন্ন ব্যবস্থায় নারীকে একই রকম অসম্মান করে যাচ্ছে।
০৮. বিয়ের বয়স
১. ‘বিয়ের বয়স’ বলে একটি কথা আছে, যা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভিন্ন হুলের আকারে কৈশোর অথবা কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়েদের গায়ে ফোটানো হয়।আসলে মেয়েদের মনের উপর এটি একটি সামাজিক চাপ,যে চাপের ফলে মেয়েটি খামোকা প্রমে পড়তে, পালিয়ে যেতে এবং আত্মহত্যা করতে উদ্যোগী হয়। এতে মধ্য ও নিম্নবিত্তের অভিভাবক রা এরকম রেহাই পান। উচ্চবিত্তের অধিকাংশ ‘মেয়ে বিয়ে’ অনেকটা কেনা বেচার ব্যবসার মত। মেয়ের চেয়ে আকর্ষনীয় মেয়ের সম্পদ।সম্পদ যার যত বেশি সে ততো বিকোয় ভাল।
একসময় পাঁচ বছর বয়সে মেয়েরা ঘোমটা মাথায় শশুরবাড়ি আসতো; কি অভিজাত কি অনভিজাত সকলেই। এখনো গ্রামের মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করলে,যারা নিজের বয়স বলবার জ্ঞান রাখে না, জিজ্ঞাসা করতে হয় বিয়ের বয়সে তার মাসিক রজ:স্রাব হয়েছিল কি হয়নি, আর যদি হয়েই থাকে ক’বার রজ:স্রাবের পর তার বিয়ে হয়েছে অথবা বিয়ের ক:মাস কী ক’বছর পর তার রজ:স্রাব হয়েছে। (মেয়েদের রজ:স্রাবের হিসেব দিতে পারলেই বিয়ের বয়স বের করা যায়, কারণ রজ; দর্শনের একটি নির্দিষ্ট বয়স আছে। বিয়ের বয়স জানা গেলে পরবর্তি দাসত্বের বছর হিসেব করলেই পাওয়া যায় মেয়ের বয়স)।
এখনো গ্রামে, শুধু গ্রামেই বা বলি কেন, শহরের আশেপাশে, এবং শহরে যারা শিক্ষা চিকিৎসা, পুষ্টি ও সুস্থ বসবাস থেকে সর্বতোভাবে বঞ্চিত, মেয়েরা তিন হাত লম্বা হলেই তারা বিয়ের খেলা শুরু করে। বাংলাদেশে পনের থেকে উনিশ বছরের মেয়েদের শতকরা ৭৫ ভাগই বিবাহিত অথচ প্রাশ্চাত্য ইউরোপে ওই বয়সি মেয়েদের শতকরা এক ভাগও বিবাহিত নয়।মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স বলে-স্ত্রীর বয়স যদি ষোল বছরের নিচে হয় এবং স্বামীর যৌনাঙ্গ যোনিমুখ স্পর্শমাত্র করলে যে ঘটনাটি ঘটে তাকে ধর্ষন বলা হয় এবং ধর্ষন আইনত একটি অপরাধ।
এমন এক সময় ছিল রজোদর্শনের আগেই মেয়েরা বিধবা হয়েছে, পুতুল খেলার বয়সেই নিরামিষ আর এলাদশী ব্রত নিয়ে নারী জন্মের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। এখনো, ক্রমাগত সন্তান ধারনে এবং পালনে কৌশোর পার করে যৌবন যখন মেলে দেবে তার পাপড়ি, সে মেয়ে তখন বহন করে সামাজিক বার্ধক্য।
যে মেয়ে লেখাপড়া করে সে মেয়ে বিধবা হয়;এ ধরনের একটি বিশ্বাস বাংগালীরা বহু বছর লালন করেছে।অনেকে বলে যুগ বদলেছে,যুগ কতোটুকু বদলেছে? ক’টি মেয়ে খাতা কলম নিয়ে স্কুলে যায়,ক’জন মেয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে আসে,আর যারা আসে তারাই বা সামাজিক সংস্কার কতটুকু অতিক্রম করে শিক্ষিত হয়?
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী প্রাপ্ত অনেক মেয়েকে আমি বলতে শুনেছি -‘আমার সাহেব এখনো ঘরে ফিরেননি,’ ‘আমার কর্তা গতকাল দেশের বাইরে গেছেন।’ সাহেব শব্দটির মূল অর্থ শাসনকর্তা, সম্রাট। নবাব সাহেব,জর্জ সাহেব, মেজিস্ট্রেট সাহেব ইত্যাদি সাহেব শব্দের সম্মানসুভক ব্যাবহার। মান্য ইউরোপীয় বা বিদেশি পুরুষের বেলায় এই শব্দ ব্যবহার হয়, যেমন লাট সাহেব, চীনা সাহেব, জাপানী সাহেব।
স্বামী কে সাহেব বা কর্তা ডাকবার রীতি কবে থেকে,তা আমার সঠিক জানা নেই। একসময় স্বামীর নাম উচ্চারণ করা স্ত্রীর জন্য নিষিদ্ধ ছিল, বাংলাদেশের গ্রামে -গঞ্জে এখনো এই অদ্ভুত নিয়ম প্রচলিত। শহরে বা নগরের বেলায় এই নিয়িমটি সামান্য আধুনিকীকরণ হয়েছে,অল্প শিক্ষিত বা বেশি শিক্ষিত দু ধরনের স্ত্রীই স্বামীর নাম উচ্চারণ না করবার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সাহেব বা কর্তা ব্যবহার করেন।