আমাকে রোধ করতে, আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় এমন শক্তির অভাব এদেশে নেই। জামাত-শিবির সরকারের কাছে আমার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছে। ওরা করবেই, এ নিয়ে আমি বিস্মিত নই, কারণ ধর্মসংক্রান্ত অমূলক ও অযৌক্তিক কথার প্রতিবাদ আমি করি, আর যেহেতু ওরা ধর্মকে ওদের নিজস্ব সম্পত্তি বলে মনে করে—ওরা আজ শাস্তি, কাল ফাসি’, আমি যতদিন বেঁচে থাকি, আমার জন্য দাবি তুলবেই। এ নিয়ে আমি সামান্যও বিস্মিত নই। কিন্তু প্রগতির পক্ষের কথিত শক্তি যখন নামে এবং বেনামে আমাকে আক্রমণ করে, এদের কদাকার এবং হিংস্র চেহারা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আমি বিস্মিত হই, বিস্মিত হই এবং বিস্মিত হই।
আমি সামান্য একজন লেখক মাত্র। সমাজের পীড়িত, নিগৃহীত, দলিত, দংশিত নারীর জন, লিখি। নরম কথায় এ যাবৎ কিছু হয়নি বলে আমি কড়া কথা বলি। নিন্দুকেরা এর নাম দিয়েছে পুরুষ-বিদ্বেষ। এদেশে আমার প্রশংসা যদি একজন করে, নিন্দা করবে একশ জন। এই আকটমুখ, মূঢ় ও নির্বোধের দেশে আমি বেশি প্রশংসা আশাও করি না। আমার অসংখ্য নিন্দুকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীবাদী নামধারী সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা, মার্কিন মদতপুষ্ট অগণন পেশী-শক্তি।
হোক, হবে না কেন, আমি তো একা, একা একজন মানুষকে চূর্ণ করতে সময় এবং শক্তির তেমন অপচয় হয় না। একা একজন মানুষকে গালি ছুড়তে কারও কোনও ভয় হয় না, কারণ সে তো কোনও দলের নয়, সংগঠনের সদস্য নয়, আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় কোনও প্রতিঘাতের আশঙ্কা নেই। একা একজন মানুষের কুৎসা রটালে সেই কুৎসা যখন প্রবল ধাবিত হয়, কোনও বিরুদ্ধ বাতাস থাকে না তাকে ফেরাবার। একা একজন মানুষের কণ্ঠনালী চেপে ধরতে তেমন দুঃসাহসেরও দরকার হয় না।
মানুষের নিয়মই বোধহয় এই যে মানুষ অসংখ্যের অনুগত হয়, বিশাল-এর বাধ্য হয়। মানুষের নিয়মই বোধহয় এই যে মানুষ নিজেকে এত দুর্বল ভাবে যে একটি সবলের কাছে সে সমর্পিত হয়, আশ্রিত হয় একটি ‘ছত্রছায়ায়’।
আমি একা। একা বলে আজ আমার অহঙ্কার হয়। আমি কোনও দল বা সংঘের ভাড়াটে লেখক নই। আমি কোনও পেশী বা স্তাবক পুষি না, পোষা সংখ্যাধিক্য, আমাকে মোহিত করে না। আমি একা। একা একটি শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তাবৎ নিন্দার মুখে থুথু দিয়ে অশুভ সকল শক্তির বিরুদ্ধে আমি দাঁড়িয়েছি। যেন কারও কাধে ভর দিয়ে নয়, এমন একাই একটি তুমুল শক্তি দাঁড়াতে পারে—এমন দাঁড়াতে পারে বিড়ম্বিত, বিপন্ন, দুর্গত, নিরাশ্রয় নারী।
নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়। তার পায়ে পরানো আছে দ্বিধার শেকল, তার মস্তিষ্কে পিঁড়ি পাতা আছে ভয়ের। দ্বিধা এইজন্য যে, কে না জানি তার নিন্দা করে। নারী দ্বিধার চাকুতে নিজেকে শত টুকরো করে। নারী ভয়ে নীল হয়। এই নীল হওয়াকে লোকে মুগ্ধ চোখে দেখে, নানান ব্যাখ্যা করে তার নীলাভ সৌন্দর্যের । আহা নারী, ভয়ের কামড় থেকে গা বাঁচিয়ে একবার সে কেন এমন দাঁড়ায় না, এমন ঋজু এবং উদ্ধত? পরাশ্রয়ী লতার মত নয়, একটি বৃক্ষের মত? যার আছে একটি শক্তিমান শেকড়? নারী একাই তো হয়ে উঠতে পারে অসংখ্য। একাই তো হয়ে উঠতে পারে বিপুল এবং বিস্তৃত।
৬৭. অবাধ যৌনতাকেই ওরা স্বাধীনতা বলে ভাবছে
প্লেবয়-এর জেফ কলিন্স এখন উল্লাসে নৃত্য করছেন। কারণ মিশন তার সাকসেসফুল। মস্কোর মেয়েদের তিনি উলঙ্গ করে ছেড়েছেন। সূক্ষ্ম পোশাক পরে মস্কোর মেয়েরা রেড স্কোয়ারে ছবি তুলেছে। জেফ কলিন্স মস্কোর মেয়ে সম্পর্কে বলেছেন—‘সারা ইউরোপের মত তারা দ্বিধাহীন, শরীর নিয়ে লজ্জিত নয়। একঘর লোকের মধ্যে ঝটপট কাপড় খুলে ফেলতে তাদের মোটেই সঙ্কোচ নেই।‘
জেফ কলিন্স ভেবেছিলেন, আগ্রাসী পাঠকের খাদ্যতালিকায় নতুন মেনু হিসেবে চমৎকার হবে রুশ-সুন্দরীরা। তিনি এতটা আশাও করেননি যে, হুড়মুড় করে এক ডাকে মডেল হবার জন্য দাঁড়িয়ে যাবে এতদিনকার সমাজতন্ত্রী মেয়েরা, যারা অন্তত নিজের শরীর নিয়ে ব্যবসা করতে শেখেনি। গর্বাচেভ ও ইয়েলেৎসিনের ধ্বংসযজ্ঞকে পুঁজি করে জেফ কলিন্স স্রেফ সুযোগ নিতে মস্কো গিয়েছিলেন। তার গোপন ইচ্ছে ছিল, এই ফাঁকে কায়দা করে কিছু রুশ-সুন্দরীকে ভজানো যায় কি না।
না কোনও ছল-চাতুরির দরকার হয়নি। মেয়েরা প্লেবয়-পত্রিকার মডেল হবার জন্য রীতিমত লাইন দিল। শুধু রেড স্কোয়ারে নয়, সেন্ট বাসিলস-এর সামনে, স্পা-টাউন সোচিতে, পুশকিন ফাউন্টেইনে, রোসিয়া হোটেলের সুইমিং পুল, করিডোর, রেস্তোরায় অর্ধনগ্ন রুশ-সুন্দরীর ছবি তোলা হল। লেনিনের ছবির সামনে নগ্ন সুন্দরীরা নিতম্ব দেখিয়ে ছবি তুলল। যেন লেনিন নয়, লেনিনের চেয়ে মহান হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ রুশ-নারীদের নিতম্ব। জেফ কলিন্স জয় গ্লাসনস্ত, জয় ইয়েলেৎসিন বলে দেশে ফিরেছেন। লেনিন তো সেই মানুষ, যে মানুষ নারীকে পণ্য করতে চাননি, নারীকে গার্হস্থ্য বাদিগিরি থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। লেনিন তো সেই মানুষ, যে মানুষ নারীকে মানুষ বলে ভেবেছেন, পুঁজিবাদীর শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে নারীকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। লেনিন নিশ্চয় সেই মহান মানুষ, নারীকে যে মানুষ ধর্ম ও সামাজিক সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন। নারীকে রান্নাঘর ও আঁতুড়ঘর থেকে কলে এনেছেন, কারখানায় এনেছেন, মিছিলে এনেছেন, পাঠশালায় এনেছেন। সেই লেনিনকে সামনে রেখে আজ রুশ-নারীরা উরু উদোম করে ছবি তুলবার পোজ দিচ্ছে। ধিক, ধিক্ এই পশ্চিমী মোহে, ধিক এই নারী-দেহের বীভৎস বাণিজ্যে।