ছোটবেলায়, যখন ধীরে ধীরে ‘মেয়ে’ হয়ে উঠব বলে জানি, চারদিক থেকে আমনই হয়ত শিখছিলাম, মা একদিন আমাকে কোনও এক বাড়ি নিয়ে কান ফুটো করে আনলেন। দেখে বাবা রেগে আগুন হয়ে সারা বাড়ি চিৎকার করলেন। মা’র ওপর সে কি তুফান গেল ক’দিন। বাবার সোজাসাপটা কথা—আমার মেয়ে লেখাপড়া করবে। তার অত সাজগোজের দরকার নেই। আমার কানের ফুটো অব্যবহারে ধীরে ধীরে বুজে গেল। আমিও তো বড় মেয়ে হতে চেয়েছিলাম। স্কুলের মেয়েরা হাত দোলালে হাত ভরা কাচের চুড়ি রিন রিন করে বাজে। লাল সবুজ নীল—কত রঙের চুড়ি। স্কুলের মাঠে চুড়ি নিয়ে এক বেদেনী বসত। স্কুল ছুটি হলে মেয়েরা চুড়ি কিনতে ভিড় জমাত। একদিন আমারও ইচ্ছে হল চুড়ি কিনি, একদিন আমারও বড় ইচ্ছে হল রিন রিন করে হাত দোলাই, দু’হাত ভরে চুড়ি পরে সেদিন বাড়ি গেলাম। বাবা অফিস থেকে এসেই আমাকে কাছে ডাকেন, রোজ ক্লাসে কী কী পড়ানো হল তার হিসেব নেন। সেদিন কাছে যেতেই আমি টুং টাং বেজে উঠলাম। বাবা খাচ্ছিলেন, খাবার রেখে উঠোনে গেলেন, উঠোন থেকে বড় এক পাথর নিয়ে এলেন। আমাকে বললেন–হাতে কী ওগুলো?
বললাম–সবাই পরে।
বাবা জ্বলে উঠলেন, বললেন–হাত রাখ টেবিলে। হাত রাখলাম। বাবা পাথর মেরে দু’ ডজন চুড়ি টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিলেন। বললেন—ফের যেন এসব পরতে দেখি না, সাবধান।
সেই না পরতে পরতে না পরাটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন পরলেও বাবা আর ভাঙতে আসেন না, তবু পরি না। কেমন অস্বস্তি লাগে, যেন অকারণ বাড়তি একটি জিনিস গায়ে চাপিয়েছি, ভার ভার লাগে, খুলে ফেলি।
ঠোঁটে কখনও লিপস্টিক লাগাতে দিতেন না। যখন একটু একটু করে কৈশোর পেরোচ্ছি, বড় খালা বোনদের দেখে সাজতে ইচ্ছে হত, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক দিলে বাবা হাতের তালু দিয়ে বা সামনে কাপড় রুমাল যা-ই পেতেন তা দিয়ে মুছে দিতেন। বলতেন—এসব রঙ লাগিয়েছিস কেন? ফের মুখে কোনও রঙ দেখলে আস্ত রাখব না বলে দিচ্ছি।
আমার সেই ভয়ঙ্কর প্রতাপশালী বাবা, যাকে দেখে বাড়ির যেখানেই থাকি দৌড়ে গিয়ে পড়বার টেবিলে বসেছি, সামনে যে বই-ই পেয়েছি ভূগোল হোক পাটিগণিত হোক সশব্দে পড়েছি। যে বাবা আমাকে চোখে কাজল লাগাতে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে দিতেন না, যে বাবা আমাকে কানে দুল পরতে, হাতে চুড়ি পরতে দিতেন না—সেই বাবার দিকে মনে মনে কত রাগ করেছি ছোটবেলায়।
মেয়েরা যে কোনও পরবে-উৎসবে সেজেগুজে হেঁটে যেত। আমি সাদামাঠা একটি জামা পরে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কী যে দুঃখ হত নিজের জন্য।
আসলে আমি তখন বুঝিনি বাবা আমাকে কী অমূল্য জিনিস আমার চেতনার ভেতর প্রবেশ করিয়েছিলেন। বড় হবার পর সোনাদানা হীরে আমার কাছে অনেক এসেছে, আমি সব নিয়ে হেলাফেলা করেছি। আমার কাছে একটি সুতোর মূল্য যেমন, এক তোলা হীরের মূল্যও তেমন, আমি কোনও ধাতব অলঙ্কারকে আজও ভালবাসতে পারিনি। বাবা আমাকে ওই তুচ্ছতিতুচ্ছের মোহ থেকে মুক্ত করেছিলেন। বাবা কি এখন জানেন—তিনিই আমাকে মানুষ করেছেন সবচেয়ে বেশি!
বলতেন–পড়াশুনা কর। জ্ঞানের চেয়ে মূল্যবান পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আমি খেলতে শিখিনি আমি নাচতে শিখিনি, আমি বেড়াতে শিখিনি, আমি রাঁধতে শিখিনি, আমি কেবল পড়তে শিখেছি। বাবা আমাকে পড়াতে পড়াতে এমনই পড়বার অভ্যেস করালেন যে না পড়লে আমার অস্থিরতা বেড়ে যায়, রাতে ঘুম হয় না। বাবা কি আমার মন্দ করেছেন কিছু?
এই যে এত ময়মনসিংহ ভালবাসি, এই যে আমার শহর আমার শহর বলে উষ্ণ হয়ে উঠি মধ্যরাতে, এই যে এক আশ্চর্য ভালবাসা আমাকে ডেকে বলে–লক্ষ্মী মেয়ে ঘুমোও ! সে কি বাবার কারণে নয়? ওই শহরে আমার একজন বাবা বাস করেন বলে শহরটি এত প্রিয় হয়ে উঠেছে আমার। ওই শহর জানে আমার মানুষ হবার গল্প। ওই শহর জানে আমার বাবার প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের গল্প। ওই শহর জানে ওই শহর থেকে আমার হঠাৎ হারিয়ে যাবার গল্প। ওই শহরই কেবল জানে একজন ভালবাসার বাবা বাস করেন বলে ওই শহরটিকে বুকে নিয়ে এই দূর পরবাসে প্রতি রাতে আমি ঘুমোতে যাই।
আমার বাবা কি জানেন আমার এই ঘুম এবং ঘুম থেকে জেগে ওঠার গল্প?
৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি
শারদীয় ‘দেশ’-এ প্রকাশিত সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের দোসরা ফেব্রুয়ারি ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটিকে নিষিদ্ধ করবার অনুরোধ জানিয়ে মামলাটি করেছিলেন অমল মিত্র নামের এক তরুণ অ্যাডভোকেট। প্রজাপতিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করে সরকার পক্ষও তাকে সমর্থন জানিয়েছিল। সমরেশ বসুর পক্ষে প্রথম ও প্রধান সাক্ষী ছিলেন বুদ্ধদেব বসু।
সে বছর ষোলই নভেম্বর ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট কুমারজ্যোতি সেনগুপ্তর আদালতে সাক্ষ্য দিতে এলেন বুদ্ধদেব বসু। কোর্টরুম তখন জ্যাম প্যাক্ড। উপস্থিত ছিলেন ‘দেশ’-এর তখনকার সম্পাদক অশোককুমার সরকার, মুদ্রাকর ও প্রকাশক সীতাংশুকুমার দাশগুপ্ত, অভিযুক্ত সমরেশ বসু, সঙ্গে সাগরময় ঘোষ, সন্তোষকুমার ঘোষ, কবি নরেশ গুহ এমন অনেকে। বুদ্ধদেব বসু ‘প্রজাপতি’র অভিযুক্ত অংশগুলো সম্পর্কে বলেন ওখানে তিনি অশ্লীলতার কিছুই পাননি। ১৭৮, ১৭৯, ১৮০, ২০০ পৃষ্ঠার কথিত অশ্লীলতাকে বুদ্ধদেব বসু তুখোড় যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ওগুলো অশ্লীলতা নয়, যদি নরনারীর মিলনের সম্পর্ককে অশ্লীল বলা হয় তবে প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় সাহিত্য ও শিল্পে এই মিলনের কথা অবাধে এসেছে। কেউ তার ওপর কোনও নিষেধবিধি জারি করেনি। মহাভারতে বা কালিদাসের কাব্যে কিংবা কোনারক, খাজুরাহে বা পুরীর মন্দিরে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। এগুলো মহৎ শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। বাংলা সাহিত্যে ও ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর এবং বহু বৈষ্ণব কবিতায় এই সম্পর্কের কথা বেশ খোলখুলিই আছে। মনে রাখতে হবে জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং অন্যান্য বৈষ্ণব পদাবলী আমাদের দেশে ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত। যে কারণে সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’-কে অশ্লীল বলা হয়েছে, বুদ্ধদেব বসু বলেন সেই ধুয়া তুললে তো আগে মহাভারত, বাইবেল এসবই নিষিদ্ধ করে দিতে হবে।