আমাদের সংবিধানে নাকি নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা লেখা আছে। একদিকে সমান অধিকারের ধুয়ো, আরেক দিকে ধর্মের নামে নারীকে অমানুষ বানাবার কায়দা কৌশল। নিষিদ্ধ করতে বলবার কেবল একটি কারণ নয়—এই বইয়ে যে অদ্ভুত চিকিৎসাপ্রণালী বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে একটি বিজ্ঞান নির্ভর উন্নয়নশীল সভ্য দেশের লজ্জিত হওয়া উচিত। ঘরে আগুন লাগলে উচ্চস্বরে আল্লাহ আকবর বললে খোদার কৃপায় আগুন নিভে যায় বলে আমি বিশ্বাস করি না। ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করলে ফোড়ার জন্ম হয় এবং সেই ফোড়াকে নির্মুল করতে হলে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার। শরীরের কোনও স্থানে ফোড়া হলে শাহাদাৎ অঙ্গুলিকে মাটির ওপর কিছুক্ষণ ধরে রেখে কোনও একটি দোয়া পড়লে সেই ফোড়া নিরাময়ের কোনও কারণ নেই। চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি ও নানারকম চোখের রোগ, অন্ধত্ব ইত্যাদি দূর করতে কোনও আয়াত বা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। বন্ধ্যা স্ত্রীলোকের সন্তান হওয়ার জন্য একটি তদবীর লিখে গলায় বুলিয়ে দিলে এবং ৪০টি লবঙ্গের মধ্যে ৭ বার করে একটি দেওয়া পড়ে প্রতি রাতে খেলে নাকি গর্ভে সন্তান হয়। ধরা যাক জরায়ুর নালী (ফ্যালোপিয়ান টিউব) বন্ধের কারণে কোনও স্ত্রীলোকের সন্তান হচ্ছে না, কোনও ডিম্বাণুই ওই নালীপথে জরায়ুতে পৌঁছুতে পারছে না, যেখানে তার সঙ্গে শুক্রাণুর মিলন হবে। তবে কি কোরানের সবকটি আয়াত গুলে তাকে খাওয়ালে সে সন্তান জন্ম দিতে পারবে? আমি জানি পারবে না, এবং পাঠক, আপনারাও নিশ্চয়ই তা স্বীকার করবেন।
জ্বর হলে, বসন্ত হলে, কলেরা হলে, অতিরিক্ত রক্তস্রাব হলে হাতে ও নাভির নিচে যে সমস্ত তাবিজ লাগাবার বর্ণনা আছে, এবং সুস্থ হয়ে যাবার নিশ্চয়তা আছে তা দেখে আমি বিস্মিত হই। জ্বর কোনও রোগ নয়, রোগের উপসর্গ, রোগের কারণ খুঁজে বের করে যে জীবাণু দ্বারা রোগের উৎপত্তি সেই জীবাণুনাশক ব্যবহার করলেই জ্বর সেরে যায়। কলেরা হলে শরীর থেকে জলীয় পদার্থ যে পরিমান বের হয়, একই পরিমাণ জলীয় পদার্থ রোগীর শরীরে প্রবেশ করাতে হয়, সঙ্গে কলেরার জীবাণু নাশ করবে এমন পরীক্ষিত জীবাণুনাশক প্রয়োগ করতে হয়। অতিরিক্ত রক্তস্রাব জরায়ুতে এক ধরনের টিউমারের কারণে সাধারণত হয়, রক্তস্রাবের কারণ বের করে সেই কারণের সেবন-চিকিৎসা অথবা শল্য-চিকিৎসা করতে হয়। অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষ ঝাড়ফুক, তাবিজ কবচের উপর ভরসা করে বেঁচে থাকে। আর বিশ্বাসে ভুগতে ভুগতে অধিকাংশই মরে, বাকিরা প্রায় মরো-মরো অবস্থায় উপস্থিত হয় অগত্যা চিকিৎসকের কাছে।
এই অশিক্ষা, এই ধর্মীয় কুসংস্কার, এই সর্বগ্রাসী অসুস্থতায় মানুষ আক্রান্ত হতে হতে এখন এমন এক মহামারী শুরু হয়েছে যে খুব শীঘ্র মকছুদোল মোমেনীন এবং এ জাতীয় বিভ্রান্তিকর প্রকাশনা বন্ধ না করা হলে আমরা একটি কঙ্কালসার অসুস্থ জাতিতে পরিণত হব, বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা ব্যবস্থাও শেষ অদি এই মহামারীকে ঠেকাতে পারবে না।
৬১. শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
এ শহরে যে সামান্য ক’জন মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলতে পছন্দ করি, কবি ফরহাদ মজহার তাদের মধ্যে একজন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, প্রাবন্ধিক, কবি, গীতিকার এবং গায়ক। তার সকল পরিচয় স্বীকার করে কবি পরিচয়টিকেই অগ্রগণ্য বলে মানি। ফরহাদ মজহার বাংলা ভাষা সম্পর্কে নিজস্ব একটি মত প্রকাশ করেন, যেমন, সাদাসিধে করে বলতে গেলে, যে বাংলা ভাষাটি পশ্চিমবঙ্গ এবং আমাদের দেশে প্রচলিত তা নিরেট পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, আমাদের নয়। বাংলাদেশের নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে আরবি-ফারসি শব্দসমৃদ্ধ আমাদের জবানের ভাষাকে লেখালেখিতে তুলে আনা দরকার বলে তিনি মনে করেন। তিনি ইসলামি সংস্কৃতিকেও বেশ নতুন চোখে দেখেন, কারণ এই সংস্কৃতি নাকি আমাদের পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষা থেকে পৃথক একটি ভাষার জোগান দেবে।
ভাষার ক্ষেত্রে ফরহাদ মজহারের এই বোধ, এই যুক্তি আমি কখনও মেনে নিইনি। এর কারণ, আমি মনে করি না এ পারের বাঙালিদের কথ্য ভাষায় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের প্রয়োগ খুব বেশি। মৌখিক ব্যবহার আছে, এমন শব্দের লিখিত ব্যবহার এদেশে অপ্রচলিত নয়, যেমন নাস্তা, গোসল, পানি যা পশ্চিমবঙ্গে জলখাবার, স্নান ও জল বলে পরিচিত। আমাদের নাটকে, উপন্যাসে ‘এয়েচো, খেয়েচো, করলুম, বললুম, দোবো’ শব্দের চল নেই। এ ছাড়া বোধে ও বিশ্বাসে যে স্বাতন্ত্র্য আছে, যেমন কৃষ্ণচূড়ার লাল বলতে আমরা ফাগুনের আরেক রঙ বুঝি, ফাগুন বলতে বায়ান্ন বুঝি, রক্তপাত বুঝি। এ ধরনের দেশ, কাল, পরিবেশ, প্রতিবেশ, রাজনীতিজনিত কিছু স্বাতন্ত্র্য বাদ দিলে যা থাকে, তাকে যদি ‘পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা’ বলে অভিযোগ করা হয়, তবে খুব অন্যায় হবে। এবং এও অন্যায় যদি এই শুদ্ধ বাংলার মধ্যে অনর্থক আরবি-উর্দু শব্দ মিশিয়ে ভাষাটির খৎনা করা হয়।
প্রচলিত কোনও মৌখিক শব্দ, যে শব্দ, লিখিত ভাষায় এখনও প্রবেশ করেনি বলে মনে করা হয়, সে শব্দের চলন প্রচলনে আমার কোনও আপত্তি নেই, তবে পুরনো ঢাকার গুটিকয় উর্দুভাষীর উর্দুকে প্রচলিত জ্ঞান করা মোটেও সমীচীন নয়।
সেদিন কবি শামসুর রাহমানকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম—আপনার গদ্যে উর্দু শব্দের আধিক্য কেন?