শতপথ ব্রাহ্মণে লেখা, সুন্দরি বধূ স্বামীর প্রেম লাভ করে (৯/৬)। কিন্তু যে বধূ সুন্দরি নয়, সে নিশ্চয়ই স্বামীর প্রেম থেকে বঞ্চিত হয়। অসুন্দরি বধুকে পবিত্র বৈদিক সাহিত্যেও ক্ষমা করেনি। এই পক্ষপাতদুষট শ্লোক লোকে খূব শ্রদ্ধার সংগে উচ্চারণ করে।
শতপথ ব্রাহ্মণ নারীকে অবরোধের কথা বলেছে, তা না হলে তার শক্তি ক্ষয় হবে (১৪/১/১/৩১)। অবরোধে থাকলে শক্তি বৃদ্ধি হয়, এ কি আশ্চর্য নয়? তবে অবরধহীন পুরুশকে শক্তিমান বলি কি করে?
যজ্ঞে একটি দণ্ড কে বেষ্টন করে রাখে দুটি বস্ত্রখণ্ড, তাই পুরুষ দুটি স্ত্রী গ্রহণে অধিকারী। একটি বস্ত্রখণ্ডকে যেহেতু দুটি দণ্ড বেষ্টন করে না, তাই নারীর দ্বিপতিত্ব নিষিদ্ধ ( তৈত্তিরিয় সংহিতা ৬/৬/৪/৩, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১/৩/১০/৫৮)- যজ্ঞের দণ্ড ও বস্ত্রখণ্ডের সাথে স্বামি- স্ত্রীর সম্পর্ক কি? দণ্ড ও বস্ত্রের সংখ্যার সংগে স্ত্রী বা স্বামী সংখ্যায় বা কি কারণে যুক্ত হয়? একি কোন যুক্তি না গায়ের জোর? গায়ের জোরে পুরুষের পক্ষে শাস্ত্রীয় সমর্থন যুগানো!
নারী কখনও একটির বেশি স্বামী গ্রহণ করতে পারবে না। এক স্বামীর বহু স্ত্রী থাকলেও একটি স্বামিই তাদের জন্য যথেষ্ট ( ঐতেবেয় ব্রাহ্মণ ৩৫/৫/২/৪৭)। বহু স্ত্রী তো থাকবেই ,তার উপরে পুরুষের আছে পতিতালয়ে যাবার অবাধ স্বাধীনতা, কিন্তু নারীর জন্য ‘ পতিত-আলয়ে’ যাবার কোন ব্যবস্থা নেই। পতিত অর্থ পতিত পুরুষ। পতিতার বিপরীত।
বশিষ্ঠ ধর্মসুত্রে আছে- পিতা রক্ষিত কৌমারে, ভর্তা রক্ষিত যৌবনে। রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা, ন স্ত্রী স্বাতমন্ত্রমর্হতি । এর অর্থ নারীকে কুমারী বয়সে রক্ষা করবেন পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্ররা, নারী স্বধিনতার যোগ্য নয় (৫/১-২, ২/১,৩, ৪৪, ৪৫) পিতা স্বামী, ও পুত্রের খাঁচায় নারীকে বন্ধী রাখবার কৌশল শাস্ত্র খূব চমৎকার জানে।
শতপথ ব্রাহ্মণ নারীকে পুরুষের অনুপথগামিনী হতে বলে (১৩/২/২৪০। ব্রিহদারন্যক উপনিষদে আছে পতিং বা অনু জায়া, স্ত্রী স্বামীর প্রশ্চাতে (১/৯/২/১৪)। পুরুষ সামনে, নারী পেছনে;, নারী ‘সবার পিছে, সবার নিচে সবহারাদের মাঝে’। সামনে এগিয়ে যাবার যোগ্যতা থাকলেও শাস্ত্রের দড়ি তাকে পেছনে টেনে রাখে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে বর কে বলতে হয়, এস আমরা মিলিত হই,যেন পুত্র সন্তান উৎপন্ন হয়,যে সন্তান দ্বারা সম্পত্তি বৃদ্ধি পাবে। শেষে প্রার্থনা করা হয় পুত্র , পৌত্র, দাস, শিষ্য, বস্ত্র,কম্বল, ধাতু, বহু ভার্যা, রাজা,অন্ন, ও নিরাপত্তা (হিরন্যকেশী গৃহসুত্র ১/৬/১২/১৪)। নতুন বধুর সামনে বহু ভার্যার প্রার্থনা করলে বরের হয়তো সম্মানহানি হয় না কিন্তু বধূর হয়, বধূর সম্মান সমাজে জরুরি নয় বলে বহু ভার্যাও কাঙ্ক্ষিত ধন বলে বিবেচিত হয় বর – পুরুষের কাছে।
প্রার্থিত পুত্র, পৌত্র, শিষ্য, রাজা সকলেই বংশ , জীবিকা ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন কিন্তু ভোগের জন্য প্রয়োজন বস্ত্র, কম্বল, ধাতু,দাস ও বহু ভার্যা । বস্ত্র, কম্বলের মতো নারীও ব্যবহার্য বস্তু।
স্ত্রীর প্রধান কর্তব্য পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়া ( আপতম্ব ধরমসুত্র ১/১০-৫১-৫৩০)। নিঃসন্তান বধূকে বিয়ের দশ বছর পর ত্যাগ করা যায়, যে স্ত্রী শুধু কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় তাকে বার বছর পর, মৃত বৎস কে ১৫ বছর পর এবং কলহপরায়ণা কে তৎক্ষনাৎ ত্যাগ করা যায় ( বৌধায়ন ধরমসুত্র ২/৪/৬) । শতপথ ব্রাহ্মনেও আছে যে অপুত্রা পত্নী, সে পরিত্যক্তা(৫/২/৩/১৪) এবং পুত্রসন্তান না জন্মালে স্বামী আবার বিয়ে করবে ( বশিষ্ঠ ধর্মসুত্র ২৮/২-৩)।
পুত্র সন্তানের প্রয়োজন বংশগতি বৃদ্ধির জন্য, সেইসংগে পুরুষ তন্ত্রের শ্রী বৃদ্ধির জন্যও। নিঃসন্তান থাকা ।কন্যা সন্তান জন্ম দেয়া অথবা মৃত সন্তান জন্ম দেয়া নারীর জন্য একই রকম অপরাধ। এই জন্ম এবং অজন্মের পাপে নারী পরিত্যক্ত হয় সমাজ ও সংসার থেকে।
নারী হোম করতে পারবে না ( আপস্তম্ব ধর্মসুত্র ২/৭/১৫/১৭)। উপনয়নে নারীর অধিকার নেই। ব্রহ্মচর্য নারীর জন্য নিষিদ্ধ। কেবল স্বামিকে রুপে ও গুনে সন্তুষ্ট করা ও পুত্র সন্তানের জননী হওয়াতেই নারীর স্বার্থকথা। প্রাচীন ভারতে গণিকারা সর্ব বিদ্যায় পারদর্শী ছিল। পুরুষেরা ঘরের মূর্খ কুল বধূকে ভোগ করতো, আবার শিক্ষিত গনিকাকেও। রাষ্ট্রই পুরুষের জন্য ভোগের দুয়ার সব খুলে রেখেছিল।
বৃহদারন্যক উপনিষদে আছে স্ত্রী যদি স্বামীর সম্ভোগ কমনা চরিতার্থ করতে অসম্মত হয় তবে উপহার দিয়ে স্বামী তাকে কিনতে চেষ্টা করবে, আর তাতেও কাজ না হলে হাত বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে নিজের বশে আনবে( ৬/৪/৭)। নারীকে যেমন ইচ্ছা শাসন ও ভোগ করার অধিকার শাস্ত্রই পুরুষকে দিয়েছে। পুরুষের জন্য বহুপত্নি উপপত্নী, ও গণিকা সম্ভোগের অবাধ অধিকারের কথা বার বার বলা হয়েছে।
নারীর জন্য দুটো বৃত্তিই সমাজে স্বীকৃত ছিল, দাসীবৃত্তি এবং গণিকাবৃত্তি নারীর নিজস্ব কোন সম্পত্তি ছিল না । পিতা বা স্বামীর ধনে তার অধিকারও স্বীকৃত ছিল না।
কোন ও শিক্ষা পাবার , ধন অর্জন করার, এবং তা ভোগ করার এমনকি নিজের শরীরকে অবাঞ্চিত সম্ভোগ থেকে রক্ষা করবার ও অধিকার নেই(মৈত্রায়নী সংহিতা ৩/৬/৩,৪/৬, ৪/৭/৪, ১০/১০/১১, তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২)।