৪. অরকিড এমন এক উদ্ভিদ, যে অন্য একটি উদ্ভিদ আশ্রয় করে বেঁচে থাকে। আমি সেই মেয়েদের অরকিড বলতে ভালবাসি-যে মেয়েরা বিয়ের আগে বাবার এবং পরে স্বামীর নামের লেজ ধরে বেঁচে থাকে। সুবর্ণা হক হঠাৎ একদিন হয়ে যায় সুবর্ণা চৌধুরী। সে যে ঘর পাল্টাল, সে যে এক আশ্রয় থেকে আরেক আশ্রয়ে গেল, কারুকে অবলম্বন করে সে যে বেঁচে রইল, নিজের নাম দিয়ে সে তা প্রমান করে। ধরে নিচ্ছি, সুবর্ণা নামের মেয়েটি সকল অর্থেই স্বনির্ভর। তবু এই যে তার নামের মধ্যে পিতা এবং স্বামীকে ধারন করার প্রবণতা, এটি বহু বছর ধরে নারী নির্যাতনের কুফল। বোকা মেয়েগুলো এই ব্যবস্থাটি মেনে নিয়ে প্রমান করেছে, শিক্ষা কোনও সংস্কার অতিক্রম করতে পারে না।
৫. ঢাকা শহরে ট্রাক ভর্তি করে গরু নিয়ে যাওয়া একটি পরিচিত দৃশ্য। এই দৃশ্যটি দেখে সেদিন এক বন্ধুকে বললাম-এরকম আমরাও, স্কুলের মেয়েরা একবার ট্রাকে করে বনভোজনে গিয়েছিলাম।
বন্ধু অসন্তুষ্ট হয়, ছিঃ গরুর সঙ্গে মেয়েদের তুলনা? আমি বলি-নয় কেন? প্রবাদ তো আছেই ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গরু।’ এর অর্থ, সম্পত্তি হিসেবে স্ত্রীর স্থান গরুরও নিচে। কারণ গরু কিনতে টাকা লাগে আর নতুন বউ আনলে টাকা পাওয়া যায়।
৬. চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘হিস্ট্রি অভ এক্সপোজার’ বলে একটি কথা আছে। এই বিষয়টি জানবার জন্য রোগীকে কিছু প্রশ্ন করতে হয়। বাইরের মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করেন কি না জিজ্ঞেস করলে রোগীটি প্রথমে আকাশ থেকে পড়ে। ছি ছি কি লজ্জার কথা, রোগীটি সজোরে মাথা নেড়ে অস্বীকার করে-না, সে কস্মিনকালেও কোনও খারাপ কাজ করেনি। চিকিৎসার স্বার্থে এই জোরটা শেষ অব্দি আর থাকে না, আশেপাশে তাকিয়ে খুব খুব নিচু গলায় তাকে বলতে হয়-হ্যাঁ, মেলামেশা করি।
ঘরে বউ আছে?
আছে।
তবে?
কোনও উত্তর নেই। রোগীটিও দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসে। এইসব রোগীর বয়স বারো থেকে বাহাত্তর। এরা ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বেকার, শ্রমিক, পুলিশ, উকিল, প্রকৌশলী, ছোট চাকুরে, বড় চাকুরে, শিল্পপতি, আমলা-কে নয়? এরা নিয়মিত পতিতালয়ে যায়। এরা পতিতার শরীর থেকে নিজ শরীরে জীবাণু (ট্রিপোনেমা পেলিডাম) বহন করে নিয়ে আসে। এরা সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়-এতে আমার কোনও আপত্তি নেই, আমি কেবল আপত্তি করি তখন, যখন এরা তাদের স্ত্রীকে সংক্রামিত করে। একটি সুস্থ মানুষের শরীরে ছড়িয়ে দেয় নিজের বিলাসিতার বিষ।
তিরিশ বছর বয়সের একটি মেয়ে, স্বামী তাকে সংক্রামিত করেছে, সিফিলিসে তার স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত, অবশ শরীর নিয়ে দুঃসহ দিন যাপন করছিল। আত্মীয়-স্বজন পড়শি ও শুভার্থীরা বলে যায়-জ্বীনের আছর ছাড়া এটি অন্য কিছু নয়। ফকির কোবরেজ এসে জ্বীন তাড়ানোর খেলা দেখিয়েছে পুরো দু’মাস। অতঃপর, সকলে এরকমই জানে যে, স্ত্রীটি একদিন অকারণে জ্বীনের বাতাস লেগে বিছানা নিল, দু’মাস পর বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ মরে গেল।
এই তো ঘটছে চারিদিকে। কেউ জানে না, এত ঘন ঘন এবরশন হচ্ছে কেন, এত মৃত শিশু জন্মাচ্ছে কেন, কেন জন্ম নিচ্ছে এত বিকলাঙ্গ শিশু। এর কারণ সিফিলিস। বড় ভয়ঙ্কর রোগ এই সিফিলিস। নিভৃত বাসরঘরে একটি অনাঘ্রাতা মেয়ে স্বামীর কাছ থেকে প্রথম উপহার নিচ্ছে সিফিলিস। রোগ সারাবার জন্য গোপনে পেনিসিলিন ইনজেকশন নিচ্ছে সমাজের ‘ভাল মানুষেরা’।
প্রতিটি সচেতন মেয়ের কাছে আমার অনুরোধ, বিয়ের আগে ছেলের রক্ত (সেরোলোজিক্যাল টেস্ট ফর সিফিলিস) পরীক্ষা করুন। ফলাফল নেগেটিভ হলে নির্দ্বিধায় বিয়ে করুন। আর পজেটিভ হলে আমি বলব, সম্পর্ক ত্যাগ করুন।
৭. সেদিন এক ভদ্রলোক অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে আমাকে বললেন,-এই যে আপনি মেয়েদের পক্ষে এত লিখছেন, মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কিছু লিখুন।
ত্রুটি-বিচ্যুতি মানে?
তিনি অতি সোৎসাহে হাত-পা নেড়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি আমাকে বোঝালেন। আমার তখন মনে পড়ে গেল আমার এক ছোট ভাই পোকা-মাকড় নিয়ে খেলা করতে বড় পছন্দ করে; একদিন সে পায়ের তলায় একটি টিকটিকি পিষে মারছিল আর আমাকে বলছিল-‘দেখ্ বুবু, টিকটিকিটা কত বদমাশ, লেজ নাড়ছে।’
যে পিষে মারে সে না জানলেও যে পিষ্ঠ হচ্ছে সে জানে সে লেজ নাড়ে আনন্দে নাকি বেদনায়।
০৭. নারী নিচ, নারী অধম, নারী মানুষ না
অনেকের ধারণা করেন বৈদিক যুগে ভারতবর্ষের নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা ছিল, ইসলাম আবির্ভাবের পর সেই মর্যাদা আকস্মিক লোপ পায়। আমি তা মনে করি না। প্রত্নতত্ত্ব, শিলালিপি, তাম্রশাসন, প্রথম যুগের পুরান, বৌদ্ধ সাহিত্যের পাশাপাশি বৈদিক সাহিত্যই বহন করে বৈদিক যুগের সকল ইতিহাস। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ও সুত্রসাহিত্যিই ( শ্রৌত, গৃহ, ধর্মসুত্র) প্রধানত বৈদিক সাহিত্য। খৃষ্ট পূর্ব দ্বাদশ থেকে ক্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের মধ্যে রচিত এই সাহিত্য সমাজের যে চিত্র গ্রহণ করি, তাতে নারী আদৌ মানুষ হিসেবে গন্য হয় না।
ঐতবেয় ব্রাহ্মণ সেই নারিকেই উত্তম বলে যেই নারী তার স্বামীকে সন্তুষ্ট করে, পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর কথার উপর কথা বলে না (৩/২৪/২৭)। যে নারী স্বামীকে সন্তুষ্ট করে না এবং স্বামীর কথার উপর কথা বলে তাকে নিশ্চয়ই অধম বলা হয়। নারী উত্তম হবে কি অধম হবে তা নির্ভর করে পুরুষের সন্তুষ্টির উপর।