মহাভারতে সতী ও কর্তব্যপরায়ণ নারীর প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে নারী জন্মের চূড়ান্ত চরিতার্থতা হচ্ছে সেবা ও শুশ্রুষায় স্বামীকে তুষ্ট করা এবং তার সন্তান ধারণ করা, বিশেষ করে পুত্রসন্তান। বিবাহিতা নারীর যশ, চরিত্র ও গুণ নষ্ট হয়ে যায়, যদি সে নারী দীর্ঘদিন পিতার বাড়ি কাটায় (১/৭৪/১২)। পিতার বাড়ি দীর্ঘদিন কাটালে নারী কলঙ্কিনী হয় (৫/৩৯/৮০)। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলেছেন—নারীর দ্বারা বংশ কলঙ্কিত হয় (১২/৪-৮)। কৃষ্ণ বলেছেন—নারী কলঙ্কিতা হলে বর্ণসংকর হয়, তার থেকে চূড়ান্ত সর্বনাশ হয় (৬/২৩/৪১)।
নারী যেন সুন্দরী, স্বাস্থ্যবান, গৃহকর্মে নিপুণ হয়। সে যেন স্বামীর জন্য, শ্বশুরকুলের জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করে এবং পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়, এবং সেই সন্তানের লালনপালন করে। নারীর কোনও পৃথক মন, পৃথক ব্যক্তিত্ব থাকতে নেই। মহাভারত আমাদের তো তা-ই বলে।
নারীর উপনয়ন হবার নিয়ম নেই। উপনয়ন হলে বিদ্যা অর্জন করতে হয়, নারীর বিদ্যা অর্জনের অধিকার নেই। নারীর জন্য বিবাহই হল উপনয়ন, পতিগৃহে বাস হল গুরুগৃহে বাস আর পতিসেবা হল বেদাধ্যয়ন (মনুসংহিতা ২/৬৭)।
মোদা কথা, নারীর কোনও অধিকার নেই শিক্ষা ও সম্পত্তিতে। নারী ব্যক্তি নয়, বস্তু এবং ভোগ্যবস্তু। তাই হাতি, হিরণ্য, রথ, অশ্ব, ভূমি ইত্যাদির সঙ্গে নারীও যোগ হয় দানের তালিকায়। এই দান চলে বিবাহে, শ্রাদ্ধে, বিজয়োৎসবে, অতিথি আপ্যায়নে, যজ্ঞে ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে। নারী হচ্ছে প্রলোভন, নারীর কামবৃত্তি স্বভাবতই পুরুষের চেয়ে অধিক (১৩/৩৮)। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন—আদিকালে পুরুষ এতই ধর্মপরায়ণ ছিল যে দেবতাদের ঈর্ষা হল, তারা তখন নারী সৃষ্টি করলেন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ধর্মচ্যুত করবার জন্য (১৩/৪২)।
নারী কেবল অমঙ্গলের জন্যই। এমন এক বিশ্বাস প্রচার করবার বড় এক দায়িত্ব নিয়েছে মহাভারত।
পাঁচ স্বামীকে তুমি কি করে তুষ্ট ও বশীভূত করেছ ? সত্যভামার এই প্রশ্নের উত্তরে দ্রৌপদী বলেছিল স্বামী এবং ভূত্যদের ভোজন শেষ না হলে আমি আহার করি না। স্নান শেষ না হলে আমি স্নান শেষ করি না। তিনি না বসলে আমি বসি না। স্বামীই দেবতা, স্বামীই গতি, আমি স্বামীদের চেয়ে বেশি শয়ন, ভোজন ও অলঙ্করণ করি না। শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করি না। সব সময় বশবর্তিনী হয়ে থাকি (২০/২৩/২৮/৩৫/৩৬)।
স্ত্রীর জন্য অন্য পুরুষের সঙ্গ নিষিদ্ধ করবার কারণ স্বামীর ঔরসজাত সন্তান-সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এই কামনা কী ভীষণ উৎকট ও উদগ্র হলে একথা বলা হয় যে—যে নারী স্বামী ব্যতীত কোনও চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষও দর্শন করে না সে-ই ধর্মচারিণী (১২/১৪৬/৮৮)। পরপুরুষ তো নয়ই, প্রকৃতির আলো হাওয়াও যেন নারীর গায়ে না লাগে, নারীর জন্য এমনই অন্ধকার সংসার কূপকেই বলা হয়েছে সবচেয়ে পবিত্র।
নারীর বশবর্তিনী রূপ সকলে বেশ উপভোগ করে। কুকুর বা বেড়াল পোষ মানলে তাকে ঘরে স্থান দেওয়া হয়, একই রকম নারীকেও।
আসলে রামায়ণ মহাভারত সব গল্প শেষে একটি সিদ্ধান্তে এসে স্থির দাঁড়ায়—তা হল—ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি, স্বাধীনতায় নারীর কোনও অধিকার নেই।
২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া
মসজিদের গেটে এক ধরনের সাইনবোর্ড থাকে। দূর থেকে এতকাল ভেবেছি সাইনবোর্ডে নিশ্চয় লেখা ‘গরু ছাগলের প্রবেশ নিষেধ।’ আসলে তা নয়। একদিন কাছ থেকে দেখেছি ওতে লেখা–মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। সম্ভবত জন্তু ও মহিলাদের ব্যাপারেই যাবতীয় নিষেধ জারি হয়।
একটি ছোট্ট শহরে জন্ম আমার। শহরের কিনার ঘেঁষে চলে গেছে ক্ষীণাঙ্গী ব্ৰহ্মপুত্র। নদীতীরে কেটেছে আমার অপরূপ শৈশব। সারা বিকেল বালুর ঘর বানিয়ে সন্ধের মুখে সেই খেলাঘর ভেঙে বাড়ি ফিরেছি সবাই। তখন ন-দশ বছর বয়স, মা রান্না করছেন, হঠাৎ আদা নেই, লবণ নেই-বাড়ির কাছের দোকানে আমাকেই যেতে হত। সকালে মুড়ি খাব, দুপুরে তেঁতুল, বিকেলে বাদাম—সবই দৌড়ে দৌড়ে আমাকেই কিনতে যেতে হত। দিন যাচ্ছে, হঠাৎ একদিন কোনরকম কারণ ছাড়াই আমাকে মোড়ের দোকানে যাওয়া নিষেধ করা হল। কেন নিষেধ, কেন নিষেধ–খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আমি নাকি বড় হয়ে গেছি, আর বড় হয়ে গেলে মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। ঘরে বসে অবসর সময়ে ধর্মের বই পড়তে হয়, ঘরের টুকটাক কাজকর্ম করতে হয়। তখন থেকেই নিষেধ শুরু হল আমার ওপর। শুধু আমার কেন, তখন থেকেই নিষেধের লাল বৃত্ত আঁকা হয় প্রতিটি মেয়ের চারদিকে।
একটু একটু করে বড় হচ্ছি। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা নিষেধ, বিকেলে ছাদে ওঠা নিষেধ, কখনও কখনও আদা ছাড়া পিঁয়াজ ছাড়াই রান্না হচ্ছে তবু আমার মোড়ে যাওয়া নিষেধ। একদিন ঘরে পরবার জন্য দেখি আমার জন্য তিনটে পায়জামা তৈরি হচ্ছে। এত পায়জামা অথচ আমাকে না জানিয়েই, আমি আনন্দ এবং বিস্ময় দুইই প্রকাশ করলাম। মা বললেন তোমার জন্য আজ থেকে হাফপ্যান্ট নিষেধ। নিষেধ বাড়ছে। একদিন দুপুরে মা তার একটি শাড়িকে চার টুকরো করে এক টুকরো আমার দু’কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন, বললেন এখন থেকে ঘরে পরবে। অর্থাৎ আমাকে ওড়না পরতে হবে। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। মা নির্বিকার।