সীতা কৌশল্যাকে বলে তন্ত্রীহীন বীণা বাজে না। চক্রহীন রথ হয় না। পতিহীনা নারী শতপুত্রের জননী হলেও সুখ পায় না (২/৩৯/২৯)। সীতা রামকেও বলে নারীর একটি গতি স্বামী, দ্বিতীয় পুত্র, তৃতীয় আত্মীয়রা, চতুর্থ কোনও গতি তার নেই (২/৬১/২৪)।
নারীর জন্য স্বামী জিনিসটি অর্থাৎ পুরুষ জিনিসটি খুব মূল্যবান। পুরুষ যদি বৃক্ষ হয়, নারী তার গায়ে জড়ানো পরজীবী লতা। বৃক্ষের আশ্রয় ছাড়া পরজীবী লতা যেমন বাচতে পারে না, তেমনি পুরুষের আশ্রয় ছাড়া নারীর বাঁচাও অসম্ভব।
দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর রাম সীতাকে প্রথম দেখেই বলে—যুদ্ধ করে যে জয়লাভ করেছি সে তোমার জন্য নয় (৬/১১৫/১৫)। নিজের বিখ্যাত বংশের কলঙ্ক মোচনের জন্য (৬/১১৫/১৬)। রাম আরও বলে—যাও, বৈদেহি, তুমি মুক্ত। যা করণীয় ছিল তা আমি করেছি। আমাক স্বামীরূপে পেয়ে তুমি রক্ষসের গৃহে জরাগ্রস্ত যাতে না হও তাই আমি রাক্ষসকে হত্যা করেছি। আমার মত ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন লোক পরহস্তগতা নারীকে কেমন করে এক মুহুর্তের জন্য ধারণ করবে ? তুমি সচ্চরিত্রই হও বা দুশ্চরিত্রই হও মৈথিলি, তোমাকে আমি আজ ভোগ করতে পারি না, তুমি সেই ঘিয়ের মত যা কুকুরে লেহন করেছে (রামায়ণ ৩/২৭৫/১০-১৩)।
রাম খুব সহজেই সীতাকে সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়। সীতার প্রতি ভালবাসার কারণে সে রাবণকে হত্যা করেনি, করেছে রামের স্ত্রী হয়ে সীতা যদি রাবণের প্রাসাদে জরাপ্রাপ্ত হয়, রামের তবে শৌর্যহানি ঘটে, তাই। রাম নিজের শৌর্যহানি চায়নি বলেই রাবণকে হত্যা করেছে। রাম সূক্ষ্মধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি পরপুরুষ-ছোঁয়া নারীকে সে কী করে ধারণ করবে? তাই সীতা সৎচরিত্র অথবা দুশ্চরিত্র হোক, রামের পক্ষে তাকে ভোগ করা সম্ভব নয়। কুকুরে চাটা ঘি যেমন যজ্ঞে ব্যবহার করা যায় না, তেমনি পরপুরুষ-ছোঁয়া নারীও তার স্বামীর ‘ভোগে’ লাগে না।
আমার মনে হয়, রামই সীতার প্রতি সবচেয়ে অবিচার করেছে, এত অন্যায় পাষণ্ড রাবণও করেনি। রাম কখনও জানতে চায়নি রাবণ সীতাকে ধর্ষণ করেছে কি না, কেবল সন্দেহের বশে রাম সীতাকে অপবাদ দিয়েছে। কেবল নারীর সতীত্ব নিয়ে তুমুল হইচই, অথচ সতী শব্দের কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। তাই দীর্ঘ বিচ্ছেদের সময় রাম কি করেছে, কাকে ছুঁয়েছে বা কেউ তাকে ছুঁয়েছে কি না এ প্রশ্ন করবার স্পর্ধা কারও ছিল না।
নিজের সতীত্ব বা শুচিতা প্রমাণের জন্য সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। প্রজাদের সন্দেহ ঘোচাবার জন্য বাল্মিকী সীতাকে আবার অগ্নিপরীক্ষার কথা বলে। বেঁচে থাকলে সীতাকে সারাজীবন অগ্নিপরীক্ষাই দিয়ে যেতে হত, তার মুক্তি নেই কিছুতে, অসহায় নারীকে পরপুরুষ স্পর্শ করেছে—এই অমার্জনীয় অপরাধ থেকে তার মুক্তি নেই।
সীতা পৃথিবীর কাছে আশ্রয় চেয়েছে। কোনও পুরুষ তাকে আশ্রয় দেয়নি। যোগ্য সম্মান দেয়নি। তাই কোনও পুরুষের কাছে, পুরুষশাসিত সমাজের কাছে সীতা আশ্রয় চায়নি। নিজের ব্যক্তিত্ব রক্ষা করবার জন্য সে চরম সত্যক্রিয়ার শপথ গ্রহণ করে নিজেকে বাঁচিয়েছে। তাবৎ অসত্য ও অন্যায় থেকে, অসম্মান থেকে এ তো এক ধরনের বেঁচে যাওয়াই।
পতি নারীর একমাত্র গতি। তার আছে স্ত্রীকে সন্দেহ করবার, ত্যাগ করবার এবং শাস্তি দেবার অবাধ অধিকার। সকল পুরুষের আছে নারীর চরিত্রে সন্দেহ করবার অধিকার, আছে সেই সন্দেহে নিরপরাধ নারীকে দণ্ড দেবার অধিকার। রামায়ণ নারীকে মানুষের মর্যাদা দেয়নি, বরং এ শিক্ষাই দিয়েছে যে পুরুষের একনিষ্ঠতার দাবি সমাজ করে না, আর নারীর একনিষ্ঠতা দিয়ে, সতীত্ব বা শুচিতা দিয়েও সে সমাজে সম্মান পায় না—তাকে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে বারবার প্রমাণ দিতে হয় যে তার ‘সতীত্বনাশ’ হয়নি।
যেহেতু ‘সতীত্ব’ শব্দটি কেবল নারীর জন্য বাধা, যেহেতু সতীত্ব শব্দটি পুরুষের জন্য নয়, তাই পুরুষকে অগ্নিপরীক্ষার ঝামেলায় যেতে হয় না। নারীকে কেবল একা সতী হতে হয়, শুদ্ধ হতে হয়, এবং স্বামীর ভোগের জন্য নিজেকে যোগ্য করতে হয়।
সীতার সতীত্ব দেখে লোকে মুগ্ধ হয়। সীতার অগ্নিপ্রবেশে লোকে তৃপ্ত হয়। সীতার সত্যক্রিয়ায় লোকে প্রমোদিত হয়। নারীর চূড়ান্ত অবমাননা নির্লজ্জ অসঙ্কোচে অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে রামায়ণ মহাভারতে। এই রামায়ণ মহাভারত দেখতে লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সভ্যতা বলে পৃথিবীতে যদি কিছু থেকে থাকে তবে লজ্জায় তারও সীতার মত উচ্চারণ করা উচিত–‘মাধবী দেবী (পৃথিবী) আমাকে বিবর (আশ্রয়) দিন। আমি যদি সত্য হই মাধবী দেবী আমাকে বিবর দিন ।’
২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র
মহাভারতের প্রথম অংশের সঙ্গে শেষ অংশের ব্যবধান অন্তত আটশ’ বছরের। এই দীর্ঘ সময়ের সামাজিক বিবর্তন-চিত্রও ওতে বেশ স্পষ্ট। আদি ক্ষত্রিয় কাহিনী রচনার পর কিছু নৈতিক কাহিনী রচিত হয় যা সার্বজনীন, শেষতম সংযোজনের কর্তা ভৃগুবংশীয় ঋষিরা। এটি ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলে খ্যাত। নারীর অবনমনের চিত্র এই অংশে নগ্নরূপে উপস্থিত।
মহাভারতের এই অংশে খুব স্পষ্ট করে লেখা আছে নারী অশুভ, সমস্ত অমঙ্গলের হেতু, কন্যা দুঃখের (১/১৫৯/১১)। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন–নারীর চেয়ে অশুভতর আর কিছুই নেই। নারীর প্রতি পুরুষের কোনও স্নেহ মমতা থাকা উচিত নয় (১২/৪০/১)। পূর্বজন্মের পাপের ফলে এ জন্মে নারী হয়ে জন্মাতে হয় (৬/৩৩/৩২)। নারী সাপের মত, পুরুষের তাকে কখনোই বিশ্বাস করা উচিত নয় (৫/৩৭/২৯)। ত্রিভুবনে এমন কোনও নারীই নেই, যে স্বাধীনতা পাবার যোগ্য নয় (১২/২০/২০)। প্রজাপতির ইচ্ছা যে, নারী স্বাধীনতা পাবার যোগ্য নয় (১২/২০/১৪)। যে ছ’টি বস্তু এক মুহুর্তের অসতর্কতায় নষ্ট হয় তা হল–গাভি, সৈন্য, কৃষি, স্ত্রী, বিদ্যা এবং শূদ্রের সঙ্গে সম্বন্ধ (৫/৩৩/৯০) ।