মানুষকে দ্বিচক্র শকটের সঙ্গে তুলনা করে রোকেয়া তার অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে লিখেছেন– ‘যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না—সে কেবল একই স্থানে (গৃহ কোণেই) ঘুরিতে থাকে।’
এদেশে বংশ নির্ধারণ হয় পৈত্রিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। পৈত্রিক পরিচয়ই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে নারীর সতীত্বের উপর রাখা হয় কড়া নজর তাই যৌন শুচিতা পুরুষের জন্য না হলেও নারীর জন্য প্রয়োজনীয়। এইসব যুক্তি দেখিয়ে সমাজের ধূর্ত লোকগুলো নানা রকম সুবিধে নিচ্ছে, যারা সুবিধে নিচ্ছে তারা ‘স্বামী’ দলভুক্ত।
ধর্ম তাদের যথেচ্ছাচারী করেছে। আদিম থেকে আধুনিক সমাজ–সব সমাজই তাদের বিস্তর সুবিধে দিয়েছে। কারণ এ সবের রচয়িতা এবং নির্মাতা স্বামীদলভুক্ত পুরুষ। ইসলাম তাদের চার বিয়ে করবার অধিকার দিয়েছে। অনিতা নামে পাকিস্তানের এক মেয়ে সেদিন মেয়েদের চারটি বিয়ের কথা বলেছিল। শুনে আঁতকে উঠেছে স্বামীদলভুক্তরা। স্বরচিত আসন আবার টলে যায় কী না কে জানে।
শুধু ইহকালই নয়, পরকালেও নিজেদের ব্যবস্থা আরামপ্রদ করে রেখেছে তারা। সত্তর জন হুর বেষ্টিত জীবন শুধু তারাই ভোগ করবে, আর মেয়েদের কপালে ইহকালের স্বামীটিই জুটবে। যে কোন সচেতন মানুষের জন্য এই পক্ষপাতিত্ব অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কিন্তু মানুষ সচেতন নয়। মানুষ সুবিধাভোগী, মানুষ স্বার্থপর। মানুষের স্নায়ুতন্ত্র এখন শুভ কাজে নয়, অশুভ কাজেই বিকশিত হয় বেশি। আর কিছু মানুষ, যাদের মেয়ে মানুষ’ বলতেই মানুষেরা পছন্দ করে, ওরা কেবল হাততালি দেয়। সবার নিচে, সবার পিছে, সবহারাদের কাতারে দাড়িয়ে ওদের কাজ শুধু হাততালি দেয়া। যে যা-ই বলে মেনে নেয়া।
ওরা আসলে মানুষ নয়। ওরা ভোগ্যবস্তু। ‘নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণরৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং খেতখামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট মনোরম করা হইয়াছে। এইসব ইহ জীবনের ভোগ্যবস্তু।’ এই কথা আমার নয়। এই কথা সূরা আল ইমরানের চৌদ্দ আয়াতের কথা। আয়াতের উল্লিখিত মানুষ—যারা কখনও নারী নয়—যারা পুরুষ, নারী তাদের ভোগ্যবস্তু। নারী শুধু ভোগ্যবস্তুই নয়। নারী শস্যক্ষেত্রও বটে। ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতঃপর তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করিবে।’ (সূরা বাকারা ২২৩ আয়াত)
বাংলাদেশে একদিকে চলে ইসলাম চর্চা, অন্যদিকে নারীমুক্তি আন্দোলন। অনেকে বলে দুটোতে বিভেদ নেই। বলে, ইসলাম নারীকে যত সন্মান দিয়েছে, আর কোনও ধর্ম নারীকে তত সম্মান দেয়নি। সূরা নিসার ৩৪ আয়াতে আছে—‘পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ তাহদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন এবং পুরুষ তাহদের ধন সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধবী স্ত্রীরা অনুগত, এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে উহারা স্বামীর অনুপস্থিতিতে সতীত্ব ও স্বামীর আর সব অধিকারের হিফাজত করে। স্ত্রীদের মধ্যে যাহাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাহাদিগকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাহদের শয্যা বর্জন কর এবং তাহাদিগকে প্রহার কর।’ সম্মানের মাত্রা সম্ভবত এটুকুতেই বেশ অনুমান করা যায়।
ধর্ম ব্যবসায়ীরা ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’ নামক গ্রন্থ বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছে। আমাদের অর্ধশিক্ষিত ছেলেরা ভালবেসে স্ত্রীকে উপহার দেয় ‘স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য’। শিক্ষিতরা হয়ত হাতে হাতে কিছুই দেয় না, মনে মনে কিন্তু দেয়। আর সেই দেওয়া হাতে দেওয়ার চেয়ে কম মারাত্মক নয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়ে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এর কারণ, ঘরের পুরুষদের খাবার পর উচ্ছিষ্ট যা থাকে, মেয়েরা তাই খেয়ে উদর পূর্তি না হলেও হৃদয় পূর্তি করে।
স্বামীর এঁটো উচ্ছিষ্ট খাওয়ার সংস্কার বাঙালি সমাজে নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের যে সামাজিক চিত্র বৈদিক সাহিত্য বহন করছে তাতে দেখি–‘ভুক্তোচ্ছিষ্টং বধৈব দদাৎ’ অর্থাৎ খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবে (গৃহ্যসূত্র ১/৪/১১)। জীর্ণ জুতো কাপড় দাসকে দেবার এবং খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবার বিধান শাস্ত্রে আছে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত। আর এ কথা স্বীকার্য যে, অশিক্ষিত মানুষ ভাল মন্দ শিক্ষা নেয় ধর্ম থেকে। আর আমাদের ধর্ম যেখানে নারীর বিরুদ্ধে খড়গ উচিয়ে আছে, সেখানে নারী স্বাধীনতা নিয়ে এই সব লেখালেখি পুরুষ পাঠকদের জন্য অবসরের মজাদার খোরাক জোটানো ছাড়া আর কিছু নয়।
২৬. রামায়ন-মহাভারত
গত বছরের শেষদিকে কলকাতা গিয়েছিলাম। সকাল দশটার দিকে রাস্তায় হাঁটছি আর অবাক হচ্ছি কলকাতাকে এত ফাঁকা লাগেনি তো কখনও ! যেন পুরো কলকাতা কোথাও নিমন্ত্রণ খেতে গেছে। বিকেলে তারাপদ রায়ের বাড়ি গিয়ে শুনলাম রোববার সকালে কলকাতা কলকাতাতেই থাকে, তবে ঘরের বাইরে বেরোয় না, কারণ দূরদর্শনে তখন ‘মহাভারত’ দেখায়। সারা শহরে তখন আলোচনা তুঙ্গে কবে হবে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। যুবকেরা গোপনে অপেক্ষা করে বস্ত্রহরণ দৃশ্যে রূপা গাঙ্গুলীর শরীরখানা দেখে নেবার। বস্ত্রহরণের চিত্রায়ণ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় তখন তুমুল হইচই।
অ্যান্টেনা উঁচু করে এদেশে আমিও কিছুদিন রামায়ণ দেখেছি। কিছু দেখলে তার আগাগোড়া না জেনে আমার স্বস্তি হয় না। রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনায় সীতা বলে, ‘হে নরব্যাঘ্ৰ, তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বর্গেও রুচি নেই (২/২৭/২১)। তোমার বিরহে, রাম, আমাকে প্রাণত্যাগ করতে হবে (২/২৮/৫)। তুমি পরিত্যাগ করলে আমার মৃত্যুই ভাল (২/৩০/২০)’। এ কি কেবলই প্রেম ? প্রেমে অন্ধ হয়ে সীতার স্বর্গত্যাগ ? প্রেমের অতল জলে ডুবে যদি কেউ মৃত্যুর কথাও বলে, মন্দ শোনায় না। কিন্তু সীতার উপর পতিব্ৰতাধর্ম আরোপ করে ব্রাহ্মণেরা যখন বলে—স্বামীই পরম দেবতা (২/১৯/১৬), ইহজগতে ও পরলোকে সর্বদা পতিই হল নারীর একমাত্র গতি (২/২৭/৬); সে প্রাসাদের উপরে, বিমানে, আকাশে যেখানেই হোক স্বামীর পদচ্ছায়ার বিশিষ্ট স্থান (২/২৭/৯)—তখন নিশ্চয়ই একে আর যা-ই বলা যাক, প্রেম বলতে বাধে।