আমি মোট পঁচিশজনকে বলেছিলাম একটি ঘর খুঁজতে। পঁচিশজনের মধ্যে বিশজনই আমার সঙ্গে আর দেখা করেনি। পাঁচজন জানিয়েছে বাড়ি ভাড়া আজকাল খুব বেড়ে গেছে, মহল্লায় টাউট-বাটপারের সংখ্যা খুব বেশি।
আমি নিজে সেদিন অন্তত ছ’টি বাড়িতে গিয়েছি। সকলেই জিজ্ঞেস করেছে পরিবারের সদস্য ক’জন। আমি বলেছি আমি এবং আমার সঙ্গে এগারো বছরের একটি মেয়ে, লিলি–ও আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। ছিমছাম মানুষ, কোনও বুট-ঝামেলা নেই, বাড়িঅলাদের খুশি হওয়ার কথা, অথচ তারা খুশি হয় না। তারা আরও কিছু যেন চায়। তাদের আরও একজন কাউকে দরকার হয়। নিঝঞ্ছাট একটি ভাড়াটে তারা মোটেও পছন্দ করেন না। আসলে তাদের দরকার একজন পুরুষলোকের। আমার সঙ্গে যেন-তেন একটি পুরুষলোক হলেই বাড়িঅলা খুশি। পুরুষলোকের যদি আমার কোনও প্রয়োজন না থাকে, যদি পুরুষলোক দ্বারা আমার স্নায়ুর অত্যাচার হয়, তবে ? আমার না হোক, পুরুষলোক বাড়িঅলার প্রয়োজন, সমাজের বাঘা বাঘা লোকের জন্য প্রয়োজন।
এই ঢাকা শহরে এ-বাড়ি ও-বাড়ি করে আমার দিন কাটাতে হয়। আমার কোনও নিজস্ব ঘর নেই। যে ঘরে আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারব, যে ঘরে আমার বাবা এসে আমাকে পাশে নিয়ে পুরনো দিনের গল্প করবে, যে ঘরে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বোন গেয়ে উঠবে—‘এই যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয় হরণ’, যে ঘরে আমার দাদা হঠাৎ এসে বলবে—‘আজ সারাদিন তোর ঘরে ঘুমোব, আজ আমার মন ভাল নেই।’
ভার্জিনিয়া উল্ফের ‘A Room of One’s Own’ বইটি পড়তে পড়তে আমার রাত কাটে। ওতে লেখা—‘নারী সমাজের পশ্চাৎপদতা এবং অক্ষমতার জন্য দায়ী হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, মহিলা লেখককে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তাকে অবশ্যই পুরুষশাসিত সমাজের শক্তিশালী পুরুষের শোষণ, কুসংস্কার ও অর্থনৈতিক স্বার্থপরতার মত দুর্বার প্রতিবন্ধকতাগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। ন্যূনতম পক্ষে একান্ত নিজস্ব একটা ঘর শুধুমাত্র এই অবস্থা থেকে নারীকে মুক্ত করতে পারবে—এই ঘরের চাবিটা তার হাতেই থাকবে এবং ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে তার স্বাধীনতা থাকবে তার সহোদর ভাইদের যেমন তাদের ঘরে বিচরণের স্বাধীনতা আছে, তারই সমতুল্য।’
২. সেদিন এক অনুষ্ঠানে আমার পাশে এসে বসলেন এক মহিলা, আমার সঙ্গে তার পরিচয় নেই। তিনি আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন, পরিচয়ের জন্য স্বাভাবিকভাবেই কিছু কথাবার্তার প্রয়োজন হয়। তিনি আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন, যেমন—১। আপনার স্বামী কী করেন ? ২। আপনার স্বামীর নাম কী ? ৩। স্বামীর পদবী কী ? ৪। স্বামীর বাড়ি কোথায় ? ৫। স্বামীর ভাই-বোন ক’জন ? ৬। ভাইরা কী করে ? ৭। বোনদের বিয়ে হয়েছে কি না ? ৮। তাদের সন্তান ক’জন এবং কেউ কোথাও পড়াশোনা করে কি না আর পড়াশোনা করলে কে কোথায় পড়ছে? ৯। ভগ্নিপতিরা কে কী করে ? ১০ স্বামীর বাবা কোথায় কী করছেন? ১১। স্বামীর পদোন্নতির সম্ভাবনা আছে কি না ? ১২। স্বামীর কাকারা কে কোথায় কী করছে ? ১৩। স্বামীর মামারা কে কোথায় কী অবস্থানে আছে ? ১৪। স্বামীর খালা ও ফুপারা বিয়ের পর কে কোথায় কেমন আছে ? ১৫। স্বামীর মাসোহরা কত ? ১৬। স্বামী এই অনুষ্ঠানে আসেনি কেন ? ১৭। তার কোথাও কী কোনও কাজ আছে কী নেই? ১৮। স্বামীর স্বাস্থ্য ভাল না খারাপ ? ১৯। স্বামী সাধারণত কী খেতে পছন্দ করে? ২০। স্বামী কি দুপুরে ঘুমোয় ? ২১। স্বামী রাত কটা পর্যন্ত জেগে থাকে ২২। স্বামীর মেজাজ-মর্জির অবস্থা কেমন? ২৩। স্বামী কী ধরনের গান পছন্দ করে ? ২৪। স্বামী টিভির কোন অনুষ্ঠান দেখতে ভালবাসে ? ২৫। স্বামী সাধারণত কী ধরনের পোশাক পরে ?
প্রায় দেড় ঘণ্টা তার নানা প্রশ্নের উত্তর দেবার পর তিনি সন্তুষ্ট হলেন যে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটল। কিন্তু পাঠক, আমাকে বিশ্বাস করুন আমি এক বর্ণ বানিয়ে বলছি না—সেই মহিলা আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেননি আমি কে, আমার বাড়ি কোথায়, আমার বাবা-মা কে, আমি কী কাজ করি, আমার নামই বা কী। যে মহিলা আমার সঙ্গে পুরো দেড় ঘণ্টা কথা বললেন তিনি আমার নাম পর্যন্ত জানেন না অথচ তিনি বড় পরিতৃপ্ত যে আমার সঙ্গে তিনি পরিচয় পর্ব সারলেন।
২৫. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
পতি ধর্ম, পতি কর্ম পতি সারাৎসার।
পতি ভিন্ন রমণীর গতি নাহি আর।
পতি আজ্ঞা, সতী পক্ষে, বেদের সমান।
পতি তুষ্ট হলে, তুষ্ট প্রভু ভগবান।’
বাঙালি গৃহস্থ ঘরের দেওয়ালে এক সময় এ জাতীয় সচিত্র ‘সতীর সার কথা’ সযত্নে শোভা পেত। মেয়েরা রঙিন সুতোয় লিখে রাখত—‘পুরুষ তমাল তরু প্রেম অধিকারী, নারী যে মাধবীলতা আশ্রিতা তাহারি।’ পৃথিবী বার বার আবর্তিত হচ্ছে, তবু পতি প্রাণ, পতি মান, পতিই ভূষণ সেই যে কবে মানুষের মস্তিষ্কের কোষে কোষে গেথে ছিল তা আজও অমলিন।
‘রমণীর পতি বিনা গতি নাই।
পতির বিষয়ে বিশেষ জানাই।
পতি যা বলেন তাহাই করিবে।
পরম যতনে পতিকে সেবিবে।
পতি খেলে খাবে, না খেলে খাবে না।
পতি শুলে শোবে, না শুলে শোবে না।’
এ ধরনের হিতোপদেশ মেয়েরা ধর্মের বাণীর মত মুখস্থ করত। নতমুখে বলত—‘পতির মহিমা আমি কী বণিতে পারি। না পারেন ভাগীরথি, আমি ক্ষুদ্র নারী।’ নারী নিজে মানে সে ক্ষুদ্র। নারী এই কথা অন্ধের মত বিশ্বাস করে যে সে ক্ষুদ্র, অতিশয় ক্ষুদ্র। যে স্বামীভক্তি বা পাতিব্ৰত্য চিত্র সেকালের নারীরা লালন করত, একালের নারীরা তাদের থেকে কোনও অংশে কম যায় না। কত সংস্কার ভাঙে, বদলায়—কিন্তু নারী নিয়ে যে সংস্কার তার কেবল বিস্তার আছে, বিলুপ্তি নেই। স্বামী শব্দের অর্থ প্রভু, মনিব, অধিপতি, মালিক ইত্যাদি। স্বামী শব্দটি বাংলা ভাষায় যতদিন ব্যবহৃত হবে পুরুষ ততদিন সঙ্গত কারণেই কর্তা, প্রভু, মনিব ও মালিক। বেগম রোকেয়া যুক্তি দিয়েছিলেন–‘দাসী শব্দে অনেক শ্ৰীমতী আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, স্বামী শব্দের অর্থ কী? দানকর্তাকে দাতা বলিলে যেমন গ্রহণকর্তাকে গ্রহীতা বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর বলিলে অপরকে দাসী না বলিয়া আর কী বলিতে পারেন?’