আমি এইরকম স্তম্ভিত হই,যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্রী নিবাসগুলো সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়,হাঁস-মুরগীর খোঁয়ার যেমন বন্ধ হয়।অচিরেই এইসব গৃহপালিত জন্তুর নাম নারীর সমার্থ শব্দ তলিকায় স্থান পাবে,এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। একটি ছাত্র তার প্রয়োজন মত হলে বা হোষ্টেলে যাওয়া আসা করে,সেক্ষেত্রে ছাত্রীর প্রয়োজন অপ্রয়োজন জরুরি কোন বিষয় নয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার একইরকম অনুশীলন ও প্রতিযোগিতায় দুজনেই অংশগ্রহণ করেছে; ছাত্রীর জন্য কিছু দুর্বল, কিছু সহজ,কিছু নিচু স্থরের শিক্ষাব্যাবস্থা সেখানে নেই। নির্দিষ্ট একটি সময়ে হলে ফিরবার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ যে বাণী দিবেন,তা শুনে যে কোন দুর্বল স্নায়ু ও অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ সহজে কাবু হয়ে যাবে,কিন্তু নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন মেয়েরা এই অবৈধ ও অশ্লীল নিয়মটি মেনে নিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করেছে -তারা অশহায়, দুর্বল, তারা পুরুষের ভোগের সামগ্রী, প্রাচীর এবং প্রহরী ছাড়া তারা নিরাপদ নয়। (ছাত্রীদের হল সন্ধ্যায় বন্ধ হয় বলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তাঁদের প্রবচনে-কথনে ছাত্রীদের পতিতা বলেন না? বলেন। বলবেন।)
আসলে রাত কিছু নয়, অন্ধকার কিছু নয়, দুর্ঘটনা কিছু নয়, সকল কিছুর উদ্দ্যেশ্য নারীকে দমন করা। যাবতীয় বিপর্যয়, বিঘ্ন, দুর্যোগ, সঙ্কট ; যাবতীয় দু:সময়, দু:শাসন, সন্ত্রাস, অতিক্রম করে সে আবার না স্বাবলম্বী হয়ে উঠে, স্বছন্দ হয়ে উঠে, সবল ও দুর্লভ হয়ে উঠে।
আর তা যদি হয়ে উঠে তাহলে তো ভীষন অসুবিধে। কারণ বিদ্যাধরী মেয়ে ‘আধুনিক ক্রীতদাসী’ হওয়ার জন্য চমৎকার।স্বামীকে মুগ্ধ ও তুষ্ট করবার জন্য এদের নিরলস রুপচর্চা,এদের সভা সমিতি, শিল্প সংস্কৃতি, নারী আন্দোলন -সবই হচ্ছে ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি বাংগালী মেয়েদের বালিশের ওয়াড়ে রংগীন সুতোয়, ‘সতীর দেবতা পতি’ চর্চার আধুনিকরণ।
জার্মেইন গ্রীয়ারের লেখা ‘ফিমেল ইউনাক’ গ্রন্থে মেয়েদের হাইহিল জুতো আবিষ্কারের একটি চমৎকার কারণ তুলে ধরা হয়েছে। পুরুষ যখন একটি মেয়েকে আক্রমন করে,মেয়েটি নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রথমে দৌড় দেয়, সে যেন ভাল দৌড়াতে না পারে, হাইহিলের ব্যবস্থা সেজন্যই।
০৩. পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা
আমি ভারত বেড়াতে গিয়েছি। কলকাটা, দিল্লী, আগ্রা, জয়পুর, সিমলা, কাশ্মীর ঘুরে এসেছি শুনে প্রথম যে প্রশ্নটি লোক করে, সে হোল -সঙ্গে কে ছিল? কাশ্মীর এর বরফাচ্ছাদিত গূলমার্গ, বানিহাল টাণেল, হিমালয়ের উপর ঝুলন্ত চেয়ার, ডাল থেকে সিকারা হাউজবোট সম্পর্কে আমি উচ্ছ্বসিত হই। কিন্তু তাদের ওই এক প্রশ্ন- সঙ্গে কে ছিল?
আমি উত্তরে বলি -একা।
একা? একা একটি মেয়ে বাইরে বেড়াতে যেতে পারে নাকি? কার ও বিশ্বাস হয় না।এরপর কেউ আমার শান্তিনিকেতন, দীঘার সমুদ্র, কন্যাকুমারী বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রতি আগ্রহ দেখায় না । যে চিন্তাটি তাদের মস্তিষ্ক জুরে ঘেটি পাকায় , তা হল সঙ্গে কে ছিল। আমি একবার বলেছিলাম, সঙ্গে অতসী, কৃষ্ণকলি আর মল্লিকা ছিল।
আর?
আর কেউ না।
কেন? পুরুষ মানুষ কেউ ছিল না?
না।
লোকে অবাক চোখে তাকায়। পুরুষ ছাড়া মেয়েরা একজনও যা সাতজনও তা।
এক্ষেত্রে আমার বয়সী একটি ছেলে যদি একইভাবে দার্জিলিং, সিমলা, কাশ্মীর ঘুরে আসত, একা, তবে বিমোহিত সকলেই বলত, আহা কি পবিত্র মন! কি চমৎকার রুচি ! কি অগাত সৌন্দর্য বোধ ! কি অপূর্ব জীবন !
ধরা যাক আমার খুব সমুদ্র দেখতে ইচ্ছা করছে, আমার খুব সীতাকুণ্ড পাহাড়ে যেতে ইচ্ছা করছে, আমার খুব যেতে ইচ্ছা করছে শালবন বিহার, কাপ্তাই লেকে স্পীডবোট নিয়ে সারা বিকেল ঘুরতে ইচ্ছে করছে, সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে পদ্মায়, তখন কি করতে হবে? একজন পুরুষ জোগাড় করতে হবে।
পুরুষ ছাড়া মেয়েরা দূরে কোথাও যেতে পারে না। সে যে বয়সের ই হোক না কেন। বাসে চরলে কন্ট্রাক্টর জিজ্ঞাসা করে, আপনার সঙ্গের লোক কই? তারা নিশ্চিত সঙ্গে একজন লোক অর্থাৎ পুরুষ আচেই। নানা জায়গায় পুরুষ থাকা না থাকা নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয় মেয়েদের। সঙ্গে যদি পুরুষ থাকে, সে যদি স্বামী অথবা নিকটাত্মীয় না হয়, তাহলে অসুবিধে- কে এই লোক? কি সম্পর্ক? আর যদি সঙ্গে পুরুষ না থাকে তাহলেও অসুবিধে নেই কেন? অত্যন্ত সচেতন ভাবে পুরুষের উপর মেয়েদের নির্ভর করানো হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পিতার কন্যারা অথবা স্বামীর বধূরা দুচার টে আত্মীয় বাড়ি আর মার্কেট ঘরাঘুরি করেই ভাবে ‘ নারী স্বাধীনতা’ হয়ে গেল।
আসলে তা হয় না। মেয়েদের পায়ের শৃঙ্খল খুব শক্ত শৃঙ্খল। হাত-পা ছেড়ে বসে থাকলে কেউ তার শিকল খুলে দিয়ে বলবে না বেরিয়ে আয়। রূপকথায় শুভার্থী পাওয়া যায় বাস্তবে নয়।
মেয়েরা এমন শখ করে পায়ে মল পরে। এই মল জিনিসটি আবিস্কারের এবং মেয়েদের পরানোর পেছনে একটি উদ্দেশ্য আছে। মল পরলে মেয়েদের গতিবিধি- তারা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, শব্দ শুনে জানা যায়। আর বোকা মেয়েরা সেই মল, যা একটি সিমানার ভেতরে তাদের বন্দী রাখে,তা পরে, ভাবে যে তাদের পায়ের সৌন্দর্য বুঝি বেড়েছে।
০৪. চরিত্র সচেতন বুদ্ধিজীবি