স্বামী অর্থ প্রভু। যে কোনও শ্রেণীর মেয়ের জন্য স্বামী তার প্রভু। সে তার অর্ধাঙ্গিনী হলেও স্বামী তার অর্ধাঙ্গ নয়। অভিধানে ‘অর্ধাঙ্গিনী’, ‘সহধর্মিণী’ শব্দগুলোর কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। ইংল্যান্ডের একজন বুদ্ধিজীবী জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-৭৩) তাঁর দি সাবজেকশান অভ ওম্যান (১৮৬৯) গ্রন্থে লিখেছেন–‘আজকের দিনে বিবাহই হল একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে আইনত দাসপ্রথা বজায় আছে। আমাদের বিবাহ-আইনের মাধ্যমে পুরুষেরা লাভ করে একটি মানুষের উপর সর্বময় অধিকার। লাভ করে প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, লাভ করে তালাক ও বহু বিবাহের অবাধ অশ্লীলতা।‘
২ পিতৃকুলে জন্ম নিয়ে শ্বশুরকুলে যার জীবনযাপন, উত্তরাধিকার প্রশ্নে তারা যদি সম্পত্তির ভাগ পায় তবে উভয়দিকের অংশ পেয়ে তাদের প্রাপ্য যদি আবার বেশি হয়ে পড়ে তাই আপত্তি ওঠে। দুই স্থানে তাদের দাবি বলে কোনও দাবিই আর কোনও কুলে টেকে না। প্রবাদ আছে ধোপার যে কুকুর, সে না-ঘাটের, না-ঘরের।
মৈত্রায়ণী সংহিতা (৪.৬.৪) বলে—‘কন্যা জন্মিলে সবাই তুচ্ছ করে, সে ফেলনা। পুত্র তো ফেলনা নহে, তাই কন্যা উত্তরাধিকার পায় না, পুত্র পায়। কন্যা পরের ঘরে যায়, তাই সে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর।‘
তৈত্তিরীয় সংহিতায় (৬.৫.৮.২৭) আছে—‘নারীদের দ্বারা গৃহ্যমান হইতেছে ইহা সোম সহ্য করিতে পারিল না। তাই ঘৃতকে বজ্র করিয়া মারিল। যখন তাহা শক্তিহীন হইল তখন তাহারা গ্রহণ করিল। তাই নারীগণ নিরিন্দ্রিয় অর্থাৎ শক্তিহীনা, তাহারা নিচ-পুরুষ হইতেও নিচ, এজন্যই তাহারা আদায়াদী অর্থাৎ দায়প্রাপ্তির অযোগ্য।’
আচার্যদের মতে—‘কন্যাকে দান-বিক্রয়-ত্যাগ করা চলে, পুত্রকে দান-বিক্রয়-ত্যাগ করা চলে না, তাই পুরুষ দায়াদ, স্ত্রীলোক দায়াদ নহে।‘
বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ (যা ধর্মীয় বিধানের ওপর ভিত্তি করে রচিত) অনুযায়ী একটি মেয়ে পৈতৃক সম্পত্তির যে অংশ পায় তা একটি ছেলের অর্ধেক। একই পিতা-মাতার সন্তানের মধ্যে যদি আইনের এমন বৈষম্য থাকে, তবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ ১/৮ অংশ, সন্তানের সম্পত্তিতে ১/৬ অংশ, পিতার সম্পত্তিতে কন্যা হিসেবে পুত্রের অর্ধেক। যারা বলে মেয়েরা পিতা ও স্বামীর সম্পত্তি দুই-ই পেয়ে গেলে অধিক লাভবান হবে, তারা ভুল বলে। কারণ একটি পরিবারে যদি মা, দুপুত্র ও দু’কন্যা থাকে তবে মা পায় মোট সম্পত্তির ১/৮ অংশ অর্থাৎ ২ আনা (ষোল ভাগের দুভাগ) বাকি ১৪ আনাকে মোট তিন ভাগ করা হয় কারণ দু ভাইয়ের দু ভাগ এবং দু বোন মিলে এক ভাগ। প্রত্যেক ভাই পায় ৪-৬ আনা আর প্রত্যেক বোন পায় ২-৩ আনা, এরপর এক বোন স্বামীর সম্পত্তির ২ আনা পেলেও কোনওভাবেই তার ভাইয়ের সম্পত্তির চেয়ে তা বেশি হয় না।
এদেশে মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ চাওয়া লোকে ভাল চোখে দেখে না। শেষ অব্দি এই দাঁড়ায়—পিতা, স্বামী, পুত্ৰ—কারও সম্পত্তিতেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না।
পিতার ঘরে চলে স্বামীর সংসারে যাবার নিরলস প্রশিক্ষণ এবং স্বামীর সংসারে স্বামীর মুখের একটি কথা তিনবার উচ্চারিত হলেই ঘর ভেঙে যায়—সেই পিতা এবং স্বামীর ঘর কোনওটিই বিশ্বাসযোগ্য নয়, নিশ্চিত বসবাসযোগ্য নয়। জন্মের পর থেকেই এই ভাসমান জীবনে নারী না পায় সুষম উত্তরাধিকার, না পায় বিবাহ-আইনে সামাজিক সমতা।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অবদান যথেষ্ট হলেও পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করবার প্রধান কারণ—সম্পত্তিতে নারীর অধিকারে বৈষম্য। অধিকার সামান্য যা আছে তা সামাজিক সংস্কারের বাধায় অর্জন করাও দুষ্কর। আর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে নারীর এই সামাজিক অবস্থায় নিজ সম্পত্তি গ্রহণ এবং ব্যবহারের সুযোগ নারী কতটুকু পাবে অথবা আদৌ পাবে কি না—এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ হয়।
১৮. পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির আছে ধর্ম এবং আইন
১. সত্যজিৎ রায়ের যত ছবি আমি দেখেছি, পথের পাঁচালীর মত ভাল আর কোনওটিই লাগেনি। যদিও সত্যজিৎ রায় বলেন পথের পাঁচালীতে প্রচুর টেকনিক্যাল ক্রটি রয়ে গেছে, পরবর্তী ছবিগুলোয় সে ক্রটি কাটিয়ে উঠেছেন, আমার তবু ভাল লাগে পথের পাঁচালীই। পথের পাঁচালী আমি বারবার দেখি। ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় ছাড়াও আমার কিছু প্রিয় চলচ্চিত্র-নির্মাতা, যাদের কাজ আমাকে মুগ্ধ করে, উদ্বেলিত করে, আলোড়িত করে—তারা শ্যাম বেনেগাল, রবীন্দ্র ধর্মরাজ, মোজাফফর, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ, গোবিন্দ নিহালিনি, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, ঋত্বিক ঘটক, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গিরিশ কাসরভল্লী, আদুর গোপাল কৃষ্ণন ও গিরিশ কারনাড।
শূদ্রক রচিত সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিক অবলম্বনে গিরিশ কারনাড ‘উৎসব’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে নারীকে প্রেমের বাতাবরণে ছাড়া অন্য ভাবে দেখা হয়নি। সে-ও যে একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি, পারিবারিক ভূমিকার বাইরে সে-ও যে একজন নাগরিক, তারও যে নিজস্ব সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন ও ব্যর্থতা বোধ থাকতে পারে সংস্কৃত-সাহিত্যে এই চেতনাই নেই। কিন্তু শূদ্ৰক (যদিও মৃচ্ছকটিকের রচয়িত শূদ্রক কিনা এ নিয়ে মতভেদ আছে) বসন্তসেনার চরিত্রে অন্য এক মাত্রা এনেছেন, সে শুধু প্রেমিকা নয়, সে প্রভু, নাগরিক, গৃহকত্রী ও সখী। অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যে প্রেমিক ছাড়া অন্য পরিচয়েও নারী দেখা দেয়, যেমন গ্রিক নাটকে। অবশ্য একথাও সত্য যে অন্য যে ভূমিকাতেই নারী অবতীর্ণ হোক না কেন সেটিও পুরুষ পরিকল্পিত পূর্বনিরূপিত একটি ছক, তার সীমার মধ্যেই নারীর সঞ্চরণ। সংস্কৃত সাহিত্যে প্রেমই একমাত্র বাতাবরণ বলে গুপ্তপ্রণয়, দূতী, সংকেতস্থল ও অন্তঃপুরের কুঞ্জ কাননের মধ্যেই তার বিচরণ। কিন্তু ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে নারী সত্তার অন্য কিছু দিক স্বীকৃত, শুধু দেহমাত্রসার নায়িকার যান্ত্রিক ভূমিকাতে ভোগ্যবস্তুরূপে সে দেখা দেয়নি।’