এর মধ্যে মেয়েটি চাকরি নিয়েছে। ভাল চেয়ার, ভাল বেতন কিন্তু স্বস্তি নেই। অফিসের লোকেরা মেয়েটির অতীত নিয়ে চমকপ্রদ সব গল্প তৈরি করে। সে কারও অনিষ্ট করছে না কিন্তু সকলে তাকে নিয়ে মজা করছে, এই মজা একদিন লোকেরা প্রকাশ্যে করে। একা একটি মেয়ে বেশ স্বচ্ছন্দে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করলে সমাজের ভাল মানুষগুলো বেশ আশ্কারা পায়। তারা ছুঁতো খোঁজে কিছু না কিছু অঘটন ঘটিয়ে আনন্দ নেবার। এদেশে নির্মল আনন্দের এত অভাব, মানুষ কেবল আনন্দ খোঁজে, বিকৃত আনন্দ।
শেষ পর্যন্ত মেয়েটি আবার বিয়ে করল বলব না, বিয়ে করতে বাধ্য হল। লোকটির বউবাচ্চা আছে এক অফিসের কেরানি। একটি ঘর ভাড়া করে মেয়েটিকে তুলেছে। সপ্তাহে তিন দিন কাটায় এখানে, বাদবাকি দিন প্রথম সংসারে। লোকটি সকালবেলা গরম ভাত খেয়ে মাথায় সর্ষের তল মেখে অফিসে যায়, বাইরে চা-পান শেষ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে, রাতের খাবারের পর ঘন্টাখানেক ঝাটার কাঠি দিয়ে দাঁতের ফাঁকে ঢুকে থাকা মাছ-মাংস বের করে, তারপর বউ নিয়ে শুতে যায় বিছানায়।
পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে যে মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছে, পরীক্ষায় ভাল ফল দেখে শিক্ষকেরা যে মেয়েটিকে উচ্চ শিক্ষার কথা বলত, সেই মেধাবী মেয়েটি—যে আমার বোধ এবং বিশ্বাসকে সমৃদ্ধ করেছে, সেই মেয়েটির, আমি জানি, এই বিয়ের পর সমাজ তাকে দুয়ো দেয় না, পঁড়শিরা বাকা চোখে তাকায় না, নিন্দুকেরা ফোড়ন কাটে না। যেন একটি আবর্জনা সদর রাস্তা থেকে এখন ডাস্টবিনে গেছে, সকলে তাই শান্ত হয়েছে।
এরপর আমি আর ইচ্ছে করেই মেয়েটির খোঁজ রাখিনি। সেদিন রাস্তায় বড় চেনা চেনা লাগে একটি মেয়েকে দেখে আমি দাঁড়াই। মেয়েটির নির্লিপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আবিষ্কার করি অন্য এক চোখ, এই চোখ চেনে মানুষের ভেতরের সব কদাকার মানুষ। শরীর নিয়ে ওর আড়ষ্টতা দেখে আমি বুঝতে পারি শরীরে সে সন্তান বহন করছে। জিজ্ঞেস করি—চাকরিটা করছিস তো ?
না।
আমি তখন বুঝতে পারি একটি কেরানির ঘরে কর্মকতার ব্যক্তিত্ব বড় বেমানান লাগে বলে গৃহকতার আদেশ এবং সামাজিক কটাক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের চাকরি ছেড়ে দাম্পত্য জীবনকে মেয়েটি মানানসই করেছে।
আমার একবার ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করি তোর যোগ্য কি এই দেশে কেউ ছিল না ? আসলে ছিল, ছিল না কে বলে, তারা এসেছে, চমৎকার সব ভালবাসার কথা বলেছে, কিন্তু কেউ বিয়ের কথা বলেনি। সংসার-ভাঙা একটি মেয়ে নিয়ে সারাদিন আড্ডা দেওয়া যায়, রেস্তোরায় চা-পান করা যায়, সুস্থ সংস্কৃতি নিয়ে বিকেল-সন্ধ্যা পার করা যায়, কিন্তু বিয়ে করা যায় না। বিয়ে করলে যেন কেমন এঁটো এঁটো লাগে, তার চেয়ে শিক্ষা নেই, রুচিফুচির বালাই নেই এমন এক কুমারী কন্যা এনে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে পারলেই লোকে বাহবা দেয়। যোগ্য ছেলে নিয়ে তাই আমি আর প্রশ্ন করি না।
মেয়েটি তার স্ফীত শরীরের লজ্জায় দ্রুত চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। আমার আবারও বড় এক লাগে।
শুরুতে মেয়েটির নাম আমি বলতে চাইনি, কেন বলতে চাইনি তা বলব বলেছি। বলতে চাইনি কারণ মেয়েটির নাম দিলরুবা, শাহানা, দিলারা, সুলতানা, নমিতা, পারভিন, মারিয়া, শ্যামলী, চন্দনা, ফরিদী, শিপ্রা, অর্চনা কী না হতে পারে ?
মেয়েটিকে তাই কোনও নামে ডাকতে ইচ্ছে করেনি কারণ জুলেখা, সুফিয়া, মার্গারেট, আয়শা, হাসিনা, মমতা ও নাসিমা থেকে মেয়েটিকে আমি পৃথক দেখিনি।
» ১৭. সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না
১. বস্তির মেয়ে। বয়স, বয়সের চেয়ে বেশি মনে হয়। কী কারণে আমি জানি না, দ্বিগুণ বয়সের একটি লোক মেয়েটিকে প্রথম হ্যাঁচকা টান দিল। তারপরই দিল ঘাড় ধরে ধাক্কা, মেয়েটি হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘরের বেড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে কোমরে দুটো লাথি । চুলের মুঠি ধরে মেয়েটিকে এরপর ঘরে নিয়ে গেল লোকটি, তার স্বামী।
ঘটনাটি দেখে আমি বিস্মিত হইনি। হইনি, কারণ আমিও, আমি একজন চিকিৎসক, দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, আমিও কি এভাবে অত্যাচারিত হই না? আমারও ঘাড় ধরে ধাক্কা দেওয়া হয়, আমিও উপুড় হয়ে পড়ি দেয়ালে, আমারও কপাল ফেটে রক্ত বেরোয়। সরকারী কাগজপত্রে আমি একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা, তাতে কী, আমি তো মেয়ে।
বস্তির ওই মেয়েটির জন্য এবং একইভাবে আমার জন্যও বিবাহ আইন একই রকম। মেয়েটির স্বামী যেমন ইচ্ছে করলেই বলতে পারে তালাক তালাক তালাক, আমার স্বামীও এর ব্যতিক্রম নয়। আমার স্বামীও এক এক করে এক ঘরে চার বউ তোলার ধর্মীয় আহ্লাদ দেখাতে পারে।
আমি পারি না। বস্তির মেয়েটি যেমন কেবল একবেলা ভাত আর বছরে গা ঢাকার দুটো কাপড়ের জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকে, সন্তানকে কেঁচো-কেন্নোর মত বড় হতে দেয়, আমিই বা এর চেয়ে আলাদা কিসে? আমার আছে সমাজের লজ্জা, আছে মধ্যবিত্ত সংস্কার। আমিও দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকি সংসার নামক কিছু থাল-বাসন আর খাট-আলনার মধ্যে।
বস্তির ওই মেয়েটির ভয়ে নীল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে আমিও বেদনায় নীল হই, আমার কোমরেও এসে পড়ে পুরুষ তৈরি আইনের লাথি। বিত্তবান কোনও মেয়ে এবং বস্তির এই মেয়েটির মধ্যে, শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই।