দর্শনার্থীর মধ্যে ঘরের ঘটনাটির চেয়ে আমার কোথায় থাকা হয়, কোত্থেকে আসা হয়েছে, কি করা হয় ইত্যাদি জানবার আগ্রহই ছিল বেশি। আমার সম্পর্কে যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতে দিতে আমি এই প্রলম্বিত কান্নার কারণ যেটুকু জানতে পারি তা আমার জানবার ইচ্ছাকে মোটেও তৃপ্ত করে না। আমি এই ভেবে ফিরে আসি যে আমি এই ক্রন্দনরতা নারীর সঙ্গে নিভৃতে একদিন কথা বলবই।
পরদিন বলেছি। মেয়েটির বয়স আঠারো বছরের বেশি হবে না। পাশের বাড়িতে বেড়াতে আসা অন্য শহরের একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্তরঙ্গ হওয়া এই বয়সে বড় মানায়। ঘরে তখন মেয়েটি ছাড়া কেউ নেই, স্বামী সরকারি একটি অফিসে চাকরি করেন, প্রায়ই ফিরতে রাত হয়। শহর, বন্দর, বাড়িভাড়া, স্কুল-কলেজ, পড়াশোনা ইত্যাদি ব্যাপারে দীর্ঘক্ষণ কথা বলবার পর আমি গতকালের ঘটনায় ফিরি। মেয়েটি কোনও সঙ্কোচ করেনি, শরীরের নানা স্থানে আঘাতের সকল চিহ্ন একটু একটু করে উন্মুক্ত করে।
আমি ঘটনায় ঢুকতে চাই। আঠারো বছর এবং একটি নতুন মানুষ-এই দুটোর দ্বিধা এবং লজ্জা কাটিয়ে মেয়েটি আমাকে যা বলে তা হচ্ছে মেয়েটি স্কুল পার হয়ে কলেজ কলেজ করছে এমন সময় পরিবার থেকে পছন্দ করে বিয়ে। বিয়ের পর স্বামীটি চব্বিশ ঘণ্টায় পাঁচ-ছ’বার শারীরিক মিলন চায় কিন্তু মেয়েটিকে এই সংখ্যাধিক্য বড় অপ্রতিভ করে। প্রথম প্রথম স্বামীর মনোতুষ্টির জন্য সে শরীর মেলে দিত, দাঁতে ঠোঁট চেপে সহ্য করত বাড়তি অত্যাচার।
এখন মেয়েটির যৌনাঙ্গে যন্ত্রণা এত তীব্র হয় যে সে বাধা না দিয়ে পারে না। আর বাধা দেবার কারণে চলে অশ্লীল অত্যাচার। পুরনো ইলেক্ট্রনিক তার ঘন করে পেঁচিয়ে রাখা আছে, স্বামী নিজ হাতে এগুলো চাবুক হিসেবে ব্যবহার করে মেয়েটিকে তার আদেশ মানতে বাধ্য করে। কখনও কখনও মেয়ে আবার বেঁকে বসে, ফুঁসে উঠে, চিৎকার করে, কাঁদে।
আমি জিজ্ঞেস করি-তোমার কি একেবারেই ইচ্ছে করে না? মেয়েটি লজ্জায় শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচায়, বলে-করবে না কেন? করে। যখন আমার সঙ্গে ও আদর করে কথা বলে, তখন করে।
মেয়েটির চোখে শৈশবের সরলতা উপচে পড়ে।
ধমক দিলে, মারলে আমার ওসব ইচ্ছে করে না।
তোমাকে মারে কেন?
ডাকলে যাই না যে!
তাই মারে?
হ্যাঁ।
মারলে তোমার রাগ হয় না? চলে যেতে ইচ্ছে করে না?
যাব কেন? মারার কথা তো হাদিসে আছে।
এই কথা কে বলেছে তোমাকে?
আমার স্বামী।
তোমার স্বামী সঠিক কথা বলেনি। কোনও হাদিসে স্ত্রীকে মারধোর করবার কথা লেখা নেই।
মেয়েটির বিশ্বাসের দেয়ালে একটি কালো আঁচড় পড়ে। আমার মুখের দিকে অবাক তাকিয়ে থেকে বলে-তবে যে সবাই বলে।
ওরা ভুল বলে, মিথ্যে কথা বলে, রতন।
মেয়েটির মান রতন। আমি শেষ পর্যন্ত রতনকে একরকম বোঝাতে পেরেছি, ওরা মিথ্যে বলে। ওরা বলে কারণ তোমার শিক্ষা নেই, তোমার উপার্জন নেই, তোমার স্বাধীনতা নেই, স্বামী তোমাকে ঠকাচ্ছে, সমাজ তোমাকে ঠকাচ্ছে, দেশ তোমাকে ঠকাচ্ছে। ঘরে বসে ভাত রান্না করে স্বামীর রসনা ও বিছানায় তার শরীর তৃপ্ত করা ছাড়া তোমার মূল্যবান কোনও কাজ নেই। পিটিয়ে তোমার হাড় গুঁড়ো করে ফেললেও, অধিকাংশ লোক, যারা কোনও কুকুর মারতে দেখলেও আহা করে, তারাও, কোনও স্বামী তার স্ত্রীকে মারলে একবার ফিরেও দেখে না।
দিন দুই পর চলে আসবার দিন আমার বড় ইচ্ছে করে রতনের সঙ্গে একবার দেখা করি। সকালবেলা, সেদিন সরকারি ছুটির দিন, দরজায় কড়া নাড়লে রতনের স্বামী এসে সামনে দাঁড়ায়। নিজ পরিচয় বলবার পর তার কপালে দুটো ভাঁজ পড়ে, নাক সামান্য কুঞ্চিত হয়; সে ভেতরে যায়, ভেতর ঘরে দু’জনের কথাবার্তা ক্রমশ নিচু থেকে উপরে উপরে ওঠে এবং উপর থেকে নিচে নামে। আমি অপেক্ষা করি, ভেতর ঘরে বাক্যালাপের একটি মীমাংসা হবার পর আমার সামনে এসে দাঁড়ায় প্রথমে রতন, পেছনে তার স্বামী। আমি রতনের স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখি সেই জি জিহ্বা-যে জিহ্বা স্ত্রীর প্রতি অশ্রাব্য ভাষা উচ্চারণ করে, সেই হাত-যে হাত স্ত্রীর শরীরে নির্মম আঘাত করে। আমি দেখি এবং মনে মনে সেই জিব্বা ও হাতের প্রতি, সেই শরীর ও মনের প্রতি ছুঁড়ে দিই তীব্র ঘৃণা। আমি অবাক হই আমার সামনে যে পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে এ পুরুষটিই এক দুপুরে স্ত্রীকে কাঁদিয়ে পাড়া জাগিয়েছিল। আমি বিস্মিত হই, এই মানুষটিকে সমাজের প্রত্যেকে ভাল মানুষ হিসাবে স্বীকার করতে বাধ্য কারণ অযথা তার চুল বড় নয়, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজায়নি, পরনের কাপড়ে ময়লা নেই, শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ে, লোকের সঙ্গে হেসে কথা বলে।
আমি রতনকে বলি-আজ চলে যাচ্ছি। রতন ম্লান হাসে। তার স্বামী পেছন থেকে সামনে আসে, এদিক ওদিক হাঁটে এবং বলে-আপনি সেদিন রতনকে যা বুঝিয়ে গেছেন তা ঠিক নয়। এইভাবে মানুষকে ভুল শিক্ষা দেবেন না।
কি রকম ভুল শিক্ষা?
এই যেমন হাদিসের কথা অস্বীকার করা।
লোকটি সোফায় বসে এবং আমাকেও বসবার আহ্বান করে বিরক্ত কণ্ঠে বলে-আপনি বোধ হয় হাদিস কোরান পড়েন না।
এরপর সেই লোক দ্রুত উঠে চলে যায়, ফিরে আসে বেশ কিছু, অন্তত পাঁচ ছ’টি স্বাস্থ্যবান বই এবং জিতে যাওয়ার এক প্রকার হাসি নিয়ে, যে হাসি একবার ঠোঁটে ঝুলে গেলে নামতে কঠিন হয়।