প্রোসটেটের পরিবর্ধন এবং প্রতিকার আমার বিষয় নয়। আমার বিষয় প্রোসটেট হঠাৎ রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণে ষাট-সত্তর বয়সের সেইসব বুড়ো পুরুষ, যারা কামোদ্দীপনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠে। অনেকে এই বিয়েকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য নানারকম যুক্তি তৈরি করেন। যেমন বুড়ো বয়সে যত্ন করবার কেও নেই অথবা আমাদের রসুলুল্লাহ নবী, দৃষ্টান্ত দিয়ে গেছেন-ইত্যাদি।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাময়িক যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, তাই তারা কোনও বয়স্ক মহিলা নয়, কিশোরী থেকে যুবতী পর্যন্ত মেয়েদের বিয়ে করবার আগ্রহ প্রকাশ করে। পৃথিবীর যত বুড়ো রোগী এই অবস্থায় বিয়ে করে, সাময়িক কামোত্তেজনা নির্বাপিত হলেই তারা পুরুষত্বহীনতায় ভোগে। তখন সেইসব বালিকা, কিশোরী এবং যুবতীর জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসে তা এমন কেউ নেই যে না জানে।
এমন কে আছে যে জানে না একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে সচ্ছলতার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়, শেষ অবধি সেই মেয়ে জীবনের দায়ভার অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে কেবল দুটো ভাত-কাপড়ের জন্য কি নির্মম ভাবে বেঁচে থাকে!
আমাদের দেশে পীরের প্রকোপ খুব বেশি। পীর একটি ফরাসি শব্দ, যে শব্দটার আবিধানিক অর্থ বৃদ্ধলোক। এদেশে নানা জাতের অসাধু পুরুষ আছে, এদের মধ্যে পীর অন্যতম। একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী কাজ আমার জানা মতে এমন কোনও পীর নেই যে করেনি। দেশের আনাচে কানাচে হঠাৎ গজিয়ে উঠা ‘পীর’ নামে পরিচিত মানুষগুলোর মূল পেশা অসাধুতা, লম্বা চুল-দাড়ি-জোব্বার আড়ালে অর্থ ও নারী লিপ্সাই পীর চরিত্রের প্রধান দিক।
পাবনার পীর খাজাবাবারে নিয়ে বছর কয়েক আগে দেশসুদ্ধ বড়রকম হইচই হয়ে গেল। নারী সংক্রান্ত তার অশ্লীলতার খবর সকলেই জানে। শুনেছি সেই খাজাবাবা নাকি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুরনো পীর ব্যবসায় আবার ফিরে যাচ্ছে। শিমুলিয়ার পীর মতিউর রহমানের বহুবিবাহ এবং লাম্পট্য মুখরোচক আলোচনার বিষয়। শর্ষিনার পীর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। আজকাল অধিকাংশ পীর রাজনীতির খবরদারি করছে, আটরশির পীর স্বাধীন দেশে বসে স্বাধীনতার বিরুদ্ধেই বড় গলায় কথা বলছে। ধর্মভীরু মুরিদদের নজরানা নিয়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল অট্টালিকা ও শিল্প কারখানা গড়া কোনও সৎ মানুষের কাজ নয়। শুনেছি আটরশির পীরের অনুমতি মিললে দেশের মন্ত্রী হওয়া যায়। পীর বলতে এখন আর মুসলমান সিদ্ধ সাধু পুরুষের ভাবমূর্তি মনে ভাসে না-পীর মাত্রই ঝাঁক ঝাঁক যুবতী বেষ্টিত প্রচণ্ড কামুক পুরুষ।
শিমুলিয়ার পীর মতিউর রহমানের চতুর্থ স্ত্রীর বয়স তের। মতিউর রহমানের প্রোসটেট এনলার্জড্ কি না জানি না, অশ্লীলতা করবার জন্য সকল বুড়োর প্রোসটেট এনলার্জড্ হতে হয় না। পুরুষ হিসেবে অবাধ ধর্মীয় এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে গেলে বয়স বিষ পঁচিশ কি সত্তর আশি, কিছু যায় আসে না।
সকলের প্রোসটেট এনলার্জড্ হয় না। প্রোসটেট এনলার্জড্ ছাড়াও লাম্পট্য চলে। লাম্পট্যের জন্য সমাজের সকল পথ খোলা, নারী নিয়ে যথেচ্ছাচার এদেশে নিন্দনীয় নয়; বরং এতে পুরুষের বীরত্বই নাকি অনেকাংশে প্রকাশ পায়।
১২. হাদিসের বাণী : স্ত্রীকে মারপিট কর
ঘটনাটি ঘটে চট্রগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায়। মধ্য জানুয়ারীর দুপুর তখন বিকেলের দিকে সামান্য ঝুঁকেছে। আমি ওই এলাকায় নতুন, কোনও নতুন এলাকায় গেলে আমি শুয়ে বসে দিন কাটাতে পারি না যতক্ষন না ওই নতুন আমার কাছে পুরনো হয়। পুরনো মানে এই নয় যে আমার সকল আগ্রহ উবে গেল। ব্রহ্মপুত্র আমার জন্মের চেনা, এত চেনা যে মনে হয় ব্রহ্মপুত্রের সকল বাঁক আমি চিনি, সকল স্রোত আমি চিনি, তীরের বালুতে আঁকা সকল পদচ্ছাপ আমি চিনি। তবু যে নদী আমাকে এখনও সবচেয়ে বেশি টানে সে ব্রহ্মপুত্রই।
আগ্রাবাদ এলাকাটি তখনও ঘুরে ফিরে দেখা হয়নি। সাদামাটা যা দেখেছি তা ভাঙা রাস্তার দু’পাশে দোতলা, তিনতলা কিছু দালান। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে এমন কোনও বিকেলও নয়, কিছু গা ম্যাজম্যাজ করা সময় থাকে, কোথাও মন বসে না অথচ কিছু একটা করবার জন্য সকলে কিছু একটা খোঁজে, আমিও তেমন খুঁজছিলাম এমন সময় বিকট চিৎকারটি এল। প্রথমে ঠাহর করতে পারিনি জন্তু না মানুষ। কান পেতে থেকে টের পেলাম মানুষ। এবং মানুষ বোঝার আরও মিনিট দশেক পরে বোঝা গেল চিৎকারটি নারীকণ্ঠের কান্না থেকে উদ্ভূত। আমি কণ্ঠস্বরের দিকে এগোলাম।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বলতেই বসবার ঘরটিতে কাঠের সোফা, কার্পেট, টেলিভিশন, দেয়ালে দু’একটি বাঁধানো চিত্রকর্ম অথবা ফটোগ্রাফ, একপাশে বই, কাঁচের বাসন ও পুরষ্কারের সিল মনোগ্রাম সাজানো কাঁচবন্ধ কাঠের তাক। কিছু মুসলমানের আবার নতুন একটি অভ্যেস হয়েছে মখমল কাপড়ে আঁকা কাবাশরিফ বাঁধাইয়ে রাখে ঘরে। যে যত বড় কাবা ঝোলাতে পারে, সমাজে তার কদর তত বেশি। কণ্ঠস্বরটি একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা, অন্তত স্বর অনুসরণ করে আমি যে ঘরে এসে পৌঁছি সে ঘর আমাকে তাই বলে।
দরজা খোলা। তিন-চারজন মানুষ, আমি অনুমান করি তারা ঘরের কেও নয়, আমার মত খোঁজ নিতে এসেছে। চিৎকারের তুলনায় দর্শনার্থীর সংখ্যা আমার কাছে অপ্রতুল মনে হয়। যেন এমনই ঘটে, এমন ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং আমি ছাড়া যারা দেখতে এসেছে তারা প্রায়ই আসে এবং তাদের নির্লিপ্ত মুখ আমাকে বুঝতে সাহায্য করে যে, যে বিষয়টি নিয়ে চিৎকারের সূচনা সেটি কোনও মারাত্মক কিছু নয়।