ইংরেজের এসব উত্তরাধিকার বা তার পটভূমি রচনায় সাক্ষাভাবে এলিজাবেথ বা ভিক্টোরিয়ার কোনো হাত ছিল না, এ সবের গৌরবের ভাগী ন্যায়ত তারা নন। এ সব আরোপিত গৌরব। ইতিহাসের ও জন্ম-মৃত্যুর অমোঘ বিধানে তখন তারা ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন শুধু। বাইরের ঘটনা প্রবাহই সেদিন ইংরেজের জীবনে ও মন-মানসে নিয়ে এসেছিল বিপুল আলোড়ন, উৎফুল্ল এক জীবনবোধ, যার ফলে সে যুগের বুদ্ধিজীবী ইংরেজের সমস্ত সত্তা হয়ে পড়েছিল জীবন-জিজ্ঞাসায় উৎসুক, উন্মুখ, প্রকাশ বেদনায় অধীর, অস্থির। জীবন-জোয়ারের সে এক অপূর্ব জলতরঙ্গ। কাজেই কোনো ব্যক্তি বিশেষ নয়, বাইরের ও ভেতরের ঘটনা প্রবাহই যুগবিশেষকে নতুন চেতনা ও নতুনতর জীবন-জিজ্ঞাসায় সজাগ ও উদ্বুদ্ধ করে তোলে। এ নতুন চেতনারই ফলশ্রুতি সাহিত্য ও শিল্পে নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য।
রাজতন্ত্রের যুগে ওই ছিল কাল-বিভাগের রেওয়াজ আর ওটা করেছেন ঐতিহাসিকরা নিজেদের সুবিধার খাতিরে। না হয় আমাদের সাহিত্যের রবীন্দ্র যুগ এমন কি নজরুল যুগ বললে যা বুঝায়, এলিজাবেথ কি ভিক্টোরিয়া যুগ বললে তা বোঝায় না। ওই রকম কোনো অর্থের দ্যোতনা নেই তাতে। ওদের কাল-বিভাগ অনেকখানি প্রস্তর-যুগ, লৌহ যুগের মতো জড় ব্যাপার। রাজা-রাণীকে ব্যবহার করা হয়েছে মাইলস্টোনের খুঁটির মতো। দক্ষ সওয়ারি যেমন অশিক্ষিত ও অবাধ্য সওয়ারকেও অনায়াসে গন্তব্য স্থানে। নিয়ে যায়, তেমনি মহৎ প্রতিভা আর মহাব্যক্তিতুও বিক্ষিপ্ত ঘটনা প্রবাহকে উচ্চতর তথা সুস্থ ও স্বাভাবিক সাহিত্যলোকে নিয়ে যেতে পারেন–তাঁরা নিজেরা ঘটনার ক্রীড়নক না হয়ে ঘটনাকে করেন নিজেদের ক্রীড়নক। তবে এরা রাজা-রাণী নন। রবীন্দ্রনাথের সুদীর্ঘ জীবন পৃথিবীর বিচিত্র ঘটনা প্রবাহে কীভাবে সাড়া দিয়েছে এবং ওই সব তার হাতে কীভাবে সাহিত্যের উপজীব্য হয়েছে রবীন্দ্র-জীবনী তার এক প্রামাণ্য দলিল।
একের পর এক দুই বিশ্বযুদ্ধ সাহিত্যিক শিল্পীদের সামনে যে অভাবনীয় ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এসেছে তা যেমন ব্যাপক তেমনি দুর্বার। এর ধাক্কা থেকে যুদ্ধে সাক্ষাৎভাবে লিপ্ত বা নির্লিপ্ত কোনো দেশ গা বাঁচাতে পারে নি। এ দুই ধাক্কায় শুধু সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রের উত্থান পতন ও ভাঙা-গড়া ঘটে নি, মানুষের মনে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত, লালিত বহু ধারণা, বিশ্বাস, নীতি ও মূল্যবোধও ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। মুহূর্তে ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি ইত্যাদির মানে গেছে বদলে। মানুষের মন হয়েছে সব রকম আদর্শচ্যুত, উদভ্রান্ত হয়েছে অগণিত যুদ্ধ-ফেরত তরুণ আর সারা দুনিয়ার বিক্ষত-হৃদয় বুদ্ধিজীবীরা, যুদ্ধের নির্মমতা যাদের বুদ্ধি ও অনুভূতিকে করে দিয়েছে ছিন্নভিন্ন তারা চোখের সামনে দেখেছেন নির্মম ও অকারণ ধ্বংসের আর অহেতুক হত্যার এক পৈশাচিক রূপ। মনের ভেতর এক বিরাট শূন্যতা নিয়ে যারা যুদ্ধ থেকে ফিরে এল তাদের অনেকেই দেখল কোথাও মাথা রাখার ঠাঁই নেই–মনের ভেতর যেমন সব কিছু ভগ্ন ধ্বংসস্তূপে পরিণত, বাইরেও তাই। এমন ফাঁকা ফাঁকা ও ত্রিশঙ্কুদশী মানুষের মনে জাগিয়ে তুলেছিল নবমানবতাবোধ, মনুষ্যত্বে আর সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আস্থা, নীতি ও সঙ্কর্মে বিশ্বাস, ধর্ম ও প্রেমে স্বস্তি ও আশ্রয়–যুদ্ধ সে সবই ভেঙে তছনছ করে দিলো–মানুষ হলো সর্বতোভাবে দেউলিয়া। সামনে কোনা আশা-ভরসা নেই, নেই কোনো আশ্রয় ও অবলম্বন। মনের সব প্রদীপ গেছে নিবে। মনের এ অবস্থায় ঈশ্বর, স্বর্গ, প্রেম, ধর্ম সবই হয়ে গেল তুচ্ছ ও তাচ্ছিল্যের ব্যাপার। দ্বিধা, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও সংশয়ে সব মন আলোড়িত ও বিপর্যন্ত। এ পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিতে যে সাহিত্যের জন্ম তা-ই নাম পেলো আধুনিক বা অতি আধুনিক। ইংরেজিতে অভিহিত হলো modernist বলে।
একটা সর্বব্যাপী অসন্তোষ, বিদ্রোহ, চলতি কিছুকে না মানার এক বেপরোয়া ঔদ্ধত্য, ইচ্ছে করে সব রকম সংযম ও শৃঙ্খলাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া, দুর্বল বোহেমিয়ানার সাহায্যে রচনায় নবত্ব আনার প্রয়াস–এ সব মনোভঙ্গিই এই সাহিত্যের পটভূমি। ফলে এমন সব বিষয়বস্তুর আমদানি হলো যা আগে কদাচিৎ সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। বলা বাহুল্য, বিষয়বস্তুর ও লেখকের মনোভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিকের পরিবর্তন অপরিহার্য। কারণ, ভাবের বাহন যেমন ভাষা তেমনি বিষয়বস্তুরও। বিশেষ করে লেখক যেখানে সাহিত্যের প্রেরণায় নয়, ইচ্ছে করে ভিন্নতর হওয়ার সচেতন চেষ্টায় লিখছেন সেখানে আঙ্গিকে বৈপরীত্য অনিবার্য। শিল্পীর তন্ময়তা এখন শুধু উপেক্ষিত নয়, রীতিমতো Tarifto I have come to hold sacred, the disorder of my mind.’ (র্যাবোঁ)। আধুনিক সাহিত্যের এ হলো এক নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার অন্যতম মুখপাত্র অচিন্ত্য সেনগুপ্ত লিখেছেন : ‘আধুনিক মানেই প্রগতিপন্থী। প্রগতি মানে প্রচলিত মতানুগত না হওয়া’। অতএব যা কিছু চলতি হতে হবে তার বিপরীত পন্থী। এ হল আধুনিকতার এক বড় লক্ষণ। এ যুগে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-রথী, প্রধানতম সাহিত্য স্রষ্টা–তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে তিনি একাগ্র সাধনায় বাংলা সাহিত্যকে সাফল্যের এক মহৎ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। তবুও কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়াই করতে হবে তার বিরুদ্ধতা, হতে হবে তার বিপরীত, তার থেকে আলাদা। অর্থাৎ হতে হবে নিবারণ চক্রবর্তী। আর তাদের ধারণা—’রবি ঠাকুরের লেখা যতক্ষণ না লোকে একেবারে ভুলে যাবে ততক্ষণ এর (অর্থাৎ নিবারণ চক্রবর্তীর) ভালো লেখা সত্য করে ফুটে উঠবে না।’ (শেষের কবিতা)। আর নিবারণ চক্রবর্তী তথা নিজেদের কবিতা সম্বন্ধে তাদের ধারণা হচ্ছে—’এ শুধু লিরিক নয়, নিষ্ঠুর জীবনতত্ত্ব।’ (ঐ)। আধুনিক সাহিত্যিক শিল্পীরা যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর কাছ থেকেই এ নিষ্ঠুর জীবনতত্ত্বের পাঠ পেয়েছেন ও গ্রহণ। করেছেন। সাহিত্য সাহিত্যিকের মনের ফসল। কাজেই এ সাহিত্য যারা রচনা করছেন। বা করেছেন তাদের মনের অবস্থা বুঝেই এ সাহিত্যের দিকে তাকাতে হবে এবং সে ভাবে করতে হবে তা বিচার। মূল্যায়নের পুরোনো মাপকাঠি এখানে অচল। তা হলেও সাহিত্যের একটা সর্বজনস্বীকৃত মানদণ্ড আছে বৈকি। শেষ কালে প্রাচীন কি আধুনিক সব সাহিত্যকে সেখানে গিয়েই দাঁড়াতে হবে। বলা বাহুল্য, আধুনিক মানে হালের বা সমসাময়িক নয়। বাংলা সাহিত্যের যারা আধুনিক বা অত্যাধুনিক নামে একদিন অভিহিত হয়েছিলেন, তারা কাল বা বয়সের হিসেবে তা হন নি। মনমেজাজ, সুর-ব্যঞ্জনা ও ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই অর্থাৎ সেদিন যা চলতি ছিল তার পরিপন্থী ছিলেন বলেই বিপক্ষ দলের পরিভাষায় তারা আধুনিক, পরে অতি-আধুনিক নামে বিশেষিত হয়েছিলেন। অবশ্য নিন্দা অর্থেই তারা প্রয়োগ করেছিলেন এ বিশেষণ দুটি।