নিছক গল্প-কাহিনীতেও সমাজ জীবনই প্রতিফলিত হয়। সেই চিনিখোর বালকের গল্পের কথাই স্মরণ করুন। তখন রেশন প্রথা ছিল না। চিনির দামও এক টাকা পাঁচ আনায় গিয়ে ঠেকে নি, সাদা চিনি নিয়ে কালোবাজার যখন কল্পনাই করা যেত না–তখন এক বালকের পিতা ছেলের চিনি খাওয়া কমাতে চান। তখন সাধু সজ্জনের ওপরে লোকের বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। তাই এক সাধু ব্যক্তির কাছে বালককে নিয়ে গিয়ে তার বাবা বললেন, হুজুর, ছেলেটা বউড় চিনি খায়, তাকে একটু কম খেতে উপদেশ দিন। সাধু বললেন, এক সপ্তাহ পরে নিয়ে এসো। এক সপ্তাহ পর ছেলেটিকে নিয়ে তিনি আবার হাজির হলেন সাধুর সন্নিধানে। এবার সাধু ছেলেটিকে উপদেশ দিলেন, বাবা, চিনি কম করে খেয়ো, বেশি চিনি খেলে অসুখ হয়, ক্রিমি বাড়ে ইত্যাদি। কৌতূহলী বাপ জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর এক সপ্তাহ পরে আসতে বলার কারণ? সাধু বললেন, আমি নিজেও খুব চিনি খেতাম, নিজে চিনি খাওয়া না কমিয়ে তোমার ছেলেকে উপদেশ দিই কী করে? এই এক সপ্তাহ ধরে নিজে চিনি কম খাওয়া অভ্যাস করেছি।
এটা প্রাচীন যুগের গল্প। প্রাচীন হলেও এর অন্তর্নিহিত সত্য অর্থাৎ কথা ও কাজে সঙ্গতি রক্ষা চিরকেলে ব্যাপার–এ কখনো পুরনো বা বাসি হতে পারে না। কারণ এর ওপর শুধু ব্যক্তির নয়, সমাজেরও সামঞ্জস্য ও তার সুস্থ বিকাশ নির্ভর করে। কথা ও কাজে যদি সঙ্গতি না থাকে তাহলে সামাজিক জীবন বানচাল হতে দুদিনও লাগবে না। সাহিত্যের ধর্ম হলো জীবনে সঙ্গতি, সামঞ্জস্য সন্ধান ও প্রতিষ্ঠা। সামাজিক জীবনে যেটুকু অসঙ্গতি আছে সাহিত্যিক তাকে সঙ্গতি দিয়ে থাকেন। তাই জীবনের ফটোগ্রাফিক বর্ণনা কখনো সাহিত্য নয়–জীবনকে সাহিত্যের রূপে রূপায়িত অর্থাৎ সঙ্গতিদানই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের লক্ষ্য। যেখানে জীবন একটা সঙ্গতি ও সামঞ্জস্যে পরিণতি লাভ করেছে, যা বাস্তব হয়েও হয়েছে বাস্তবাতীত তাই সাহিত্য। তাকে সন্ধান ও রূপায়ণই সাহিত্যিকের ধর্ম।
এ সাহিত্য রচনা করতে হলে সাহিত্যিকের নিজের জীবনে চাই সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য। জীবনে যদি না থাকে সঙ্গতি, তাতে যদি না থাকে সামঞ্জস্য ও তা যদি হয় পরস্পর বিরোধিতায় খণ্ডিত, পর্যদস্ত, তাহলে সত্যিকার সাহিত্য কী করে রচিত হতে পারে? আজ এই পরস্পর ও আত্মবিরোধিতায় প্রত্যেক সাহিত্যিকের জীবন ক্ষতবিক্ষত। তিনি যা বলেন, সাহিত্য ধর্মের প্রেরণায় যা বলতে চান, তা অনেকখানি আজ সুখ-রক্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথা ও কাজে তিনি নিজেই কোনো সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারছেন না আজ। ফলে সমাজের কাছে শুধু নয়, নিজের কাছেও আজ তিনি এক হাস্যাস্পদ চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। গ্রাম্য জীবনের প্রতি কোনো সাহিত্যিকের হয়তো মোহ আছে। প্রাণের টানও থাকতে পারে—’গ্রামে ফিরে যাও’ একথা তিনি সব সময় লেখেন, বলেনও অথচ নিজে শহর ছাড়েন না। কারণ, শহরের তুলনায় গ্রামে জীবিকার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত। যাদের তিনি উপদেশ দেন তাদের বেলায়ও যে এটা সত্য হতে পারে তা তিনি নির্বিচারে ভুলে যান। আত্ম-বিরোধিতার এও এক শোচনীয় চিত্র। অনেকে কালোবাজারকে কবিতা-গল্পে এলোপাতাড়ি মার লাগান অথচ সুযোগ পেলে নিজেরাও যে তা করেন না তা নয়, অনেকে দু একখানা অতিরিক্ত রেশন কার্ডও হাতে রাখেন সপ্তাহ কুলোয় না বলে। পত্রিকা বের করতে চান কেউ কেউ লাইসেন্সের দিকে নজর রেখে। কেউ কেউ অন্যের জমি বা বাড়ি ঘরও হয়ত বেআইনিভাবে দখল করে থাকেন আর নিজেকে সমর্থন করেন এই বলে—’এ না করলে আজ কাল শহরে থাকা যায় নাকি?’
আজ সাহিত্যধর্ম স্বভাব ধর্মের কাছে এইভাবে পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছে। সাহিত্যিকরা যে উপদেশ দিচ্ছেন, সাহিত্য ধর্মের প্রেরণায়, হয়তো বা অভ্যাসবশতই, যেসব মহৎ কথা বলছেন–মনুষ্যত্নের কথা, সত্যের কথা, ন্যায়ের কথা, সুবিচারের কথা–এ যেন উপদেশের খাতিরেই উপদেশ দেওয়া। অর্থাৎ এর কোন দায়িত্ব তাদের নেই। তারা শুধু উপদেশের মালিক, পালনের দায়িত্ব অন্যের।
অনেক সাহিত্যিক পঞ্চম কণ্ঠে পুঁজিবাদের নিন্দা করেন, পুঁজিপতিদের গালমন্দ না করে ‘বাড়তি ধনে’র মুণ্ডপাত না করে কলমই ধরেন না। অথচ দেখি আবার তারাই পেটের ধান্দায় এই পুঁজিপতিদেরই দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ সখের সাহিত্য সভা করেন তাদের লেখনী-নিন্দিত এসব বাড়তি ধনের মালিকদের সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমে যেখানে মূল্যবান ও পুরু সোফায় বসে বেশ আরামসে তিনি অভুক্ত ও অধভূক্ত ভিখিরিদের জন্য কবিতা ও গল্পে বেশ কিছুটা মায়াকান্না কাঁদেন। আর গৃহস্বামী হয়ত দামি সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বেশ মুরুব্বিয়ানার চালে এই অপূর্ব সাহিত্য-লীলা উপভোগ করেন। সাহিত্যিকের জন্মলব্ধ শালীনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ আজ এভাবে এক করুণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে।
আগের দিনে দেশে এমন বহু আলেমকে দেখেছি যারা তীব্র ভাষায় যেমন সুদ খাওয়াকে নিন্দা করতেন তেমনি শত প্রলোভনেও সুদখোরের বাড়ির ত্রি-সীমানায়ও পা বাড়াতেন না, সুদখোরের বাড়িতে দাওয়াত কবুল তো দুরের কথা। আজ আমরা তাদের থেকেও তীব্র ভাষায় কালোবাজারি, পুঁজিপতি ও বাড়তি ধনের মালিকদের নিন্দা করছি, অথচ আবার বহুনিন্দিতদের প্রসাদ ভিক্ষা করে করেই আমাদের অনেকের সময় কাটছে। প্রাচীনপন্থী আলেম সমাজ যতটুকু মেরুদণ্ডের, আত্মমর্যাদার, কথা ও কাজের সঙ্গতি রক্ষার পরিচয় দিয়েছেন, আজ আমরা তথাকথিত আধুনিক প্রগতিপন্থী সাহিত্যিকরা তার এক শতাংশ পরিচয় দিতেও পারছি না।