ভোট দেওয়ার সময় ইংরেজ ভোট দেয় ‘রক্ষণশীল’কে না হয় ‘শ্রমিক’কে। ওখানে নাগরিকদের রয়েছে বিচার গ্রহণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা।
ইংরেজের কনস্টিটিউশন শুধু ইংরেজের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণাকে গড়ে তোলে নি তার সামাজিক ও ব্যক্তিমানসকেও গড়ে তুলেছে। তাই কোনো চরম পন্থায় সে ধা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। ক্ষমতার অপব্যবহার বা বেপরোয়া ব্যবহারও তাই ওখানে অত্যন্ত সীমিত।
সমাজ বা মনোবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ ক্ষমতা বস্তুটিই এক অদ্ভুত নেশা। লাগাম বা শাসন না থাকলে এ নেশা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তখন কোনো reason-এর ধার ধারে না তা, তোয়াক্কা করে না কোন যুক্তির। অবশ্য ব্যতিক্রম সব কিছুরই আছে। ক্ষমতার মনোভাব হল–আমি যা ভাল মনে করি তাই একমাত্র ভালো–অদ্বিতীয় ভালো, জুনসাধারণ তা মেনে নিতে বাধ্য। এ অবস্থায় যারা নিজের বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে ক্ষমতার ‘ইয়েসম্যান’ হতে পারলেন তারা বেঁচে গেলেন। বেঁচে গেলেন শুধু নয়, তাঁদের এক রকম পোয়াবারো অবস্থা। কিন্তু যে হতভাগ্যরা কথায় কথায় ইয়েস বলতে পারল না তারাই হল রাষ্ট্রদ্রোহী। যে দেশে এ পরিস্থিতি দেখা দেয় সেখানে জাগ্রত-বিবেক শিল্পীরা অত্যন্ত বেকায়দায় পড়ে যান–কোনো না কোনো অজুহাতে তারা হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রের শিকার। এটা কোনো দেশ বিশেষের কথা নয়, প্রায় সব দেশে, সব যুগে এ রকম পরিস্থিতিতে এ রকম পরিণতিই হয়েছে।
ইতিহাসে প্রায়ই দেখা যায়–অবাধ ক্ষমতার অধিকারী নিজেকে মনে করেন সর্বেসর্বা, সিজার পত্নীর মত তিনি সব সন্দেহের অতীত। জনসাধারণের ভাল-মন্দের একমাত্র মানদণ্ড তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা। এরা হয়ত আন্তরিক ও খাঁটি। Aristotle অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গেই বিশ্বাস করতেন—’Slavery is good for slaves’। কিন্তু সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, এ আন্তরিকতার দাম কতটুকু? জনাব হিটলারও মনে। করতেন তিনি যা ভাল মনে করতেন তাই হচ্ছে জার্মানির জন্য একমাত্র ভাল। তার ওপর–‘Herr Hitler does not doubt that his conception of German wellbeing must be-enforced upon his critics in their own interest. (E.M.Forster) ভয়াবহ যুক্তি! আর এ যুক্তির কী ভয়াবহ পরিণতি!
১৩ই মে, ১৯৩৩। জার্মানির বিশ্ববিখ্যাত বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পঁচিশ হাজার বই, বই তো নয়, মানবাত্মার পঁচিশ হাজার প্রস্ফুটিত পুষ্প স্তূপীকৃত। হিটলারের আদেশে ওই স্কুপে করা হল অগ্নিসংযোগ। মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল মানব প্রতিভার এক বিরাট অবদান, বার্লিনের আকাশ লালে লাল–সেই বহ্নিউৎসব দেখতে চল্লিশ হাজার নর-নারী নাকি সমবেত হয়েছিল আর তাদের উল্লাস-ধ্বনি নাকি শোনা গিয়েছিল বহুদূর পর্যন্ত। এ দিন যাদের রচনা উৎসব করে পোড়ানো হয়েছিল তার মধ্যে ফ্রয়েড, এরিখ মারিয়া রেমার্ক প্রভৃতির লেখাও ছিল। এই বিংশ শতাব্দীতে যে বর্বরতার কথা ভাবাই যায় না, ক্ষমতার নেশা মানুষকে দিয়ে সেই বর্বরতাও এভাবে করিয়ে নেয়। হিটলারের জার্মানিতে Heine-এর লেখা নিষিদ্ধ ছিল। জার্মানির তথা সারা ইউরোপের অন্যতম মহাপ্রতিভা গ্যেটের লেখা যদিও বাজেয়াপ্ত করতে হিটলারের মত দুঃসাহসীরও সাহসে কুলায় নি কিন্তু হিটলারের ‘কালো তালিকায় গ্যেটের নামও নাকি ছিল এবং তাঁকে মনে করা হত জার্মান ও জার্মানি ‘কুলটুরের’ দুশমন। জার্মানির এ যুগের সেরা সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিকরা জার্মানি থেকে নির্বাসিত হয়েছেন–মান ও আইনস্টাইন দেশ ছেড়ে গিয়ে ধনে না হলেও প্রাণে বেঁচেছিলেন। এঁদের বিরুদ্ধে একমাত্র অভিযোগ: এঁদের রচনা ‘অ-জার্মান’; অর্থাৎ হিটলারের সুরের সঙ্গে এঁদের সুর মিলছে না, মেলে নি। এঁরা মেলাতে পারেন নি। এঁরা কিছুতেই হন নি হিটলারের ‘ইয়েসম্যান’।
কিন্তু ইতিহাসের কী নির্মম প্রতিশোধ! ইতিহাসের পাতায় একটি কালো দাগ মাত্র রেখে অত বড় দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিটলার আজ নিশ্চিহ্ন। আর যাদের তিনি নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন তারা আবার ফিরে এসেছেন জার্মানির ইতিহাসের পাতায়, জার্মানিকে ছাড়িয়ে এরা চিরজীবী হয়ে আছেন মানুষের মনে মনে।
তবুও এক শ্রেণীর শাসক চিরকালই সাহিত্য-শিল্পকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে এবং তাকে দমন করে কাবু করে রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করে নি। কিন্তু সাহিত্য-শিল্পের ঐতিহ্য এত সুদীর্ঘ ও মানুষের আত্মার সঙ্গে তা এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে তার মূলোৎপাটন করতে হলে গোটা মানব-বংশের মূলোৎপাটন করতে হবে। যা করা কোনো হিটলার বা তার অনুকারকের পক্ষেই সম্ভব নয়।
মানুষ বিকাশধৰ্মী জীব–তার বিকাশের জন্য এ যাবৎ যত উপায়-উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে সাহিত্য-শিল্প শ্রেষ্ঠতম। এই বিকাশ-ধর্ম মানুষের এত সহজাত যে–মানুষকে মানুষ রেখে এর লোপ-সাধন কিছুতেই সম্ভব নয়।
বলা বাহুল্য, পোষা বাঘ যেমন পুরোপুরি বাঘ নয়, তেমনি পোষা শিল্পীও খাঁটি শিল্পী নয়। শিল্পীর জন্য স্বাধীনতা–বিকাশের স্বাধীনতা, প্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য। যেমন অপরিহার্য পুরোপুরি বাঘ হওয়ার জন্য স্বাধীন অরণ্য-জীবন। সার্কাসের রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চেয়ে বনের কেঁদো বাঘ যে অনেক বেশি বাঘ তা বোধ করি সকলেই স্বীকার করবেন।