[‘শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা প্রায় নৈরাজ্যের সম্মুখীন’ প্রবন্ধটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে শুভবুদ্ধি গ্রন্থে।]
শিল্পীর স্বাধীনতা
‘মানুষের নিজস্ব বলতে একমাত্র জিনিস হচ্ছে স্বাধীন চিন্তা’–ডায়োজিনিস (খ্রি. পূ. ৪১২-৩২২)।
‘To differ from the state does not imply an absence of patriotism and that possibility of making such difference effective is the main safeguard we have against servility in society which the State controls… In this way reason has a chance of victory in human affairs. In alternative lies a slavery both intellectual and moral.’
কথাগুলি বলেছেন সমাজ-বিজ্ঞানী হারল্ড লাসকি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো যোগ করেছেন: ‘The power, in short, to call the state to account, is essential to freedom.’
রাষ্ট্রের সুরে সুর না মেলালেই মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহী হয় না, হয় না রাষ্ট্রের দুশমন বা সমাজের শত্রু। যে সব বৃত্তি মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে তার মধ্যে সবার সেরা হচ্ছে reason বা যুক্তি। মানব সভ্যতার সব উপকরণ যে যুক্তিচর্চার ফল তা বোধ করি। দ্বিতীয়বার বলার তোয়াক্কা রাখে না। যুক্তি তথা reason-এর চর্চা অব্যাহত রাখতে, আর সমাজকে নৈতিক ও মানসিক দাসত্বের হাত থেকে বাঁচাতে হলে–স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ও সেই চিন্তাকে প্রকাশ ও গ্রহণ করার অধিকার মানতেই হবে–সমাজকে দিতেই হবে সেটুকু স্বাধিকার। নইলে স্বাধীনতার কোনো মানেই থাকে না।
বাংলা ভাষার প্রায় সব বড় কবি শিল্পী সাহিত্যিকের জন্ম পরাধীনতার যুগে। সে আবহাওয়া ও পরিবেশে তারা রচনা করেছেন তাদের সাহিত্য, যে সাহিত্য তাবত প্রাদেশিক সাহিত্যকে ছাড়িয়ে গেছে এবং নোবল প্রাইজ পর্যন্ত জয় করে আনতে হয়েছে সক্ষম। বিদেশী শাসকদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অধিকারে হস্তক্ষেপ না করলে তারা আমাদের মানস চর্চা নিয়ে কিছুমাত্র মাথা ঘামাত না। সেদিনের পরাধীনতা ছিল মূলত রাজনৈতিক। ইংরেজদের রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে শিল্পী ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। ধর্ম, সমাজ ও প্রচলিত সংস্কার সম্বন্ধে দেশের লেখকরা বেপরোয়াভাবেই কলম চালিয়েছেন সেদিন। যার ফলে বাংলাদেশের সামাজিক উন্নতি এত দ্রুত ও নতুন ধর্মান্দোলন এত সহজ ও সম্ভব হয়েছে। তাই তো মধুসূদনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে জনপ্রিয় দেবতা বা দেবতুল্য রামচন্দ্রের চেয়েও রাক্ষসরাজ রাবণকে বড় করে আঁকা। ধর্মের দিক থেকে এ নিন্দনীয় হতে পারে কিন্তু শিল্পের দিক থেকে এ অনিন্দ্য এবং রসোত্তীর্ণ। রবীন্দ্রনাথ আস্ত দেব মূর্তিকে গোমতীর জলে নিক্ষেপ করে তাকে লক্ষ করে বলেছেন—’গেছে পাপ’ (বিসর্জন)। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ তো সাক্ষাৎ কালাপাহাড়ি কাণ্ড। শিল্পীর জন্য যে টুকু স্বাধীনতা অত্যাবশ্যক–পরাধীনতার যুগে সে টুকু স্বাধীনতা আমাদের ছিল, পুরোপুরিই ছিল। নজরুল যখন কারাগার আর শাসকদের মাথা ভাঙার কথা বলেছেন, তখনি মাত্র তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে, তাও রীতিমত বিচার করে ও নির্দিষ্টকালের জন্য। শরৎচন্দ্র যে বইতে সশস্ত্র বিপ্লবের ছবি এঁকেছেন তার শুধু সে বইটাই সেদিন বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ধর্মের বিরুদ্ধে, সমাজের জনপ্রিয় সংস্কারের বিরুদ্ধে কমলের মুখ দিয়ে, কমল রাজলক্ষ্মীর মুখ দিয়ে কী বেপরোয়াভাবেই না তিনি তার মনের ঝাল ঝেড়েছেন। শাসকরা সেদিকে ফিরেও তাকায় নি। সমাজের বিরুদ্ধে, চলতি সংস্কারের বিরুদ্ধে অর্থাৎ মনের শেকল ভাঙার হেন কথা নেই যা রবীন্দ্রনাথ বলেন নি। অথচ শাসকগোষ্ঠী সেই রবীন্দ্রনাথকে সম্মান করেছেন ‘নাইট’ উপাধি দিয়ে। স্বাধীনতার আগে আমাদের মাত্র দুটি স্থায়ী সাহিত্য মাসিকী ছিল–সওগাত ও মাসিক মোহাম্মদী। আমাদের অনেকের সাহিত্যে হাতেখড়ি হয়েছে এ দুটির পাতায়। এ দুটির সম্পাদক ও পরিচালকরা কখনো বামপন্থী ছিলেন না–বরং শেষোক্তটির পরিচালকদের দক্ষিণপন্থীদের মধ্যেও দক্ষিণতম বলা যায়। তবু এঁরা সে যুগের লেখকদের প্রকাশের স্বাধীনতা পুরোপুরি মেনে চলেছেন ও দিয়েছেন। তাদের এ ভূমিকা ঐতিহাসিক এবং সপ্রশংস মনে স্মরণ রাখার যোগ্য। সেদিন নিছক মতামতের জন্য তারা আমাদের কোনো লেখাই প্রত্যাখ্যান করেন নি।
স্বদেশে ইংরেজ সন্তান যে শাসনতন্ত্রের আওতায় মানুষ সেই শাসনতন্ত্র অত্যন্ত সহিষ্ণ। বিরোধীপক্ষ সেখানে রীতিমত স্বীকৃত ও সম্মানিত–Her majesty’s Government-এর পাশে Her Majesty’s opposition-এর স্থান। এ পরিবেশে মানুষ হওয়ার ফলে ইংরেজ সমালোচনাকে যে শুধু সহ্য করে তা নয়, তাকে জানায় স্বাগত। ইংরেজের এ মনোভাব তার সাহিত্যেও প্রতিফলিত–অন্য অনেক বিষয়ের মত ইংরেজি সাহিত্যের সমালোচনাংশেরও কোনো তুলনা নেই। অথচ সমালোচনা-সাহিত্য অন্য কোনো ভাষায় এখনো গড়ে ওঠে নি। আমার বিশ্বাস, ইংরেজ লেখকেরা যে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে এটি তারই ফল। ইংল্যান্ডের শাসনযন্ত্র কদাচিৎ সাহিত্য-শিল্পের গায়ে হাত তোলে। আমাদের স্মরণকালের মধ্যে যেটুকু হস্তক্ষেপ হয়েছে তা ইংরেজদের টনটনে নীতিবোধকে আঘাত করার ফলেই হয়েছে। তাও সাময়িকভাবে। কমিউনিজম সম্বন্ধে ইংল্যান্ডে ও ইংরেজি ভাষায় যত বই লেখা হয়েছে, রাশিয়ার বাইরে অন্য কোনো ভাষায় অত বই লেখা হয় নি। তবুও ওই নিয়ে ইংরেজের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। পুঁজিবাদী ইংল্যান্ড ওসব বই কেনে আর গোগ্রাসে গেলে। না হয় ওসব বইয়ের এত সংরক্ষণ হয় কী করে? ওয়েব-দম্পতি তো বনিয়াদি ইংরেজ; আর সর্বাগ্রে পশ্চিম মুলুকে তারাই তো কমিউনিস্ট-রাশিয়া সম্বন্ধে প্রামাণ্য বই লিখেছেন। এমন কি বিশ্ববিখ্যাত কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো পর্যন্ত রচিত হয়েছিল ইংরেজ জাতির নাভি-কেন্দ্র লন্ডনে! আবার ইংল্যান্ডে যদিও কমিউনিস্ট পার্টি রীতিমত আইনসঙ্গত কিন্তু তারা ভোট পায় সবচেয়ে কম।