‘পাঠ্য বই সংস্থা’ প্রতিষ্ঠান প্রথম দিন থেকেই চরম অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এ সংস্থাকে ঢেলে নতুন করে সাজানো উচিত। আমার মতে একটা ক্ষুদ্র সংস্থাই যথেষ্ট, এ সংস্থার কাজ হচ্ছে সিলেবাস বা পাঠ্যসূচি রচনা করা। সে পাঠ্যসূচি অনুসারে লিখিত বই আহ্বান করে মান ও মেধা পরীক্ষা করে তার অনুমোদন দান করা। যেমন আগে করা হতো। তাহলে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বই লেখা আর প্রকাশিত হবে। তখন স্বভাবতই বইয়ের মান না বেড়ে পারে না। পাঠ্য বই প্রকাশ করে প্রকাশনা। প্রতিষ্ঠানগুলি যদি সম্প্রসারণের সুযোগ পায় তাহলে তখন কিছুটা পুঁজি অ-পাঠ্য সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশনায়ও তারা বিনিয়োগ করবে। যেমন আগে করা হতো। দেশের পুস্তক ব্যবসাকে নষ্ট করে দেওয়ার আমি সম্পূর্ণ বিরোধী। এতে যে শুধু সাহিত্যের সম্প্রসারণ বিঘ্নিত হবে তা নয়, সার প্রদেশে কয়েক হাজার লোককেও বেকার করে দেওয়া হয়, বাস্তবে হয়েছেও। কোন গণতান্ত্রিক সরকারের এ কিছুতেই নীতি হতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা কমিশনের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। এ কমিশন নিয়ে সরকার কেন যে এ টালবাহানা শুরু করেছেন তা সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে এ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তারপর দীর্ঘকাল ঘুমিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর। মাস দেড় কি দুই আগে হঠাৎ একদিন কাগজে উক্ত কমিশনের তিনজন পদকর্তার নাম প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সকলে আশা করেছিল সঙ্গে সঙ্গে পুরো কমিশনের নাম প্রকাশিত হবে। এ উপলক্ষে কোনো কোনো কাগজে ফলাও করে সম্পাদকীয়ও লেখা হয়েছিল সরকারকে অভিনন্দিত করে। কিন্তু সরকার আবারও চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকলেন। দীর্ঘকাল পর হঠাৎ জেগে উঠে সরকার আর একজন সদস্যের নাম ঘোষণা করে দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন যে, না, সরকার শিক্ষা কমিশনের কথা ভুলে যান নি। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে পুরোপুরি সজাগ আছেন। তবে দুঃখের বিষয়, আজো পুরো কমিশনের সদস্যদের নাম-ধাম, কী নির্দেশ তাদের প্রতি, কখন তাঁরা রিপোর্ট দেবেন, কখন তা সরকার বাস্তবায়িত করবেন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যায় নি। এমন অভূতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ ও গণসমর্থিত সরকারের এ গড়িমসির কারণ কী? সরকারের কোনো বাধা যদি থাকে সরকার তা কি দেশের মানুষকে জানাতে পারেন না? হ্যাঁ, বাধা কিছু আছে বই কি! ছাত্র, সরকারি স্কুল ও বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক, সরকারি ও বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ সবাই কমিশনে স্থান পেতে চান। ছাত্র প্রতিষ্ঠান তো একটি নয়, তার উপর মাদ্রাসা শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি ইত্যাদি বহুতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তো রয়েছে দেশে। সবারই দাবি, তাদেরও প্রতিনিধি শিক্ষা কমিশনে নিতে হবে। শিক্ষা কমিশনে স্থান পাওয়া যেন এক বিরাট কিছু, খুব একটা যেন লাভের বস্তু। শিক্ষা সম্বন্ধে মতামত দেওয়ার যোগ্যতা যেন সবারই আয়ত্ত। এ যদি করা হয়, শিক্ষা কমিশন হবে একটা পিণ্ডোরার বাক্স। মাঝখানে একবার শোনা গিয়েছিল, শিক্ষা কমিশন বাইশজন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এও এক অশ্রুতপূর্ব ব্যাপার। ইতিপূর্বে বাইশজন সদস্য নিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠনের কথা কোনো দেশেই বোধকরি শোনা যায় নি। এ করা হলে এটাও হবে আমাদের আর এক বিশ্ব রেকর্ড। ব্রিটিশ আমলে সারা ভারতের জন্য যে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল, যাকে চেয়ারম্যানের নামানুসারে স্যাডলার বা ব্যাপক অর্থে ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ বলা হতো, তাতে স্মরণ হয়, পাঁচ কি ছজন মাত্র সদস্য ছিল। কমিশন যত বড়ো হবে, বলাবাহুল্য, কাজও তত কম হবে।
ঘ
এই যে দেশব্যাপী নকল করে পাস করার এক মহামারী শুরু হয়েছে তার জন্যও কি সরকার দায়ী নয়? এ ব্যাপারে সরকার কি কিছু মাত্র কঠোরতার পরিচয় দিয়েছেন? নকল ধৰুতে গিয়ে কত শিক্ষক নাজেহাল হয়েছেন, হয়েছেন অপমানিত ও পর্যদস্ত, এমন কি মার পর্যন্ত খেয়েছেন; সরকার কি কখনো এ সব শিক্ষকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, এঁদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা কী করেছেন? বরং ছাত্ররা যখন যা আবদার করেছে সরকার তাই তো মেনে নিয়েছেন বার বার। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে তিন বছর ধরে যে সব ছাত্র নকল করেছে, নকল ধরা পড়ে যথারীতি দণ্ডিত হয়েছে, একদল ছাত্রের আবদারে বা হুমকিতে সরকার কি তাদের সকলের দণ্ড মওকুফ করে দেন নি? সরকারের জানা উচিত, খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা আর আদর্শবাদী সংগ্রামী ছাত্ররা কখনো নকল করে পাস করতে চায় না। ঐ চোরা পথে পাস করতে চায় ভুয়া ছাত্র আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাই। অধিকন্তু কোন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা দেশ-কর্মীই ছাত্রদের নকল করে পাস করার অধিকার দেয় না। শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তত কোন সরকারেরই শিক্ষা সম্পর্কীয় বিধি বিধান আর নীতি-ধর্মকে বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়। এ সবকে বিসর্জন দিয়ে নকলবাজ ছাত্রদের প্রাপ্ত দণ্ড পাইকারিভাবে মওকুফ করে দেওয়ার সাক্ষাৎ পরিণতিই তো আজ আমরা সারা দেশে দেখতে পাচ্ছি। কোনো কোনো কলেজে নকলের অধিকার দাবি করে পোস্টার দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে শ্লোগান, বের করা হয়েছে মিছিল, ফোঁটানো হয়েছে গ্রেনেড। পরীক্ষা তদারকি শিক্ষক-অধ্যাপকরা ভয়ে থরহরি কম্পমান। দেখেশুনেও সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। তদারকি শিক্ষক-অধ্যাপকদের সাহায্যে সরকার ও সরকারি প্রশাসন এতটুকু এগিয়ে আসে নি। এবারকার বিভিন্ন বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফল কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে না নকলের প্রতাপ আর দিগন্ত কতখানি প্রসারিত? এ সম্বন্ধে সরকার একদম খামোস, এ বিষয়ে তাদের যেন করণীয় কিছুই নেই! এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ পাস করা লোকে ভরে যাবে সত্য। ঘরে ঘরে ম্যাট্রিক পাস, আই.এ., বি.এ., এম.এ. পাসও যে দেখা যাবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যিকার শিক্ষিত লোক তখন হয়তো একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না সারা দেশে। দেশকে এ অবস্থায় ঠেলে দেওয়ার জন্য কাকেও যদি দায়ী করতে হয়, আমরা সরকারকেই তো। দায়ী করবো। শিক্ষাক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সাধারণ আইন আর শৃঙ্খলা রক্ষা অপরিহার্য তা রক্ষা আর প্রয়োগের জন্য সরকার এ যাবৎ কোথাও কোন ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শোনা যায় নি। এর নাম দেশ-শাসন নয়। দেশ-শাসনের জন্য প্রয়োজন শাসকের কিছুটা মেরুদণ্ড ও দূরদর্শিতা, কল্পনাশক্তি, দেশের কল্যাণ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা আর তাকে বাস্তবায়নের চারিত্রিক দৃঢ়তা। এ সব গুণ দেখতে পাচ্ছি না বলেই আমাদের দুঃখের পেয়ালা আজ ভরে উঠেছে। দেশ আর দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সত্যিকার স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জনপ্রিয়তা সন্ধান তেমন কিছুমাত্র গৌরবের কথা নয়। শাসনযন্ত্র আজ দুর্বল, ছাত্র-শ্রমিকদের ভয়ে কম্পমান, দেশ তেমন নকল জনপ্রিয় সরকার চায় না, চায় দক্ষ সরকার যার ইংরেজি এফিসিয়েন্ট গভর্নমেন্ট। আমাদের বর্তমান সরকার দক্ষ তথা এফিসিয়েন্ট হোক এ আমাদের আন্তরিক কামনা। তা হওয়ার সব রকম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এ সরকারের–এমন জনপ্রিয় নেতা, এমন সংহত দল, এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা ইতিপূর্বে কোন সরকারেরই ছিল না। তবুও কেন এ নৈরাজ্য, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে?