দেশ আর দেশের মানুষ সরকারের কাছে বিনামূল্যে বই চায় নি, সরকার গায়ে পড়ে এ বদান্যতা না দেখালেও পারতো। বদান্যতা দেখানোর আরো হাজারো উপায় রয়েছে। বহুনিন্দিত পূর্বতন সরকার প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করেছে। বর্তমান সরকার ম্যাট্রিক পর্যন্ত অবৈতনিক কিংবা অর্ধ অবৈতনিক করলেই জনগণের প্রভূত উপকার সাধন করা হতো। অথবা বছরে এক একটা করে বার মাসই অবৈতনিক করা শুরু করলেই পারতো। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে কিছু মাত্র অসুবিধাও ছিল না–প্রশাসনিক একটি মাত্র আদেশই যথেষ্ট। কোনো রকম যন্ত্র কি মেশিনারির প্রয়োজন হতো না এতে। এ ধরনের সহজ ও অনায়াসসাধ্য পথে না গিয়ে কেন যে এক দুরূহ, যা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের কিছুমাত্র ক্ষমতা বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা সরকারের নেই, তা নিতে গেলো তা একমাত্র সরকারই জানে। সরকারের এ ব্যবস্থা শুধু যে এবারই ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, আগামী বছর এ ব্যর্থতা আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে দেখা দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। সরকারের জানা উচিত, জনগণের উপকার করতে চাইলেই উপকার করা যায় না। কিছুটা বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন এবং প্রয়োজন হয় নিজেদের সাধ্য আর ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতনতার। সে সঙ্গে কিছুটা কল্পনাশক্তিরও। তা না হলে হিতে বিপরীত ফল না হয়ে যায় না। পাঠ্য বইয়ের ব্যাপারে অবিকল তাই হয়েছে।
গ
ব্যক্তিগত নির্বুদ্ধিতার পরিণাম ব্যক্তিগতের মধ্যেই সীমিত থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নির্বুদ্ধিতার পরিণাম সর্বব্যাপক। তাই প্রতিবাদ না করে উপায় নেই। পাঠ্য বইয়ের দ্রুত অবনতি কারো নজর এড়াবার কথা নয়। মনোপলি যে শুধু ব্ল্যাকের সৃষ্টি করে তা নয়, মানেরও অবনতি ঘটায়। বইয়ের ক্ষেত্রে সরকারি মনোপলির যন্ত্র হচ্ছে স্কুল পাঠ্য বই সংস্থা তথা স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড। এ বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পাঠ্য বইয়ের মান দ্রুত নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। এ বিষয়ে শিক্ষক আর শিক্ষাবিদমাত্র বোধ করি একমত। কোনো রকম প্রতিযোগিতা নেই বলে বইয়ের মান কমেছে এবং এ কারণে সময়ে বইও পাওয়া যায় না। এবং সে সঙ্গে বুক ট্রেড বা বইয়ের ব্যবসাটাকেও দেওয়া হয়েছে একদম নষ্ট করে। বইয়ের ব্যবসার সঙ্গে সাহিত্যের সম্প্রসারণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বই-ব্যবসার সম্প্রসারণের সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে সাহিত্য সম্প্রসারণের সুযোগও সংকুচিত হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে। সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশনায় খতিয়ান নিলেই তা উপলব্ধি করা যাবে।
মনোপলির আর একটি ক্রটি তাতে তদবির চলে, তার সুযোগ দরাজ। ফলে অযোগ্য লোকও পেয়ে যায় সুযোগ। এ সুযোগের ফলে পাঠ্য বই সংস্থার বই লেখার জন্য এমন সব লোক নির্বাচিত হয় যারা আদৌ লেখক নয়, যাদের লেখাপড়া শুধু যে নিম্নমানের তা নয়, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকেও যেন তারা বঞ্চিত। দুটো মাত্র সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি। কাণ্ডজ্ঞানহীনতার দৌড় যে কতখানি তা পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন (অবশ্য দৃষ্টান্ত দুটোই আমার শোনা, চাক্ষুষ দেখা নয়; তবে যারা বলেছেন, তাঁরা বিশ্বস্ত)।
বাংলাদেশ হওয়ার পর স্বভাবতই কোনো কোনো পাঠ্য বই সংশোধন করতে হচ্ছে। না করে উপায় নেই। বোর্ড বা বোর্ডের নিযুক্ত সংশোধক একটা বইয়ের একটা লেখা সংশোধন করছেন এভাবে : বইটিতে কায়েদে আযম সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ ছিল। বোর্ড তাতে স্লিপ লাগিয়ে ছাত্রদের নির্দেশ দিয়েছে–যেখানে যেখানে কায়েদে আজম লেখা আছে সেখানে সেখানে শেখ মুজিবর রহমান পড়তে হবে। বাদবাকি যা ছিল সবই ঠিক রয়েছে। শেখ মুজিবরের মা-বাপের নাম আর কায়েদে আজমের মা-বাপের নাম এক নয়, জন্মস্থানও আলাদা। একজন জন্মেছে পাকিস্তানের করাচিতে, অন্যজন বাংলাদেশের ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে। লেখা-পড়া, কর্মজীবন, বিয়ে-শাদি সবই আলাদা। এবার থেকে বোর্ডের কল্যাণে ছাত্রছাত্রীদের শেখ মুজিবরের বেনামিতে পড়তে হবে কিনা মোহাম্মদ আলী জিন্নার জীবনকথা! এরই নাম উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। আর এভাবেই আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা পরিচিত হবে জাতির স্রষ্টার জীবনের সঙ্গে! কোনো পুস্তক ব্যবসায়ী প্রকাশক কি এমন কাণ্ড করার সাহস পেতো? যেহেতু বোর্ড সরকারি প্রতিষ্ঠান অতএব বেপরোয়া হতে তার বাধা নেই। আর একটা বই সংশোধন করা হয়েছে নাকি এভাবে। বইতে লেখা ছিল : ‘তিনি প্রত্যহ সকালে উঠিয়া কোরান পাঠ করেন। বোর্ডের সুযোগ্য সংশোধক কথাটাকে সংশোধন করেছেন এভাবে : ‘তিনি প্রত্যহ সকালে উঠিয়া পূর্বদেশ পাঠ করেন।’ কোথায় কোরান শরিফ আর কোথায় ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকা! কোরান পাঠ করেন কথাটি থাকলে কি দোষ হতো? ধর্মনিরপেক্ষতার কি এ অর্থ? শিক্ষা দফতর কি বলেন? কাণ্ডজ্ঞানহীন হীনম্মন্যতারও একটা সীমা থাকা উচিত। কোন হিন্দু যদি গীতা, কোন বৌদ্ধ যদি ত্রিপিটক আর কোন খ্রিস্টান যদি বাইবেল পাঠ করে আর তা যদি পাঠ্য বইতে উল্লিখিত হয় তাহলে কি ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয়? মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী চট্টগ্রাম এসেছিলেন। তাঁর সংবর্ধনা সভার শুরুতে কোরান, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ করা হয়েছিল। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি জনসভায় ধর্মগ্রন্থ পাঠের বিরোধী তবুও এতে কোনো আপত্তির কারণ দেখি নি, অন্য কেউ এতে আপত্তি তুলেছেন বলেও শুনি নি। অথচ এ গণসংবর্ধনার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারি দল।