আর একটি কথা বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করবো। কোনো বিশেষ দল বা কোনো বিশেষ সরকারের প্রতি আমাদের আনুগত্য নয়, আমাদের আনুগত্য দেশের মানুষের প্রতি, দেশের সাহিত্য আর সংস্কৃতির প্রতি। যে দল বা সরকার এ সবের পক্ষে, আমরা লেখকরাও তাদের স্বপক্ষে; যে দল বা সরকার এ সবের বিরোধী, আমরাও তাদের বিরুদ্ধে। তখন আমাদের একমাত্র হাতিয়ার কলমের সাহায্যে আমরা তার প্রতিবাদ করবো। প্রয়োজন। হলে সংগ্রাম করতেও দ্বিধা করবো না। লেখকরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তার মানে জনগণের ভালো-মন্দের সঙ্গে লেখকরাও একাত্ম। জনগণের কল্যাণের সংগ্রাম লেখকদের সংগ্রাম। এ সংগ্রামের পথেই লেখকদের সৃজনশীলতার ঘটে বিকাশ। বিজ্ঞানী J.B.S. Haldan-এর ভাষায় ‘Creative change always arises from struggle, men don’t become good by being kept in cotton wool, but by fighting difficulties and temptations.’ তাই সব কথার শেষ কথা, লেখকের স্বাধীনতা লেখকের হাতেই। সে স্বাধীনতা বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশের এ যুগের লেখকদের একদিকে যেমন জয়। করতে হবে সব ভয় আর বাধাবিঘ্ন তেমনি অন্যদিকে জয় করতে হবে সরকারি-বেসরকারি সবরকম প্রলোভন। এ দুই জয়ের পথেই লেখকের স্বাধীনতা হবে সুনিশ্চিত।
[‘লেখকের স্বাধীনতা’ ঢাকার আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত (২০-২৭ ডিসেম্বর ১৯৭২) সাহিত্য-সভায় প্রদত্ত সভাপতির ভাষণ। প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয় সমকাল পত্রিকার আষাঢ় ১৩৬৮ সংখ্যায়। পরে শুভবুদ্ধি গ্রন্থে সংকলিত হয়।]
শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা প্রায় নৈরাজ্যের সম্মুখীন
এক
কেন? এমন অবস্থা হওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না। আমরা নিজেরাই এ অবস্থার জন্য পরিপূর্ণ দায়ী। আমরা মানে আমাদের সরকার, নেতা-উপনেতা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ছাত্র, অভিভাবক সবাই। সবাই মিলে আমরা সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা নৈরাজ্য ডেকে এনেছি আজ। এ অবস্থার শুরু অনেক আগে থেকেই, এ সংকট চরম অবস্থায় পৌঁছেছিল ১৯৬৮-৬৯ এ। সে সময় শিক্ষা সম্বন্ধে আমি কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেগুলির নাম যথাক্রমে;
(১) ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রসঙ্গে;
(২) শিক্ষা সম্বন্ধে কয়েকটি মোটা কথা;
(৩) সাম্প্রতিক ঘটনার আলোকে শিক্ষা সম্পর্কে দুটি কথা;
(৪) রাষ্ট্র : সমাজ আর ছাত্র;
(৫) শিক্ষকদের প্রতি ভাষণ; ও
(৬) ছাত্র-রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতি।
এ সব কটি লেখা তখনকার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং পরে আমার ‘সমকালীন চিন্তা’ নামক বইতেও পেয়েছে স্থান। সেদিন শিক্ষা বিষয়টি আমাকে কতখানি ভাবিয়ে তুলেছিল এসব লেখায় তার নিঃসন্দিগ্ধ প্রকাশ হয়েছে। আজ দেশ পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন। অবসান হয়েছে পাকিস্তান যুগের। তবু শিক্ষা সম্বন্ধে সেদিন যেসব কথা আমি বলেছিলাম তা আজো আমার কাছে সত্য হয়ে আছে। তাই এখনকার নৈরাজ্য সম্বন্ধে কিছু বলার। আগে আমার ঐসব মন্তব্য থেকে কিছুটা দীর্ঘ পুনরাবৃত্তি করছি, তাহলে শিক্ষা সম্বন্ধে আমার দৃষ্টিভঙ্গির একটা মোটামুটি পরিচয় পাঠকেরা জানতে পারবেন।
ইংরেজ আমলে যে শিক্ষাপদ্ধতি চালু ছিল তা শুধু বহু যোগ্য মানুষ সৃষ্টি করেছে তা নয়, অসংখ্য খাঁটি মুসলমান সৃষ্টিতেও তা কিছুমাত্র বাধা হয় নি। সে মুসলমানরা যে এখানকার শিক্ষিত মুসলমানদের চেয়ে গড়পড়তা অনেক যোগ্য ও ভালো মুসলমান ছিল, সে সম্বন্ধে দ্বিমতের অবসর আছে বলে মনে হয় না। সে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অনেকখানি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, সরল আর সাধারণের বোধগম্য। গত দুই দশকে সে স্পষ্ট আর অর্থপূর্ণ ব্যবস্থাকে নানা কমিশনের নানা উদ্ভট আর অবাস্তব সুপারিশের মারপ্যাঁচে ফেলে এখন স্রেফ ঘোলাটে, দুর্বোধ্য আর ছাত্রদের জন্য এক দুর্বহ বোঝা করে তোলা হয়েছে। ইতিপূর্বে শিক্ষা নিয়ে এমন ‘তোগলকি কাণ্ড’ আর কখনো ঘটে নি। পাকিস্তান পূর্ববর্তী শিক্ষিত মুসলমানের সঙ্গে পাকিস্তান পরবর্তী শিক্ষিত মুসলমানের তুলনা করলে সার্বিক যোগ্যতা আর আচার-আচরণে যে পার্থক্য দেখা যায় তা মনে হয় এ ‘ভোগলকি’ নীতিরই পরিণতি। ‘ফলেন পরিচিয়তে’–সব নীতি আর পদ্ধতি বিচারের এ তো একমাত্র মাপকাঠি।
শিক্ষা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার–-শিক্ষা দান আর শিক্ষা গ্রহণ দুই-ই। এর পেছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি চাই, বিশেষ করে মানবিক প্রস্তুতি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আর অভ্যাসের ফলে শিক্ষকরা নিজেদের কর্তব্য আর দায়িত্ব সম্বন্ধে একটা ধারণা লাভ করেন, ছাত্ররাও নিজেদের কর্তব্য সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট পূর্বধারণা নিয়ে শিক্ষার অঙ্গনে পারে প্রবেশ করতে। আর সবচেয়ে বড় কথা, এ রকম অবস্থায় অভিভাবকদেরও জানা থাকে, তাদের ছেলে মেয়েরা কী কী বিষয়ে পড়ছে, জীবনে তা কতখানি কাজে আসবে, ভবিষ্যতে জীবিকার কথা তাদের সামনে খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা এতে কতটুকু ইত্যাদি। এসবের প্রধান শর্ত শিক্ষাসূচি আর শিক্ষা পদ্ধতিতে স্থিতিশীলতা। স্থিতিশীলতা মানে জড়তা নয়, কালের বা সমাজের প্রয়োজন আর চাহিদাকে অস্বীকার করে স্থাণু হয়ে বসে থাকা নয়। তবে রদবদল আর বিবর্তনের গতি ধীরে ধীরে আর ধাপে ধাপে হওয়া চাই। এক একটা ধাপ জাতির বা সমাজের ব্যবহারিক আর মানসিক অভিজ্ঞতার অঙ্গ হয়ে ওঠার পর, তবেই পরবর্তী ধাপের জন্য যথোপযুক্ত প্রস্তুতি নেওয়া বাঞ্ছনীয়। অভিজ্ঞতা আর অভ্যাসকে আমল না দিয়ে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে এখন যে ওলটপালট ঘটানো হয়েছে ও হচ্ছে, তার পরিণাম ভেবে শিক্ষাবিদ মাত্রই চিন্তিত না হয়ে পারে না।