জাতিকে নৈতিক আর মন-মানসের দাসত্ব থেকে বাঁচাবার দায়িত্ব লেখক আর বুদ্ধিজীবীদের। বাংলাদেশের মহৎ লেখকরা সব সময় এ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল আজো আমাদের সামনে এ বিষয়ে মূর্তিমান আদর্শ। তাঁদের সে আদর্শ আর দায়িত্ব এখন আমরা যারা বেঁচে আছি আর যারা সামনে আসছেন তাঁদের কাঁধের ওপর এসে পড়েছে। লাকি এও বলেছেন: ‘The power, in short, That call the state to account, is essential to freedom.’ কাজেই বহু ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তাকে রক্ষা করে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্যে রাষ্ট্রের প্রতি। জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাতে আমরা বাধ্য। তা না হলে লেখক হিসেবে আমাদের কর্তব্যচ্যুতি, স্বধর্মচ্যুতি ঘটবে। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র পরিচালকরা আর যাকেই ফাঁকি দিতে বা বোকা বানাতে পারে না কেন লেখক বা বুদ্ধিজীবীদের পারে না। লেখকরা একটি তৃতীয় নেত্রের অধিকারী–যে চোখ দিয়ে তারা সব কিছু দেখতে পায়। তাই তাদের ক্ষমতার এত ভয়। এ ভয়ের নগ্ন রূপ আমরা পাকিস্তানি আমলে বেশ ভালো করেই দেখেছি। শাসকরা ভালো করেই জানে স্বাধীনতা আর সংগ্রামের, বিদ্রোহ আর প্রতিরোধের বীজ লেখকদের কলমের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়–সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তাই তাদের সবচেয়ে বড় আক্রোশ লেখকদের ওপর। পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে পাক হানাদার বাহিনী লেখক আর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা বানিয়ে খুঁজে খুঁজে যে হত্যা করেছে তা। মোটেই অকারণ নয়। তারা দেখেছে বাংলাদেশে যত আন্দোলন হয়েছে তার পেছনে ভাবগত প্রেরণা যুগিয়েছে লেখকরাই সব সময়।
কলম কথা বলে না সত্য, কিন্তু কলম সব সময় মুখর। কলমের এ মর্যাদা রাখার দায়িত্ব লেখকদের। চারিদিকে যদি অন্যায় অবিচার মিথ্যা আর অনাচার লেখক দেখতে থাকে, তখন কি তার পক্ষে চোখ বুজে থাকা সম্ভব? প্রতিবাদ তাঁকে জানাতেই হয়, অসত্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতেই হয় তাকে। দুঃখের বিষয়, প্রতিবাদী লেখা তো বটেই এমন কি সাধারণ লেখা প্রকাশের পথে আজো যথেষ্ট বাধা রয়েছে আমাদের সামনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও এখন আর আগের মতো স্বাধীন নয়। সামরিক শাসনের আগে এঁরা অনেক বেশি স্বাধীন ছিলেন। আমাদের কোনো কোনো প্রতিভাবান লেখক সরকারি কর্মে নিযুক্ত, বিশেষত শিক্ষাবিভাগে–সরকারের অনুমতি ছাড়া এদেরও নাকি কোনো রকম লেখা প্রকাশের অধিকার নেই। পরাধীনতা কিংবা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার যুগে লেখকদের সামনে যে বাধা ছিল আজো তা রেখে দেওয়া বা নতুন করে আরোপ করার কোনো মানে হয় না। নিঃসন্দেহে সাহিত্যের অগ্রগতির পথে এ সব প্রবল অন্তরায়। এ সব বিধিনিষেধ এ কারণেও অর্থহীন যে, এ থেকে সরকার বা জনগণ কারো কিছুমাত্র ফায়দা হয় না। অথচ অকারণে এ নিষেধ খড়গের মতো সরকারি চাকরিতে কর্মরত লেখকদের মাথার ওপর ঝুলতে থাকে। নিছক সাহিত্যে পত্রিকা প্রকাশের ডিক্লেয়ারেশন পেতেও নাকি এখন চূড়ান্ত হয়রানি ভোগ করতে হয়। একদিকে সংবাদ পত্রের ওপর কতত্ত্ব, অন্যদিকে এসব বাধানিষেধ, বহু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডিক্লেয়ারেশন নাকি পাওয়া যায় না। ফলে বাংলাদেশের সম্পাদক আর লেখকরা এখন আর কোনো রকম ঝুঁকি নিতেই চান না। অথচ ঝুঁকি না নিলে অন্যায়ের প্রতিকার সম্ভব নয়।
আয়ুবীয় সামরিক শাসনের সূচনায় ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ নামে আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে ই.এম. ফরস্টারের নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। আজকে স্বাধীন বাংলাদেশে আবারও সে কথাগুলি স্মরণ করার প্রয়োজন বোধ করছি। ফরস্টার বলেছিলেন, ‘তিনটি কারণে আমি লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। প্রথম, লেখককে নিজে বোধ করতে হবে তিনি পুরোপুরি স্বাধীন, তা না হলে সৃষ্টির জন্য ভালো কিছু রচনার প্রেরণাই তিনি পাবেন না। তিনি যদি নির্ভয় হতে পারেন, মনে মনে আত্মস্থ হতে পারেন, সহজ হতে পারেন ভেতরে ভেতরে, একমাত্র তখনই তিনি পাবেন। সৃজনশীলতার অনুকূল পরিবেশ। দ্বিতীয়ত, লেখক শুধু নিজে স্বাধীন এ বোধ করলে চলবে না, স্বাধীনতা হলো লেখকদের জন্য প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু সে সঙ্গে আরো কিছু চাই। লেখক যা ভাবছেন অন্যকে তা বলার স্বাধীনতাও তার থাকা চাই। তা না হলে তার অবস্থা হবে বহুমুখ বোতলের মতো। লেখক শূন্যে বিহার করতে পারেন না। শ্রোতা বা পাঠক না হলে তাঁর চলে না। প্রকাশের পথে অন্তরায় থাকলে তিনি একদিন। অনুভব করতেই ভুলে যাবেন। অনেক সময় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তারাও এ সত্যটা বুঝতে পারেন না, বুঝতে চান না। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা ভালো কিছু সৃষ্টির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান। তৃতীয়ত, জনসাধারণের যদি সব রকম লেখা পড়ার স্বাধীনতা না থাকে, লেখকের চিন্তা আর অনুভূতিকে যদি তারা গ্রহণ করতে অক্ষম হন বা বাধা পান তা হলে তাদের নিজের চিন্তাশক্তি এবং অনুভূতিও চাপা পড়ে যাবে। ফলে তারা থেকে যাবেন অপরিণত অর্থাৎ immature’। কাজেই লেখকের স্বাধীনতা যে শুধু লেখকের জন্যই প্রয়োজন তা নয়। জনসাধারণের বুদ্ধি আর মানস বিকাশের জন্যও তা অত্যাবশ্যক।’ সুখের বিষয়, দেশের সংবিধান রচিত আর অনুমোদিত হয়েছে। আশা করা যায়, এ সংবিধানে লেখকদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃতি পেয়েছে। অবশ্য সংবিধানে স্বীকৃতি পাওয়া তেমন বড় কথা নয়, বড় কথা বাস্তবায়নে অর্থাৎ বাস্তবে স্বীকৃতি। এর আগেও জনগণের বিভিন্ন অধিকারের শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতির কথা আমরা বহুবার সরকারি অমাত্যদের মুখে শুনেছি। কিন্তু জীবনে তা কখনো বাস্তবায়িত হয় নি। ফলে জনগণের অবস্থা যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। সে সঙ্গে জনমনে বার বার জেগে উঠেছে অসন্তোষও। রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের চক্রান্তে এবারও যেন তেমন না ঘটে। লেখকদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা যেন স্রেফ কাগজে কলমে নয় বাস্তব জীবনেও লাভ করে স্বীকৃতি। সরকারের মনে রাখা উচিত, সমালোচনা গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য অঙ্গ। গণতন্ত্র আর সমালোচনা হাত ধরাধরি করেই চলে। সমালোচনা থেকেই রাষ্ট্র খুঁজে পায় সঠিক তথ্যের দিশা। সমালোচনা ছাড়া কোনো সরকারই সুস্থ ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে পারে না। হাঁ-হুজুরেরা কোনো রাষ্ট্রেরই নির্ভরযোগ্য শক্তি নয়। লাকি যাকে healthy experience of criticism বলেছেন তা লেখকের জন্য যেমন তেমন রাষ্ট্রের জন্যও স্বাস্থ্যপ্রদ। ওই না হলে রাষ্ট্র কখনো সঠিক পথ, সুস্থতা আর স্বাস্থ্যের পথ খুঁজে পায় না। লেখকদের দায়িত্ব সে পথ দেখানো। লেখক হাঁ-হুজুর হতে গেলে বলেছি স্বধর্মচ্যুতি ঘটে। আমাদের দেশে তেমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। তবু আমি বলবো, এহ্ বাহ্য। খাঁটি লেখক কখনো হা হুজুরের ভূমিকায় নামতে পারে না। রাজনৈতিক মুক্তির চেয়েও মনের মুক্তি, বুদ্ধির মুক্তি অনেক মূল্যবান। ওই ছাড়া স্বাধীনতা কখনো অর্থপূর্ণ হয় না। স্বাধীন চিন্তা ছাড়া শুধু যে আমাদের বুদ্ধি সংকীর্ণ হয়ে থাকবে তা নয়, দেশের মানুষের মনুষ্যত্বেরও ঘটবে না যথাযথ বিকাশ, জ্ঞানের চর্চা হয়ে থাকবে রুদ্ধ, মন হয়ে থাকবে দুর্বল। দুর্বলচিত্ত মানুষের স্বভাব সত্য-মিথ্যা নানা সংস্কারের শেকলে বাঁধা পড়া। তেমন। অবস্থায় ভেতরে-বাইরে অধীনতার সব বন্ধন ছেদন করে সব রকম অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহসটুকুও আমরা হারিয়ে বসবো। তাই লেখার স্বাধীনতা, লেখকের স্বাধীনতা আমাদের যে কোনো মূল্যে অক্ষুণ্ণই রাখতে হবে। সংবাদপত্র আর সাংবাদিকদের পুরোপুরি স্বাধীনতা বাস্তবক্ষেত্রে যেন স্বীকৃতি লাভ করে আর তা যেন হয় নির্বিঘ্ন। সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত লেখকদের কেন যে সরকারি দপ্তর বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে লেখা প্রকাশের অনুমতি নিতে হবে তা আমার বুদ্ধির অগম্য। আমাদের দেশে যে-কোনো নাটকে অভিনয় করতে হলেও নাকি আই.বি. পুলিশের মঞ্জুরি প্রয়োজন হয় আজও। এ সবই লেখকের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এ সব অচিরে বাতিল হওয়া উচিত। আইনের খেলাপ কিছু লেখা বা বলা কিংবা অভিনয় করা হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা প্রচলিত আইনেই তো রয়েছে। যেসব বিধিনিষেধের কথা ওপরে উল্লেখ করলাম তা সাহিত্য-শিল্পের অবাধ বিকাশের পথে অন্তরায় বলেই আমরা সে সবের আশু অবসান কামনা করছি।