এখন আমাদের আর একটি নতুন যুগের শুরু, এখন পা বাড়িয়েছি আমরা নতুন ইতিহাসের দিকে। বলা যায় এখন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন–সব রকম বৈদেশিক ও বিজাতীয় প্রভাবমুক্ত। আমরা যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি, যে রাজনৈতিক দলকে আমরা লেখকরাও সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানিয়েছিলাম, পরিণামে সে রাজনৈতিক দল বিজয়ী হয়েছে, যে সরকার আমরা মনেপ্রাণে কামনা করেছিলাম সে সরকারও আমাদের হয়েছে। তবুও আমরা লেখকরা কি পুরোপুরি নিজেদের স্বাধীন বোধ করতে পারছি? আমাদের মনের কথা কি পারছি মনের মতো করে প্রকাশ করতে? লেখা মানে প্রকাশ করা, প্রকাশ ছাড়া লেখার এক কানাকড়ি মূল্যও নেই। লেখা প্রকাশের সব অন্তরায় কি বাংলাদেশের লেখকদের সামনে থেকে দূর হয়েছে এখন? এ প্রশ্নের ‘হাঁ’ উত্তর দিতে পারলে সব চেয়ে খুশি হতাম আমি নিজে। কারণ আমিও তো কায়মনোবাক্যে এ সরকারকেই চেয়েছিলাম। কথাটা আর একটু খোলাসা করা যাক। আজকের দিনে লেখকদের স্বাধীনতার সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। লেখকের চিন্তা-ভাবনা আর বক্তব্যকে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সর্ব প্রধান বাহন দেশের পত্র-পত্রিকা। স্বাধীনতার পর অবস্থার নানা হেরফেরে জাতীয় পত্রিকার বৃহত্তর অংশের ওপর একভাবে না একভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি কর্তৃত্ব। বড় বড় সব পত্রিকার প্রশাসক, পরিচালক, সম্পাদক ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকার মনোনীতরাই হয়েছে নিযুক্ত। ইতোপূর্বে এমন কাণ্ড কখনো ঘটে নি।
এভাবে বিভিন্ন পদে যারা নিযুক্ত হয়েছেন বা রয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে তারা সবাই হয়তো সজ্জন, যোগ্য এবং দেশপ্রেমিকও কিন্তু যে পদের সঙ্গে নিজের আর পরিবার পরিজনের জীবিকার সম্পর্ক রয়েছে, সে পদ আঁকড়ে থেকে তারা তো কোনো রকম ঝুঁকি নিতে পারেন না, ইচ্ছা থাকলেও পারেন না। তেমন আশা করাও হয়তো অন্যায়। যে দেশে বুদ্ধিজীবীর জীবিকার ক্ষেত্র অত্যন্ত সংকীর্ণ সেখানে অবস্থা এ না হয়ে যায় না। জীবিকা হারাবার ভয়ে সব সময় তাদের থাকতে হয় সন্ত্রস্ত। ফলে সরকারের মুখের দিকে চেয়েই তাদের লিখতে হয় এবং লেখা ছাপতে হয়। সরকার তো একজন নন–প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়েই তো কোনো সরকার নয়। এঁরা ছাড়া সরকারের বহু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে–যেমন, মন্ত্রীমণ্ডলী, মন্ত্রণালয়ের সচিব, গণপরিষদ সদস্য, যে পার্টি ক্ষমতায় রয়েছে তার বিভিন্ন স্তরের নেতা-উপনেতারা রয়েছেন, সে সঙ্গে সংগঠন কর্তারাও আছেন–কোন লেখায় এদের কার কখন বিরাগভাজন হতে হয়, সাংবাদিকদের এখন অহরহ সে ভেবেই থাকতে হয় তটস্থ। লেখা প্রকাশের বেলায় তাদের সামনে সে বিবেচনাটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। লেখার গুণাগুণ নয়, লেখকের বক্তব্য সরকারি মহলে কী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সুর্ভাবনাই হয়ে দাঁড়ায় এখন তাদের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। ফলে ভয়ের চোটে বহু নিরীহ লেখাও তারা ছাপতে পারেন না, ছাপেন না। আমি ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা নিয়েই একথা বলছি।
চিন্তার স্বাধীনতা মানে লেখকের স্বাধীনতা। লেখকের স্বাধীনতা মানে প্রকাশের স্বাধীনতা। হিটলারও চিন্তার স্বাধীনতা রোধ করতে চেয়েছিলেন, পারেন নি, সাময়িকভাবে প্রকাশের স্বাধীনতা রোধ করেছিলেন বটে। কিন্তু জার্মানির সে দুঃস্বপ্নের কাল কেটে যেতে খুব বেশি দেরি লাগে নি। ইতিহাসকে ভুলে থাকা হলেও ইতিহাস কাকেও ভোলে না। সব দেশের ক্ষমতাসীনদের উচিত ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করা। হিটলারের পরিণতির সঙ্গে আয়ুব-ইয়াহিয়া-মমানেমের পরিণতির কি কিছুমাত্র সাদৃশ্য নেই? লেখা আর লেখকের একটি বড় ধর্ম পাঠককে সচেতন করে তোলা, পাঠক-মনে সর্ব বিষয়ে জিজ্ঞাসা সঞ্চারিত করা। এ সচেতনতা আর জিজ্ঞাসাকে যে সমাজ বা রাষ্ট্র ভয় করে, সে সমাজ বা রাষ্ট্র নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনে। লেখকের স্বাধীনতা হরণ করা মানে একটা জাতিকে অপরিণত-বুদ্ধি তথা না-বালেগ করে রেখে দেওয়া। নির্বিচারে শাসন-ক্ষমতা চালানোর জন্য এটি একটি মোক্ষম উপায় মনে করা হয় বটে কিন্তু সমৃদ্ধ, উন্নত আর শক্তিশালী জাতি গঠনের পথ এটি নয়। অপরিণত-বুদ্ধি নাবালেগ মানুষকে দিয়ে একটা দাস জাতি গড়া যায় সত্য কিন্তু মহৎ জাতি গড়া যায় না। অবাধ আলো হাওয়া না পেলে গাছ যেমন বড় আর শক্ত হয় না তেমনি মানুষ আর দেশও বিশ্বজ্ঞান আর মুক্ত চিন্তার স্পর্শ না পেলে বড় আর শক্তিশালী হয়ে গড়ে ওঠে না। মানুষ মনোজীবী প্রাণী বলে তার বেলায় এটা আরো বেশি করে সত্য।
রাষ্ট্র সব সময় আনুগত্যের ওপর জোর দিয়ে থাকে। ভালো কথা। কিন্তু তার আগে রাষ্ট্রকে আনুগত্যের কি অধিকারী হতে হয় না? যথার্থ অধিকারী হলে, আনুগত্য স্বতঃস্ফূর্ত না হয়ে পারে না। নিঃসন্দেহে আমি আমার দেশ, রাষ্ট্র আর সরকারের প্রতি অনুগত কিন্তু তাই বলে আমি অন্ধ আনুগত্যের পক্ষপাতী নই। আমার আনুগত্য চক্ষুষ্মনের আনুগত্য। আমি আমার রাষ্ট্রের প্রতি তাকাতে চাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। আমি অনুগত নাগরিক বলেই এ জিজ্ঞাসা আমার জন্য অপরিহার্য। যে সরকার বা রাষ্ট্রের আমি অনুগত নাগরিক, সে সরকার বা রাষ্ট্র আমার আনুগত্যের অধিকারী কি না, আমার আনুগত্যের যথার্থ হকদার কি না তা জানার অধিকার আমার রয়েছে। আমার মানে সমস্ত নাগরিকের। নাগরিকদের এটি একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। আমরা লেখকরা একই সঙ্গে সরকারের সমর্থক আবার সরকারবিরোধীও। সরকার যখন জনগণের কল্যাণের পথের অনুসারী তখন আমরা সরকারের পক্ষে, সরকার যখন জনস্বার্থের বিরোধী তখন আমরাও সরকারবিরোধী। সরকারবিরোধী হওয়া মানে দেশের বিরোধী বা দেশের শত্রু হওয়া নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারল্ড লাকি বলেছেন : ‘To differ from the state does not imply an absence of patriotism and that possibility of making such difference effective is the main safeguard we have against servility in society which the state controls …. in this way Reason has a chance of victory in human affairs. In alternative lies a slavery both intellectual and moral.