কাজেই লেখকের স্বাধীনতা যে শুধু লেখকের জন্যই প্রয়োজন তা নয়। দেশের জনসাধারণের জন্যও তা অত্যাবশ্যক।
ফরস্টারের মন্তব্যের আলোকে আমার প্রাথমিক বক্তব্যের দিকে আর একবার ফিরে তাকানো যেতে পারে। ইংরেজ শাসনকালে আমাদের লেখকেরা অনুভূতির ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিঃশঙ্ক ছিলেন। তাই মধুসূদনের পক্ষে রামকে ছেড়ে রাবণে রঙ চড়ানো, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে হিন্দুর চিরপ্রিয় সংস্কারকে গোমতীর জলে নিক্ষেপ করা বা নজরুলের পক্ষে ‘খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া’ মাথা তোলা সম্ভব হয়েছিল। বল বীর আমি চির উন্নত শির’–মানব মহিমার এমন অবিস্মরণীয় উক্তি সত্যিই দুর্লভ। এ উক্তিটির জন্যও নজরুল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সমস্ত সাহিত্য শিল্পেরই মর্মকথা এটি। ‘বিদ্রোহী’ মানব অনুভূতি ও অনুভূতির অবাধ প্রকাশেরও এক স্মরণীয় নিদর্শন।
গোর্কি তাঁর The Artamonows (‘ক্ষয়’ নাম দিয়ে যার বাংলা অনুবাদ হয়েছে) উপন্যাসে এক চরিত্রের মুখ দিয়ে যে বলেছেন : ‘কারবারটা আমাদের সকলের কিন্তু জীবনটা যার যার নিজের’–এটাই হচ্ছে সমাজ ও জীবন সম্বন্ধে শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে official point of view-র রোলার চালাতে গেলেই শিল্প স্বধর্ম হারাতে বাধ্য। শিল্প ও শিল্পী স্বধর্ম হারালে সমাজও স্বধর্ম তথা মানবধর্ম না হারিয়ে পারে না। সাহিত্যের প্রাণবায়ু ও তার বিচিত্র অনুভূতি থেকে যে সমাজ বঞ্চিত, সে সমাজ অপরিণত মানুষের সমাজ তথা ‘ছোটলোকের সমাজ। সে সমাজের চাওয়া-পাওয়া, বাসনা-কামনাও হবে তেমনি ক্ষুদ্র ও সামান্য। সে সমাজের পক্ষে বড় কিছু করা, মহৎ কিছু গড়া এমন কি বৃহৎ কিছু আকাক্ষা করাও সম্ভব নয়। এ সমাজ সম্বন্ধেই কি বোরিস পাস্তেরনাকের মন্তব্য : ‘… a society whose demands are very slight; there is only one thing they really want : you should hate what you like, and love what you abhor!’ Dr. Zhivago.
মনের ওপর, আত্মার ওপর কী প্রচণ্ড জুলুম!
এ অসহ্য কূপমণ্ডুকতার হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে শিল্পীকে অভিব্যক্তির স্বাধীনতা দিতে হবে–মেনে নিতে হবে সাহিত্য-শিল্পের এ প্রাথমিক শর্তটুকু।
[‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ ১৯৫৯ সালে উত্তরণ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথম গ্রন্থাকারে সংকলিত হয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা গ্রন্থে।]