দুর্দান্ত শাসকেরা চিরকালই শিল্পীর স্বাধীনতাকে হরণ করতে ও দমন করতে চেয়েছে। আজও বহু দেশে তার দৃষ্টান্তের অভাব নেই। কিন্তু এসব দুশ্চেষ্টা বার বারই ব্যর্থ হয়েছে, সামনেও হবে। এক চক্ষু হরিণের মত ক্ষমতার নেশায় পাওয়া শাসকরা কিন্তু তা দেখতে পান না বা দেখেও না দেখার ভান করেন।
বোরিস পাস্তেরনাককে নিয়ে যে কাণ্ডটা ঘটে গেল তা শাসকদের এ অদূরদর্শিতার আর এক নিদর্শন। তবে হিটলার তার দেশের সাহিত্যিক-শিল্পীদের প্রতি যে বর্বর ব্যবহার করেছেন সে তুলনায় পাস্তেরনাকের ভাগ্য অনেক ভালই বলতে হবে। তাকে শুধু নোবেল প্রাইজ নিতেই দেওয়া হয় নি, তা ছাড়া সরকারি বাড়ি, গাড়ি ও ভাতা থেকে তিনি নাকি বঞ্চিত হন নি। তবে জিজ্ঞাসা, এই ব্যবহারিক সুবিধাই কি শিল্পীর জন্য সবটুকু? ওইটুকু আরাম-আয়েস নিয়ে কি শিল্পী সন্তুষ্ট থাকতে পারেন? না পারেন ইচ্ছামতো রচনায় আত্মনিয়োগ করতে! শিল্পীর জন্য মনের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, প্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য। বোরিস পাস্তেরনাকের সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ঘটেছে এটিই আপত্তিকর, এর বিরুদ্ধেই আমাদের প্রতিবাদ। এর ফলেই কি পাস্তেরনাক আজ অনুবাদ কার্যে আত্মনিয়োগ করেছেন? রাষ্ট্রের প্রতিকূল নীতির ফলে প্রতিভাবান শিল্পীরা যদি সৃষ্টির পথ থেকে দূরে সরে থাকেন তাহলে ক্ষতিটা কার? সমগ্র দেশের ও সাহিত্যের ক্ষতি নয় কি? উপন্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়া ছিল একদিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী–আজ কি তা আর বলা যায়?
অবশ্য পশ্চিমি দেশগুলিতে পাস্তেরনাককে নিয়ে যে যথেষ্ট বাড়াবাড়ি ঘটে নি তা নয় : In a letter to the New York Herald Tribune published today (Nov. 15, 1958) Aleksis Rannit, President of the Estonian Literary Society and Vice President of the International PEN Club centre for writers in exile, decried the ‘indelicate way in which the Nobel Prize was announced.’ He said there was really no need to mention ‘Dr. Zhivago,’ it is the author’s intensely symbolized and very originally insrumented poetry, anyway, which makes Pasternak truly great. He also decried the sending of congratulatory telegrams and appeals and the ‘unwarranted’ invitations of American communities asking Pasternak to settle down in the United States. These people, he wrote, were not thinking one single second that this is an invitation to join the deadly enemy of the Soviet Union.’ (UPI) কাজেই শিল্পগত কারণে নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে এ হৈ হুল্লোড় আর পাস্তেরনাককে ব্যবহার করা হয়েছে হাতিয়ার হিসাবে। এটাও নিন্দনীয়।
আশ্চর্য, রাশিয়ায় যখন চরম স্বৈরতন্ত্র–সেন্সরের কঠোরতা যখন অসীম, তখন জার প্রথম নিকোলাস যে রসবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন, হিটলার যেমন সে রসবোধের পরিচয় দিতে পারেন নি, তেমনি পারেন নি নিকোলাসের আধুনিক উত্তরাধিকারীরাও। গোগোলের বিখ্যাত নাটক Rerizor (The Govt. Inspector) জার নিকোলাসের আমলাতন্ত্রকে বিদ্রূপ করেই লেখা। অথচ বইটি যখন তাকে পড়ে শোনানো হয় তখন বইটির শিল্পগত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি তখনি সেন্সরের হুকুম বাতিল করে দিয়ে বইটির অভিনয়ের আদেশ দিয়েছিলেন এবং এর পর থেকে তিনি দরিদ্র গোগোলকে মাঝে মাঝে গোপনে অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। আর পাঠাবার সময় বলে দিতেন, ‘Don’t let him know the source of these gifts; for then he might feel obliged to write from the official point of view.’ হিটলারের official point of view-এর সঙ্গে মেলে নি বলে পঁচিশ হাজার বই আগুনের খোরাক হয়েছে। রাশিয়ায় বর্তমান official point of view এর সঙ্গে মেলে নি বলে Dr Ztivago রাশিয়ায় নিষিদ্ধ আর তার লেখকের ভাগ্যে এ দুর্ভোগ। ব্যক্তি স্বাধীনতা যেখানে অস্বীকৃত সেখানে সাহিত্যিক শিল্পীদের দুর্ভোগ অনিবার্য। যারা official point of view-এর সঙ্গে তাল রেখে মিলিয়ে মিলিয়ে লিখতে পারবেন অর্থাৎ যারা শাসকদের সুরে সুর মেলাতে পারবেন তাদের। কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। কিন্তু যারা তা পারেন না তাদেরই নাজেহাল অবস্থা।
লেখকের জন্য কেন স্বাধীনতা অত্যাবশ্যক সে কথা বলতে গিয়ে ই, এম, ফরস্টার বলেছেন, ‘তিনটি কারণে আমি লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। প্রথমত, লেখককে নিজে বোধ করতে হবে তিনি পুরোপুরি স্বাধীন, তা না হলে সৃষ্টির জন্য ভাল কিছু রচনার প্রেরণাই তিনি পাবেন না। তিনি যদি নির্ভয় হতে পারেন, মনে মনে আত্মস্থ হতে পারেন, সহজ হতে পারেন ভেতরে ভেতরে, একমাত্র তখনই তার জন্য সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ রচিত হবে। দ্বিতীয়ত, লেখক শুধু নিজে স্বাধীন এ বোধ করলে চলবে না। স্বাধীনতা হলো লেখকের জন্য প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু লেখক ও শিল্পীর আরো কিছু চাই। অর্থাৎ লেখক যা বোধ করছেন তা অন্যকে বলার স্বাধীনতাও তাঁর থাকা চাই। তা না হলে তাঁর অবস্থা হবে বদ্ধমুখ বোতলের মতো। লেখক শূন্যে বিহার করতে পারেন না–শ্রোতা বা পাঠক না হলে তার চলে না। তাঁর প্রকাশের পথে অন্তরায় ঘটতে পারে এ আশঙ্কা থাকলে তিনি একদিন অনুভব করতেই ভুলে যাবেন। অনেক সময় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজ কর্মচারীরাও এই সত্যটা বুঝতে পারেন না, ফলে তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাল রচনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান। তৃতীয়ত, যদি পড়ার স্বাধীনতা জনসাধারণের না থাকে, লেখকের অনুভূতি যদি তারা গ্রহণ করতে অক্ষম হন তাহলে তাঁদের নিজের অনুভূতি বা অনুভব করবার শক্তিও চাপা পড়ে যাবে এবং তারা থেকে যাবেন অপরিণত–চির immature.’