শুভবুদ্ধি
লেখকের স্বাধীনতা
লেখকের স্বাধীনতা কথাটা এক হিসেবে স্ববিরোধী এবং আমাদের কাছে আজো কিছুটা বিপজ্জনক। স্ববিরোধী এ কারণে যে, আসলে লেখে তো মন, আর মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ারই তো এক নাম চিন্তা, যা সব লেখার উৎস। সে চিন্তা অত্যন্ত ব্যক্তিক এবং সর্বতোভাবে নিজস্ব। তার ওপর কোনো রকম কর্তৃত্ব অচল। এ এক অতি প্রাচীন আর স্বীকৃত সত্য। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে একজন গ্রিক জ্ঞানী এ সত্যের প্রতি স্বীকৃতি জানিয়ে গেছেন এভাবে: ‘মানুষের নিজস্ব বলতে একমাত্র জিনিস হচ্ছে মনের স্বাধীন চিন্তা। কাজেই আমি মানুষ থাকবো আর স্বাধীন চিন্তাও বিসর্জন দেব এক সঙ্গে তা হয় না। যেমন হয় না সাঁতারও কাটবো অথচ গা ভেজাবো না। এ স্বাধীন চিন্তার সঙ্গে জীবনের বিকাশ আর মনুষ্যত্বের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। কাজেই যে লেখকের মনুষ্যত্বে বিশ্বাস রয়েছে সে কিছুতেই, কোনো অবস্থাতেই চিন্তার স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে পারে না। দেওয়া মানে লেখক হিসেবে আত্মহত্যা করা।
বিপজ্জনক বলেছি এ কারণে যে, আমরা লেখকরাও কোনো না কোনো দেশের অধিবাসী, কোনো না কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্রশক্তির একটি সাধারণ দুর্বলতা সন্দেহ প্রবণতা, বিশেষ করে মননশীল মানুষকে, সাধারণ অর্থে যাদের বুদ্ধিজীবী বলা হয় তাদের সন্দেহের চোখে দেখা ক্ষমতার একটি স্বভাব। অর্থাৎ যারা লিখে থাকে, নিজের চিন্তাভাবনাকে যারা প্রকাশ করে ভাষায় তাদের প্রতি কিছুটা অবিশ্বাসের চোখে তাকানো। ক্ষমতার যেন এ এক সহজাত প্রবণতা। ক্ষমতার আর একটি দুর্বলতা সুযোগ পেলেই সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া। দেখা গেছে, অতি বড় সজ্জনও যখন ক্ষমতার আসনে বসেন তখন মুহূর্তে তিনি হারিয়ে ফেলেন সব রকম পরিমিতিবোধ, তখন সীমা লঙ্ঘন হয়ে দাঁড়ায় তার স্বভাব। এ কারণে জ্ঞানীরা সব সময় ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন এবং কেউ কেউ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করেছেন। এও দেখা যায়, ক্ষমতা সব সময় ছাপার অক্ষরকেও যেন কিছুটা ভয় করে থাকে। ক্ষমতার এ মনোভাব প্রায়শ সরাসরিভাবে লেখকদের আঘাত হেনে বসে। নীরব কবির মতো নীরব লেখক কথাটাও অর্থহীন–যে নিজের চিন্তাভাবনাকে ভাষায় রূপ দেয় না, আর তা প্রকাশ করে না সে আর যাই হোক লেখক নয়। বোবার যেমন শত্রু নেই, তেমনি এমন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরও নেই কোনো শত্রু। রাষ্ট্র এদের মনে করে অত্যন্ত ভালো মানুষ, অতি বংশব্দ সৎ নাগরিক। এদের নিয়ে রাষ্ট্র নিশ্চিন্ত। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারীরা চান সারা দেশটা সমতার মরুভূমিতে পরিণত হোক তাদের কাম্য E.M. Forster-এর ভাষায় Desert of uniformity; সবুজের বৈচিত্র্য বা ‘শতপুষ্পে’ তাঁরা আতঙ্কিত।
ক্ষমতা যদি অপরিণত বুদ্ধি, অপরিপক্ষ মানুষ আর অদূরদর্শীদের হাতে পড়ে তখন মননশীল লেখকদের অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় অধিকতর বিপজ্জনক। এসব ক্ষমতাসীনদের সভ্যতা আর সংস্কৃতি সম্বন্ধে থাকে না কিছুমাত্র স্বচ্ছ ধারণা। সভ্য সমাজজীবন গড়ে তুলতে কী কী বুনিয়াদি উপাদান অত্যাবশ্যক তা জানার আগ্রহ থেকেও এরা বঞ্চিত। ফলে মননশীলতার সব দরজা-জানালা খুলে দিয়ে তাতে দক্ষিণা বায়ু প্রবেশের পথ করে দেওয়ার বদলে এরা বরং উল্টো দরজা জানালায় আগে যেটুকু ফাঁক ছিল তাও ঠেসে বন্ধ করে অর্গল লাগিয়ে দেয়। মননশীল লেখকদের জন্য এ এক শ্বাসরুদ্ধ দশা। বর্তমানে আমাদের দেশের লেখকরা কেমন অবস্থায় বাস করছেন? আমাদের পদক্ষেপ এখন কোন্দিকে? আমরা কি এখন নিজেদের সম্পূর্ণ স্বাধীন বোধ করতে পারছি?
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে কী দেখতে পাই? আমার বিশ্বাস, লেখকদের পক্ষে এখন এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার সময় এসেছে। দীর্ঘকাল আমরা ইংরেজের অধীন ছিলাম। সে অধীনতার অবসান ঘটেছে ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট। কিন্তু ইংরেজ আমলের যে অধীনতা বা বন্দিত্ব তা ছিল অনেকখানি বাহ্যিক বা দৈহিক–সে বন্দিত্ব আমাদের মন-মানসের ওপর তেমন কোনো প্রবল চাপ সৃষ্টি করে নি, রাজনীতির বাইরে তার শাসন ছিল অত্যন্ত শিথিল। ফলে বাংলা সাহিত্যে সব খ্যাতনামা লেখক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কারক আর হিন্দুসমাজে সীমিতভাবে হলেও যারা রেনেসাঁস এনেছিলেন। তাদের সবারই আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে সে যুগে। এমন কি আমাদের বিদ্রোহী কবিরও আবির্ভাব তখন। আর লেখকরা অনায়াসে বেপরোয়া হতে পারতেন। শরৎচন্দ্র এবং আরো অনেকে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বেপরোয়া হওয়া মানে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন বোধ করা।
পাকিস্তান আমলে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এলো বটে কিন্তু তারপর থেকে শুরু হলো অন্যরকম বন্দিত্ব। এ বন্দিত্ব শুধু দৈহিক ছিল না, ছিল অনেকখানি মানসিকও। এ শেষোক্ত বন্দিতুই আমাদের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবচেয়ে মারাত্মক। মানুষের চিন্তা ভাবনার একমাত্র বাহন আর প্রকাশ-মাধ্যম তার মাতৃভাষা, আমাদের সে মাতৃভাষার ওপরই তখন যে শুধু হামলা শুরু হলো তা নয়, নানা রকম বিধিনিষেধের দড়াদড়ি দিয়ে আমাদের সামনে বিষয়বস্তুকেও করে দেওয়া হলো সংকীর্ণ–আমাদের কল্পনার পায়ে বেড়ি পরাবার চেষ্টা চললো অনবরত। তখন এ সংকীর্ণতার আবর্তে পড়ে মরা ছাড়া আমাদের আর কোন গতি রইল না। কল্পনায় অবাধ হতে না পারলে লেখক কিছুতেই লেখক হতে পারেন না। সেদিন আমরা লেখকরা কেউই সত্যিকার অর্থে বেঁচে ছিলাম। আমাদের চিন্তা ভাবনাই আমাদের প্রাণ, আমাদের জীবন–সে চিন্তাভাবনাকে আমাদের পদে পদে গলা টিপে হত্যা করতে হয়েছে। যে কথাটা বোরিস পাস্তেরনাক তার ডক্টর জিভাগো উপন্যাসে বলেছেন, ‘… There is only one thing they really want: you should hate what you like and love what you abhor!’ gay ভালোবাস তাকে ঘৃণা করো আর যা তোমার কাছে ঘৃণ্য তাকেই কিনা তোমাকে বাসতে হবে ভালো। পাকিস্তানের চব্বিশ বছর আমাদেরও তাই করতে হয়েছে। যে শাসক আর শাসনকে আমরা মনে প্রাণে ঘৃণা করতাম অনবরত তারই জিন্দাবাদ দিতে হয়েছে আমাদের লেখকদেরও। আর যে ভাষা যে দেশ আর জাতীয়তাকে আমরা অন্তর দিয়ে ভালোবাসতাম প্রচার করতে হয়েছে অনবরত তারই নিন্দা। এমন অবস্থা দীর্ঘকাল চললে যে-কোনো জাতির মানসিক পঙ্গুত্ব অনিবার্য। সুখের বিষয়, মাত্র চব্বিশ বছরে আমরা এ দুঃসহ শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছি।