গণতন্ত্র থেকে আমাদের অপ্রাপ্তির তালিকা অনেক বড় ঠিকই। কিন্তু গণতন্ত্র কী করতে পারে, করতে পেরেছে, তা-ও চিন্তা করা দরকার। আজ থেকে দশ বছর আগেও সব ছেলেমেয়ের স্কুলে একসঙ্গে মিড-ডে মিল খাওয়া নিয়ে নানা আপত্তি উঠত, আজ আর সেগুলো শোনা যায় না। ভারতের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে হয়তো এই প্রথম একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা কখনও অস্পৃশ্যতা মানেনি, জল-অচল বলে কোনও জাতকে চিনতে শেখেনি। সেই সঙ্গে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, দলিত-জনজাতির শিশুরা প্রায় সকলেই স্কুলে যাচ্ছে। সেখানে তারা আদৌ কিছু শিখছে কি না, কে ক’বছর স্কুলে পড়ছে, তা নিয়ে অসন্তোষ থাকতেই পারে। কিন্তু হাড়ি-ডোম-চামার ঘরের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়াই যে এখন ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে হচ্ছে, সেটা খুব কম কথা নয়।
আমরা বলছি না যে গণতন্ত্র ছাড়া এসব পরিবর্তন কোনও ভাবেই আসতে পারত না। কিন্তু এটা বোধ হয় বলা যায় যে গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভেদাভেদ বেশি দিন চলতে পারে না।
এটাও লক্ষ করা দরকার যে, গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার যে সব নিয়মকানুন রয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠান তার পরিচালনা করে, এত বছরে ভারতে সেগুলির নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা কমেনি, বরং বেড়েছে। আগে ভোটে রিগিং হচ্ছে বলে মাতামাতি হত, তাই গণতন্ত্রের একটা প্রধান শর্তই মার খেয়ে যাচ্ছিল। নির্বাচন কমিশন ভোটদানের বৈধতা বাড়াতে পেরেছে। যার জেতার কথা ছিল না সে জিতেছে, এমন অভিযোগ আজ সহজে কেউ বিশ্বাস করবে না। ১৯৯২ সালে ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের পর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও একটা মর্যাদা পেয়েছে। পঞ্চায়েতের কাজ নিয়ে মানুষের যতই ক্ষোভ থাক, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ ভোট দিচ্ছেন। গ্রামসভায় লোক যতই কম আসুক, সেখানেই গ্রামের উন্নয়নের পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছে। এই সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের নানা অকর্মণ্যতা-অক্ষমতা সত্ত্বেও এগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে কেউ কাজ করতে পারছেন না।
তা বলে গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের ক্ষোভও কম নেই। বিপুল দারিদ্রের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কী পেলাম? গণতন্ত্র মানে যদি হয় মানুষের শাসন তা হলে যে-দেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব, সে-দেশে গরিবের রুটি-কাপড়-বাসস্থান জুটল না কেন? যে দেশের অর্ধেক ভোটার মহিলা সেখানে মেয়েরা কেন অপুষ্টি, রক্তাল্পতায় ভোগে? কেন শিক্ষাহীন, শ্রমসর্বস্ব মানুষদের অধিকাংশ দলিত কিংবা আদিবাসী? যাদের যা প্রাপ্য তাদের যদি তা না-ই দেওয়া গেল, তা হলে কী লাভ হল গণতন্ত্রে?
এই বিরক্তি, ক্ষোভ থেকে সম্প্রতি আন্দোলনের একটা ধারা লক্ষ করা গিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে আদালতকে। খাদ্যের অধিকার আন্দোলনের সময়ে আমরা দেখেছি, কাকে কী দিতে হবে, কতটা দিতে হবে, তা-ও ঠিক করে দিয়েছিল আদালত। আবার প্রাপ্য জিনিস বা পরিষেবা যদি প্রার্থীর কাছে না পৌঁছয়, তার জন্য রাষ্ট্রকে ধমক দিতেও রয়েছে আদালত। এই ভাবধারায় আন্দোলনই বলছে যে, জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির মতো একটি অনির্বাচিত কমিটির সুপারিশে কিছু অনির্বাচিত লোক নিয়ে তৈরি হবে লোকপাল, যা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সরকারি কর্মীদের দ্রুত এবং কঠোর শাস্তি দেবে। এমন আপাদমস্তক অগণতান্ত্রিক একটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো তৈরি করার কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা স্পষ্টতই গণতন্ত্রের উপর ভরসা করতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন না যে, ‘কোথায় কী দুর্নীতি হচ্ছে আমরা সব প্রকাশ করে দেব, তারপর মানুষই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-আমলাদের ব্যবস্থা করবেন, সে ভোটের বাক্সেই হোক আর রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেই হোক।’ বরং অণ্ণা হজারে, জঁ দ্রেজ, অরুণা রায়ের মতো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ নতুন নতুন ‘অধিকার’ তৈরি করে, খানিকটা গণতন্ত্র ডিঙিয়ে, মানুষের কাছে প্রাপ্য পৌঁছে দিতে চাইছেন।
এই কাজ অনেকগুলি দিক থেকে গণতন্ত্রের বিরোধী। এক, বিচারব্যবস্থা দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছেন নাগরিক আন্দোলনের নেতারা। কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার বলেছিলেন যে, খাদ্যের অধিকার বাস্তবে কার্যকর করার ক্ষমতা ভারত সরকারের নেই। তাঁর কথায় কিছু যুক্তি নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক হল না এই অগণতান্ত্রিক চাপের নীতির জন্যই। মানুষের চাহিদা অনুসারে মানুষের প্রতিনিধি নীতি তৈরি করবেন, গণতন্ত্রের এই ‘ক্লাসিকাল’ ধারণা থেকে সরে যাচ্ছেন নেতারা। দুই, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় না গিয়ে তাঁরা নিজেদের মতকে ‘জনমত’ বলে দাবি করছেন, এবং দিল্লিতে ক্রমাগত রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিন, দরিদ্র নাগরিকের অধিকারের উপর জোর দিতে গিয়ে তাঁরা হয়তো খেয়াল করছেন না যে নিরপেক্ষ বিচার পাবার অধিকার গণতন্ত্রে একেবারে প্রাথমিক অধিকার। বিশেষত সরকারি ব্যবস্থার নিচুতলার কর্মীরাও নাগরিক, এবং তাঁদের নানা অনাচার সত্ত্বেও নাগরিক হিসেবে তাঁদের উপযুক্ত বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘জনস্বার্থে’ চটজলদি শাস্তি দিতে হবে, এই ধারণা উত্তর কোরিয়ায় মানানসই, ভারতে নয়।