আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, যে সব উদ্যোগ কাজ করতে পারে বলে ভাবা গিয়েছিল, সেগুলো কাজ করেনি। উদাহরণ—
ওড়িশায় বাড়িতে রান্নার জন্য ধোঁয়াহীন উনুন দেওয়া হয়েছিল আড়াই হাজার পরিবারকে। তাতে নিশ্বাসের সঙ্গে অতিরিক্ত কার্বন ঢোকা বন্ধ হবে, রান্নার খরচ ও সময় কমবে, এমনই আশা ছিল। দেখা গিয়েছে, প্রথম এক বছর প্রত্যাশামতো ফল দিলেও, তারপর থেকে উনুন না সারানো, এবং ঠিকমতো ব্যবহার না করার জন্য দূষণ ও খরচ বেড়ে পৌঁছে গিয়েছে সাধারণ উনুনের জায়গাতেই।
প্রাইভেট স্কুলে পড়লে শিশুরা আরও বেশি শিখবে, মনে করেন অনেকে। এই ধারণা ঠিক কিনা, তা বোঝার জন্য অন্ধ্রপ্রদেশের নানা গ্রামে দেড় হাজার পরিবারকে লটারির মাধ্যমে ‘ভাউচার’ বিলি করা হয়েছিল, যা ব্যবহার করে তাঁরা সন্তানকে প্রাইভেট স্কুলে পাঠাতে পারেন। এক বছর পরে দেখা গিয়েছে, ভাউচার পেয়ে যারা প্রাইভেট স্কুলে পড়ছে, আর যারা সরকারি স্কুলে পড়ছে, তাদের অঙ্ক ও মাতৃভাষার দক্ষতা এক মানের। ইংরেজিতে প্রাইভেট স্কুলের পড়ুয়ারা সামান্য ভাল করেছে।
আমরা যে ভাবে রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে ভাবতে অভ্যস্ত, পরীক্ষা-ভিত্তিক পরিবর্তনের এই রীতি হয়তো ঠিক তেমন নয়। কিন্তু এই পদ্ধতি যে আশ্বাস নিয়ে আসে, তা-ও খুব কম মূল্যবান নয়। যে-কোনও বড় আকারের দুর্নীতি, অপচয়, অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে একটা অসহায়তার ভাব জাগে। মনে হয়, কী করতে পারি? প্রতিপক্ষ যেখানে সার্বভৌম রাষ্ট্র, প্রভাবশালী নেতা, বহুজাতিক সংস্থা, সেখানে জনাকয়েক নাগরিকের পক্ষে কী করা সম্ভব? উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, সাংবাদিকদের প্রায়ই শুনতে হয় যে মালিকানা যারই হোক, সব কর্পোরেট মিডিয়া আসলে দারিদ্র দূর করার নামে দরিদ্রকে লোকচক্ষু থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্রে সামিল। নেতা-আমলা, বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা আর মিডিয়া মালিক, সবাই এক গেলাসের ইয়ার। এতে অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই সাংবাদিকের। নিচুস্তরের সরকারি কর্মী, অসরকারি সংস্থার ফিল্ড ওয়ার্কার, পঞ্চায়েত সদস্য, গবেষণা সংস্থার কর্মী, সকলের মধ্যেই হাল ছেড়ে দেওয়ার মনোভাব আসে।
পরীক্ষা-ভিত্তিক পরিবর্তনের পদ্ধতি কিন্তু বলে, যদি মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দেওয়া যায়, যদি ঠিক প্রযুক্তি কাজে লাগানো যায়, যদি অপচয়-দুর্নীতির উৎস খোঁজার চেষ্টা করা যায়, তা হলে অল্প পরিসরে হলেও বদল আনা যেতে পারে। সব স্তরে সব সমস্যা তাতে এক ঝটকায় চলে যাবে না। কিন্তু পরিবর্তনের সূচনা একটা হবে।
তার মানে এই নয় যে সমাজে অন্যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে সার্বিক আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। শুধু কিছু প্রশাসনিক বা প্রযুক্তিগত কলকব্জা নেড়ে কিছু বিশেষজ্ঞ সব ঠিক করে ফেলবে, এমন নয়। যেখানে মানুষ সজাগ ও সচেতন, যেখানে সে তার অধিকার বোঝে, ছুড়ে-দেওয়া টুকরো কুড়িয়ে নেয় না, অপমান হজম করে না, যেখানে তারা নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক হয়ে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম ও আগ্রহী, সেখানে গোটা ব্যবস্থাটা অনেক ভাল কাজ করে। যে সমাজে এমনটা হবে বলেই ধরেই নেওয়া চলে, তেমন সমাজ তৈরিতে সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে। সে সত্যকে মেনে নিয়ে, তাকে সম্মান জানিয়েও বলতে হয়, যতদিন না তেমন সমাজ তৈরি হচ্ছে, ততদিন গালে হাত দিয়ে বসে থাকা চলে না। দারিদ্র কমাতে যা করা যায়, তা করতে হবে। এখনই।